সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

সে এসেছিল...(ভৌতিক গল্প) : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
১১ মে ২০২১ ২১:০৯

আপডেট:
১১ মে ২০২১ ২১:১০

 

রাত জেগে গৌর কিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই’ পড়ছিলাম আমি। কী অসাধারণ উপন্যাস! মা-মাটি-দেশ ট্রি-লজি’র প্রথম উপন্যাস ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’-এর ঘোর কাটতে না কাটতেই ‘প্রেম নেই’ আমাকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে। সামনে বি.এ. পরীক্ষা। পুরোনো ঢাকার কবি নজরুল কলেজে পড়ি। ‘প্রেম নেই’ আমাকে ডুবিয়ে রেখেছে। পাঠ্য বই থেকেও দূরে সরিয়ে রেখেছে।

বছর ছয়েক আগে মনোহরপুর হাই স্কুল থেকে পাশ করে ঢাকায় এসেছি। রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে ‘প্রেম নেই’ পড়ছি। পড়তে পড়তে চোখের পাতা দুটো একটু জড়িয়ে আসে। তারপর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ ঠক্ ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনলাম। কে যেন দরজায় কড়া নাড়ছে! ঘুমজড়ানো চোখেই দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম। রাত বারোটা পেরিয়ে একটা বেজে গেছে! এত রাতে কড়া নাড়ছে কে? দরজার আই-হোল দিয়ে তাকাতেই একজোড়া উজ্জ্বল প্রখর চোখ দেখতে পেলাম। সাহস করে দরজা খুলে আমার চোখ ছানাবড়া! আমার বন্ধু আজিজ আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

আরে দোস্ত তুই! এতো রাতে কোত্থেকে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।

আজিজ ছিল গ্রামের হাইস্কুলে আমার সহপাঠি। দুজনের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠ ভাব। বন্ধুত্ব। তারপর একদিন হঠাৎ বিচ্ছেদ। আজিজ ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করল, আর আমি পাশ করলাম। এখান থেকেই আমাদের বিচ্ছেদের সূচনা। ও গ্রামের স্কুলেই রয়ে গেল আর আমি ঢাকা শহরে এসে ভর্তি হলাম কবি নজরুল কলেজে।

শহরে আসার পরে আমি আমার সকল বন্ধুদের সাথে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতাম। আমিই বন্ধুত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মাঝে মাঝেই ওকে চিঠি লিখতাম। কিন্তু আজিজ কোনওদিন চিঠির উত্তর লেখেনি। তাতে আমার ভীষণ অভিমান হতো। মন খারাপ হতো। নিজের প্রতি এতোটাই আত্মবিশ্বাস ছিল যে, আমার চিঠির উত্তর না দিয়ে কেউ থাকতেই পারে না।

 

আজ ২০ জুন গৌর কিশোর ঘোষের জন্মদিন। আমার প্রিয় লেখকের জন্মদিনেই আজিজের সাথে এতদিন পরে আবার দেখা। অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়েই রইলাম। ওর চেহারায় বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। পরনে জিনস, গায়ে টি-শার্ট। এতো রাতেও আমি খেয়াল করলাম, ওর চেহারায় কেমন যেন একটা আভিজাত্যের ছাপ জড়ানো।

প্রশ্ন করলাম, কিরে দোস্ত, এই বেশে এতদিন পরে কোত্থেকে এলি?

আজিজ হেসে বলল, কেন, তুই তো বহুদিন চিঠিতে আমাকে আসতে বলেছিস, আমি কী আসতে পারি না? নাকি কাছে এসে তোকে বিপদে ফেলে দিলাম।

আমি বললাম, না দোস্ত, আসবি না কেন, নিশ্চয়ই আসবি। আমিই তো তোকে কতবার আসতে বলেছি। তুই অভিমান করে আসিস না। এমনকি আমার কোনো চিঠির উত্তর পর্যন্ত লিখিস না। তা মেট্রিক তো পরের বছরে পাশ করেছিলি ইন্টার পাশ করেছিস তো? আর পাশ করলে আগামী বছর বি.এ. পরীক্ষা দিবি নিশ্চয়ই। ভালোই হলো, আমিও ইন্টার পাশ করে এক বছর আর পড়ালেখা করিনি। চাকরির খোঁজে বৃথায় একটা বছর নষ্ট করলাম। বি.এ. পাশ না করলে কেউ চাকরি দেবে না। ভালোই হলো দুজন একসঙ্গেই পরীক্ষা দেওয়া যাবে।

 

ঘরের মধ্যে এসে আমি খাটে বসলাম। আজিজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল। ওকে চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করলাম। কিন্তু বসল না...

