সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

বিকেলের ফ্যাকাশে আলো : বেগম জাহান আরা


প্রকাশিত:
১১ মে ২০২১ ২১:৫৩

আপডেট:
৪ মে ২০২৪ ১৩:২৩

 

একেবারে প্রান্তিক বয়সের বিপর্যয়কর আত্মবিশ্বাসহীনতা কষ্টকর মনে হয় আয়েশার। কিছুটা লজ্জারও। কি করে ভুলে গেলো সে আজকের মিটিং-এর কথা? প্রত্যেকের পছন্দ মতো খাবার মেনু জমা দেয়ার কথা ছিলো আজ। তা থেকে বাছাই করা হবে। কয়েক জন সদস্য ফোন করে জানতে চাইলো,অসুস্থ কি না সে? বলতেই হলো, একেবারে ভুলে গেছিলো তারিখটা। অনুতপ্ত হলো। লজ্জা প্রকাশ করলো। মিটিংটাই ভেস্তে গেলো। আগামি রবিবারে দুজন ঢাকায় থাকবে না। তার মানে, পনরো দিন পরে আবার মিটিং। বয়স হয়েছে সবারই। কার কি ঘটে যায় কে জানে? স্বাস্থ্য তো সবারই নড়ো বড়ো। যাক, কি আর করা! ইচ্ছে করে তো আর করে নি। নিজের মনকে বুঝ দেয় আয়েশা।

ঘটনা হলো, লিসবন থেকে কর্তার বহু পুরনো এক বন্ধু শফিকুল  ই-মেইলে লেখেছে যে, সস্ত্রীক আসছে সে বাংলাদেশে। এমন নস্টালজিয়ায় ধরলো কর্তাকে! তার গল্প আর থামে না। একই গ্রামের ছেলে তারা। ছোটো বেলায় একই স্কুলে পাঠের যাত্রা শুরু। সেই নামতা পড়া দুলে দুলে। সবসময় দুজনে একসাথে বসতো। দুষ্টুমি করতো এক পেট হয়ে। ফলে গুরুর বেত খেতো দুজনেই একসাথে। ওর বুদ্ধি ছিলো বেশি। কিন্তু পড়তে চাইতো না। সারা দিন খেলতো। বাড়িতেই কি কম বকাবকি খেতে হতো! তবু খেলার নেশা ঘোঁচে না। স্কুল টিমে খেলতো। দেখতে দেখতে ভালো ফুটবল প্লেয়ার হয়ে উঠলো। তারপর একদিন ন্যাশনাল টিমে জায়গা পেলো। সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল টিমের প্লেয়ার হয়ে গেলো।সবাই বলতো, এই ছেলের কিচ্ছু হবে না। খেলা যে আবার পেশা হতে পারে তখন কেউ ভাবতেই পারতো না। এমনি কতো কথা মনে পড়ে যায়। কথা যেনো থামতেই চায় না ওর। কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হলো বুঝতেই পারেনি আয়েশা। ছি ছি কি লজ্জা! কতো কাজ পড়ে আছে।

তাছাড়াও আজকাল আয়েশার খুব ভুলে যাওয়ার রোগ হয়েছে। শেষে কি ভোলা রোগ হবে তার? শুধু কি তাই? কাজের তাকত যে কমে গেছে সেটাও বুঝতে চায় না। মনে করে, এই কাজটা বিকেলের মধ্যেই করে ফেলতে পারবে। কিন্তু হয় না। ভাবে, গুরুত্বপুর্ণ কথাটা মনে থাকবে। কিন্তু থাকে না। বাজারে জিনিসের তালিকা না নিয়ে গেলেও কেনা কাটায় তেমন একটা ভুল হতো না আগে। এখন সব এলোমেলো হয়ে যায়। প্রয়োজনের কতো কিছু না কিনেই বাড়ি চলে আসে। সেজন্য মাঝে মাঝে কর্তা একটু অবাক হন। সেও কি কম বিরক্ত হয় নিজের ওপর। কই আগে তো এমন হতো না। সময় মতো কাজ শেষ হতো। কাজের কথা কিছুতেই ভুলতো না। তালিকা না থাকলেও কেনা কাটায় তেমন একটা ভুল হতো না। আত্মবিশ্বাস ছিলো নিজের ক্ষমতার ওপর। তাহলে এখন কি নিজের ওপর আস্থা কমে গেছে তার? তাছাড়া একটা দুটো ব্যাপার তো নয়, বহু ঘটনাই ঘটছে। কতক কর্তাকে জানায়, কতক জানায় না। ভাবে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হয় না। একেই কি বলে অজ্ঞতাপ্রসুত আত্মবিশ্বাস? ছট ফট করে ওঠে আয়েশা ওরফে এশা।