চাপা গলায় আজিজ বলতে শুরু করল, জানিস জীবন, আমার কতদিনের আশা পরীক্ষায় পাশ করব। তারপর তোর সাথে ঢাকায় এসে একসঙ্গে পড়াশোনা করব।

আমি বললাম, বেশ তো, আমিও তো এক বছর লস দিয়েছি। তুই ভালো করে পড়াশোনা কর তাহলে দুজনেই একসাথে বি.এ. পাশ করব। তারপর দুই বন্ধু মিলে গ্রামে যাব।

আজিজ গোঁ ধরে রইল। কিছু বলছে না। হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, তা হয় না জীবন, আমি যে তোদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছি! অনেক... অনেক... দূরে...

আমি হেসে বললাম, কী যা-তা বলছিস, মাথা খারাপ হলো নাকি তোর?

আজিজ বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? শোন জীবন, আমি অনেকদিন হলো মারা গেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না? বিশ্বাস না হলে আমায় ছুঁয়ে দ্যাখ, তুই আমার অস্তিত্ব পাবি না। নাকের কাছে হাত রেখে দ্যাখ, আমার নাকে নিঃশ্বাস পড়ছে না।

হাত বাড়ানোর চেষ্টা করলাম আমি। পারলাম না। সাহসে কুলোলো না।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেঁয়ে গেল। ভয় পেয়ে গেলাম আমি। ভয়ার্ত গলায় চীৎকার করে ডাকলাম, আজিজ...

প্রথমে আজিজ সাড়া দিলো না। তারপর আবার ডাকলাম, ‌আ...জি...জ। এবার সাড়া দিলো। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কোন সুদূর তেপান্তরের মাঠ থেকে ভেসে আসছে ওর কণ্ঠস্বর! সে বলল, ভয় পেলি নাকি দোস্ত...

আমি শুষ্ক হাসি হেসে বললাম, দূর, তুই আমার সাথে এভাবে ঠাট্টা করছিস কেন?

আজিজ বলল, আচ্ছা জীবন, মানুষ মরে গেলে তাকে এতো ভয় পায় কেন পৃথিবীর মানুষ? কিন্তু দ্যাখ, আমি তোকে কতো ভালোবাসি, মরে গিয়েও তোকে না দেখে থাকতে পারলাম না। সেই মৃত্যুপুরী থেকে ছুটে এলাম শুধু তোকে একটিবার দেখার জন্যে!

ভয়ে আমার বুকটা শুকিয়ে আসছিল। আবার ওর কথা শুনে মনে মনে দুঃখও পেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আমি মোটেই ভয় পাইনি দোস্ত। তুই আমার কাছে এসে বোস। আয় কাছে আয়। চেয়ারে নয় খাটে এসে আমার পাশে বোস...

আজিজ হেসে বলল, দূর বোকা, আমার তো এখন বসার ক্ষমতা নেই। শুধু ভেসে ভেসে বেড়াই হাওয়ার বুকে ভর দিয়ে! আর অন্ধকার আমার খুব ভালো লাগে। অন্ধকারে আমি সাঁতার কাটি... তাই তো বিদ্যুতের আলোটা আমি নিভিয়ে দিলাম। তুই ভেবেছিস বিদ্যুৎ চলে গেছে! আলো আমি সহ্য করতে পারি না দোস্ত...

 

আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল ঘাম নামতে শুরু করল।

কোন সুদূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর একটানা বলে চলল, জানিস, মেট্রিক পরীক্ষায় পাশ করতে পারিনি বলে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বাবা-মায়ের তিরস্কার শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বাবা-মা শুধু তোর কথা বলত, তুই ভালো রেজাল্ট করে ঢাকার বড়ো কলেজে ভর্তি হয়েছিস, আর আমি ফেল করে... দোস্ত আমি সত্যিই আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আর সেজন্যই আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু জেদ চেপেছিল তোর উপর। প্রচণ্ড জেদ। তাই তো পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে মেট্রিক ও ইন্টার পাশ করলাম এবং ভালোভাবেই পাশ করলাম। ভাবছিলাম তোকে দেখিয়ে দেবো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে... কিন্তু আমার ভাগ্যটাই খারাপ... মরার আর সময় পেলাম না...

মরার সময় বার বার তোর কথা মনে পড়ছিল। বাবা-মায়ের মুখ ছাড়া আর কারোর কথা মনে পড়েনি, শুধু তোর মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। মরার সময়ই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোর সাথে একদিন দ্যাখা করবোই। তোর সাথে আমার সাক্ষাৎ হবেই...

অনেক দিন ধরে চেষ্টার পর আজ সুযোগ পেয়েছি। হঠাৎ করেই আমার শরীরে জ্বর আর গলা ব্যথা। একদিন... দুদিন করে করে দশ-বারো দিন পেরিয়ে গেল, আমার জ্বর ভালো হয় না। শরীরটা শুকিয়ে যেতে লাগল। বাবা-মা খুব চিন্তা করছিল। তারপর তো মরেই গেলাম। মরলাম কিন্তু তোর সাথে দ্যাখা করার ইচ্ছেটা রয়েই গেল...