 

কে বলে সংসার করতে হলে আত্মবিশ্বাস লাগে না। সংসার নিয়ন্ত্রনে রাখা মস্ত পরিকল্পনার বিষয়। আর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সংসার রাজ্য পরিচালনা করাটা আত্মবিশ্বাসের কাজ তো বটেই। বিশেষ করে এক কালে অতিশয় কর্মঠ জীবন ছিলো তার। কাজ না থাকলে খুঁজে পেতে কিছু একটা করতে বসতো। নিদেন পক্ষে ড্রেসিং টেবিলের সাজ সরঞ্জাম সরিয়ে মোছামুছি করতো আবার। খাটের পাশে রাখা পাপোষ তুলে নিয়ে ঝাড়তো। ছেলে মেয়ের ঘর বাড়ি। ছুটোছুটি করে অবিরত। ফলে ধুলোবালি কিছু না কিছু তো থাকতোই পাপোষে। তখন কাপড় ধোয়া মেশিন তো ছিলো না, সাবান ঘঁষেই কাঁচতে হতো বাচ্চাদের কাপড়। বেশি ময়লা হলে সোডা সাবান দিয়ে পানি ফুটিয়ে তাতে সেদ্ধ করেও কাঁচা হতো। কাজের কি আর অন্ত ছিলো? ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরতো সংসারের চাকা। সাথে সেও।

মনে আছে সব। বাচ্চারা সাবান কাঁচা কাপড় পরেই স্কুলে যেতো। ইস্ত্রি হতো শুধু বাড়ির কর্তার কাপড়। সেও তো বাড়িতে ইস্ত্রি নয়। ধোপার বাড়ি থেকেই ইস্ত্রি হয়ে আসতো। কালে ভদ্রে আয়েশা দু একটা সাদা শাড়ি দিতো ধোপার বাড়ি। কর্তা পছন্দ করতো না বলে নয়, তখন বেশির ভাগ বাড়ির চলই ছিলো ওরকম। তবে সৌখিন বৌরা পাড়ওয়ালা শাড়ি বেশ ধুতে দিতো। ইস্ত্রি করা ঝামেলা তো বটেই, বাড়িতে ব্যাবস্থাও থাকতো না।মধ্যবিত্ত পরিবার আয়েশাদের। সংসারে টানাটানি ছিলোনা। আবার অঢেলও ছিলো না। কর্তা চাইতেন প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমানে টাকা সঞ্চয় হবে। সেটা হতো। আয়েশা ছিলো খুব হিসেবি মেয়ে। অপচয় কি জিনিস তা সে জানতো না। গুনটা সে বাবা মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে।

 

কর্তা গোলাম রাসুল ছিলেন একটু সামন্ত প্রভুর মতো। হুকুমদারি এবং হুকুম জারি করতে ভালোবাসতেন। মেজাজে একটু রাশভারিও। বাচ্চারা বেশ ভয় করতো বাবাকে। সেটাও তখনকার চল ছিলো।  কাজের লোকজন তো সামনেই আসতো না। এমন কি জমাদারনিটা পর্যন্ত সামনে পড়তে চাইতো না। রাসুল সাহেবের সেটা বেশ ভালো লাগতো বলেই মনে হতো এশার। কিন্তু বৌ-এর সঙ্গে একেবারে  অন্য মানুষ। বাইরের খোলস ফেলে তখন প্রিয় পত্নির খুব কাছের জন। উচ্ছ্বলতা বা রোমান্স কমই ছিলো। কিন্তু আদর আন্তরিকতা ভালোবাসা ছিলো। নিরাপত্তাও ছিলো ঘরে। তখমকার মেয়েরা কি খুব বেশি কিছু চাইতো স্বামীর কাছ থেকে? মনে হয় না আয়েশার।

সে কি আজকের কথা? পঁচাত্তর বছর আগের স্মৃতি। ফ্যাকাশে হয়ে গেলেও  কিছু মনে আছে এখনও আয়েশাদের শহরে তখন সার্ভিস ল্যাট্রিন। বাড়ির এককোনায়  নির্মাণ করা হতো। কয়েকটা সিঁড়ি উঠে তবে সেখানে বসা। কারন নিচে মাটির গামলা পাতার জন্য ঘরের মতো ফাঁকা যায়গা থাকতো। সবই পাকা গাঁথুনি দিয়ে ঢাকা। বাইরের দিকে খিলানের মতো দরোজা। পাল্লা নেই। সেখান দিয়ে জমাদারনি বা জমাদারেরা মল সংগ্রহ করতো। তারপর রাস্তায় রাখা ময়লা টানা শক্ত বড়ো গোল ধরনের ড্রাম মার্কা গাড়ির মধ্যে ঢালতো সেগুলো। তারপরে ঢাকনা দিয়ে ঢাকতো। মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি। কখনও ঢাকনাও থাকতো না। সে একটা দৃশ্য ছিলো বটে! একটা মোষ টেনে নিয়ে যেতো গাড়িটা। একজন চালকও থাকতো গাড়িটার ওপরে। ঐ সময় রাস্তায় খুবই দুর্গন্ধ ছড়াতো। কিছু করার ছিলো না। সহ্য করতেই হতো সবাইকে।

 

স্কুল যাওয়ার সময় কখনো কখনো ঐ মল টানা গাড়ির পাশ দিয়ে যেতে হয়েছে। ছেলে মেয়েরা নাকে কাপড় চেপে দৌড়ে পালাতো এলাকা ছেড়ে। গাড়ি তো চলতো ঘটাং ঘটাং করে ধির লয়ে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হতো, যখন গাড়ির ঢাকনা থাকতো না। চালক কিন্তু দিব্যি বসে থাকতো নিজের আসনে। একদিন বাবার হাত ধরে কোথায় যেনো যাচ্ছিলো আয়েশা। ঐ গাড়িটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফ্রকের ঘের তুলে নাকে চেপে ধরলো। বাবা বলেছিলেন, এরকম করলে ওদের অসম্মান করা হয়। ওরা তো আমাদের জন্যই কাজ করে। এই কাজটা যদি ওরা না করতো, তাহলে আমাদেরকেই  তা করতে হতো। ময়লা জমিয়ে তো আমরা বাঁচতে পারতাম না। তাই না?

একা একা হাসে আয়েশা। কি দিন ছিলো তখন। অথচ সেটাই ছিলো খুব স্বাভাবিক এবং ভদ্র শহুরে জীবন। শহরের প্রান্তিক এলাকায় তো কাঁচা বাথরুম। একটা গর্ত করে তার ওপর কাটা বাঁশের কয়েকটা টুকরো পেতে বসার ব্যাবস্থা। কিছুদিন পর মাটি দিয়ে ওটা বন্ধ করে আবার একটা গর্ত করে  বাথরুম  বানানো। গ্রামের অবস্থা তো ভয়াবহ। একবার বাবার সাথে দাদু বাড়ি গিয়ে সে কি কান্ড! নানার গ্রামে গিয়েও একই ব্যাপার। আয়েশা কেঁদে কেটে একাকার। তবে কাঁচা বাথরুম যে কতো প্রকার এবং কতো ভয়ানক হতে পারে সেটা মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামে থাকতে দেখেছে সে।

এখনও আঁতকে ওঠে মনে হলে। কি ভাবে যে গ্রামের মানুষজন সারাটা জীবন মাঠে ঘাটে  বাথরুমের কাজ সারে! বিশেষ করে মহিলাদের কষ্ট ভাষায় বোঝানো সম্ভব না। ওদের কেউ কেউ বলছে, বাথরুমের কষ্টের চেয়ে পেটে বাচ্চা নেয়াও ভালো। তখন বুঝতে পারে এশা যে, জীবন যাপন ব্যাবস্থার উন্নতি না হলে শধু ট্যাবলেট খাইয়ে পরিবার পরিকল্পনা হবে না। এখনো এমন কিছু উন্নতি হয়নি স্যানিটেশন ব্যাবস্থার। সে একাত্তরে যা দেখে এসেছিলো, বলতে গেলে প্রায় সে রকমই আছে। এটাচড বাথ-এর কথা এখনও স্বপ্ন গ্রামীন মানুষের জীবনে। ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। মা খালা দাদি নানি-রা কি ভাবে ম্যানেজ করতেন সেটা আয়েশা কল্পনাই করতে পারে না।