আমি ওকে বাধা দিয়ে বললাম, হঠাৎ এরকম হলো ক্যান রে দোস্ত?

আমার কথায় আজিজ হো হো করে হেসে উঠল। সে হাসিতে আমার কলজে কেঁপে উঠল। ও বলতে শুরু করল, সে তোরা বুঝবি না রে, তোরা তো পৃথিবীতে বেঁচে থাকা রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। দ্যাখ না আমায় কেমন দেখাচ্ছে!

আমি ভালো করে চেয়ে দেখলাম, ঘরজুড়ে একটা কালো ছায়া নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে! আবছা। অস্বচ্ছ। অস্বচ্ছ ছায়ার মাঝেও ভেতরের কঙ্কালটা আমার চোখে স্পষ্ট ধরা দিলো। সাহস করে আরও একটু কাছে গেলাম। এবার আরও স্পষ্ট হলো। কঙ্কালটা নড়ে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমার মাথাটা বনবন করে ঘুরে উঠল। গলার ভেতরটা ততক্ষণে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হাত-পা সব যেন আড়ষ্ট। অনেক কষ্টে শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করে ব্যাকুল কণ্ঠে বললাম, আর আমাকে ভয় দেখাস না দোস্ত, আমি আর নিতে পারছি না। জাস্ট নিতে পারছি না... ততক্ষণে আমার চোখদুটো প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। মনে হলো আমি যেন কোন অতল গহবরে হারিয়ে যাচ্ছি। তারপর কী হলো আর বলতে পারব না। কারণ কী হয়েছে তার কিছুই আমি জানি না।

 

৪.

অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে আমি চোখ মেলে তাকালাম। আজিজকে আর দেখতে পেলাম না। শুধু শুনলাম একটা কণ্ঠস্বর! আজিজের কণ্ঠস্বর! তেপান্তরের মাঠ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর। হ্যাঁ স্পষ্ট ওর গলা। ও বলছে, ভয় পেলি দোস্ত? যাক তোকে তাহলে মরে গিয়ে আমি ভয় দেখাতে পেরেছি। ভালো ছাত্র হিসেবে তোর গর্ব ছিল। বাবা-মা আমাকে তোর সাথে কতবার তুলনা করে যে অপমান করেছে তা বলে বোঝাতে পারব না। এতোদিন পর তোর দেখা পেয়ে আজ সত্যিই বড্ড শান্তি পেলাম। আর তোকে যে ভয় দেখাতে পেরেছি, এতেও আমার আত্মা শান্তি পাবে রে দোস্ত! তুই অঙ্ক ভয় পেতিস না, ইংরেজি ভয় পেতিস না, ভূগোল ভয় পেতিস না... ভূত ভয় পেতিস না... কিন্তু আজ! ঠিক আছে দোস্ত আর না, তুই ভালো থাক, আজ চললাম। তোর সাথে হয়তো আর কোনওদিন দেখা হবে না। বিদায় বন্ধু, পরপারে তোর জন্যে অপেক্ষায় থাকব!

জমাট ঘন অন্ধকারের মাঝে ওর কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল! যেন ভেসে গেল অন্ধকার বাতাসের স্তরে স্তরে। আমি মোহগ্রস্ত হয়ে ঘরের চারিদিকে ওকে খুঁজতে লাগলাম। অকস্মাৎ মনে হলো ঘর থেকে কোনো ঝোড়ো বাতাস যেন বেরিয়ে গেল!

 

৫.

মসজিদ থেকে ফজরের আযানের শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। ঘামে আমার সারা শরীর ভিজে গেছে। খাটে শুয়ে শুয়ে ‘প্রেম নেই’ পড়ছিলাম, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি বিশ্রী স্বপ্নটাই না দেখলাম। আড়ষ্টভাব কাটিয়ে উঠে আজিজের কথা ভাবতে লাগলাম। আমার ছোটবেলার বন্ধু আজিজ...

এই ঘটনার তিন দিন পরে চিঠি পেলাম বাড়ি থেকে। বাবা লিখেছেন গত মাসের এগারো তারিখে টায়ফয়েড জ্বরে তোর বন্ধু আজিজের মৃত্যু হয়েছে। আমার বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠল আজিজের জন্য! মনে মনে বললাম, আজিজ তুই আবার ফিরে আয় অন্ধকারের মাঝে। আমি তোর অন্ধকারের বন্ধু হয়েই থাকতে চাই। তুই ‘সে’ হয়েই বার বার আমার কাছে ফিরে আয়। আয় ফিরে আয়...

 

মশিউর রহমান
শিশুসাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
প্রকাশক, সৃজনী
পরিচালক (প্রচার), বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top