নগর জীবনে বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েরা এসব কথাকে রুপকথা মনে করে। বিশ্বাসই করতে পারে না এসব কথা। আয়েশার ভাগ্য ভালো। মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় এসেছে বিয়ের পর পরই। তখন ঢাকাও তো এই ঢাকা ছিলো না। আজিমপুর কলোনির বাসাগুলোতে তখন আমলারাই থাকতো। বনেদি এলাকা বলতো সকলে। সবচেয়ে ভালো লাগতো তার রান্না ঘর। উঁচু বেদিতে চুলো। দাঁড়িয়ে রান্না করতে হতো। ছিম ছাম ফিট ফাট থেকে রান্না করতে তার ভালো লাগতো বেশ। বাপের বাড়িতে মাটিতে বসে কাটা ধোয়া করেছে সবাই। সেও করেছে। ঢাকায় এসে বুঝতে পারলো দাঁড়িয়ে রান্না করার আরাম কতো বেশি।

সেই আরাম আজ আর লাগে না। কোমরে ব্যাথা। পায়ে ব্যাথা। বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে কাজ করতে গেলে কষ্ট হয়। বুয়ারা কেটে বেছে দিলেও রান্নাটা এখনো নিজেই করে। নাহলে কর্তার পছন্দ হয় না। মুখে না বললেও সে বোঝে। ছেলে দুটো বিদেশে। মেয়ে বরিশালে। জামাই মেয়ে সেখানে বি এম কলেজের অধ্যাপক। টোনা টুনির সংসার তাদের। তবু তো রান্না খাওয়া আছে। এখন বাড়তি সুবিধে আছে একটা। একদিন রান্না করে তিন চার দিন খাওয়া যায়। ফ্রিজ আছে বলে এই আরামটা তৈরি করে নিয়েছে আয়েশা। কর্তা বিবেচক। এসব নিয়ে কোনো কথা বলেন না।  সেও একটা আরাম বটে!

 

পাশের প্রতিবেশির বাড়িতেই তো এই রেওয়াজ চলে না। রোজ রোজ টাটকা রান্না চাই। রাবেয়ারও বয়স হয়েছে। হয়তো সমবয়সিই হবে। বিধবা মানুষ। বড়ো ছেলের সংসারে থাকে। ছোটো দুই মেয়ে থাকে ময়মনসিংহের দুই প্রান্তে। একজন কিশোরগঞ্জ আর এক জন বিরিসিরি।সেখানে চাকরি করে জামাইরা। ওরা শুধু ঘর সংসার করে, বাচ্চা লালন পালন করে। জামাইরা বৌদের চাকরি করা পছন্দ করে না। কিন্তু ছেলের বউ একটা মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকে চাকরি করে। দুটো মেয়ে রেখে যায় কাজে। ওদের স্কুল থেকে আনা নেয়া রাবেয়াকেই করতে হয়। রান্নার ঝামেলা তো আছেই। স্কুল থেকে বাচ্চাদের আনা নেয়ার জন্য কাজের মেয়ের ওপর ভরসা হয় না। যা সব ঘটনা ঘটছে আজকাল।

আয়েশা মাঝে মাঝে সখ করে রাবেয়ার সাথে স্কুলে যায়। একেবারে বাড়ি ঘেঁষা বলতে গেলে। মায়েরা স্কুলের গেটের সামনে ফুটপাথে চাদর বিছিয়ে বসে থাকে। গল্প করে। সেলাই করে। কখনো ভ্যানওয়ালার কাছ থেকে শাক নিয়ে বাছে। বাড়িতে গিয়ে তো করতেই হবে। হয়তো বা দূরে বাসা।একবার আসা, একবার যাওয়ার পরিশ্রম বেশি। রিক্সা ভাড়াও লাগে। তাই কয়েক ঘন্টা সময় স্কুলের কাছেই কাটাতে হয়। বিশেষ করে পাট শাক মৌসুমে  শাক বাছার কাজ বেশি চোখে পড়ে। তো বসে বসে কাজটা এগিয়ে রাখে।

রাবেয়া বলে, নারী স্বাধীনতার কি সুখ দেখেন আপা। মায়েরা এবং দাদি নানিরা কি কষ্ট করে বাচ্চাদের লেখা পড়ার জন্য। শুধু এইটুকুই নয়, ডাক্তার বদ্যির কাছে যাওয়া, বাচ্চাদের জন্য কেনাকাটা, সবই করতে হয় মায়েদের। আমি তো দেখি, মেয়েদের স্বাধীনতার দামে পুরুষরাই বেশি স্বাধীন হয়ে গেছে, তাই না?

 

- আমার কিন্তু বেশ লাগে রাবেয়া। আয়েশা বলে, আমরা তো বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগই পেতাম না। শ্বশুর শাশুড়ি স্বামী কেউ চাইতো না।এখন তো সেই সুযোগ মেয়েরা পায়। এমন কি আমরাও পাই।
- তা পাই। কিন্তু এখন আর বেশি বাইরে যেতে ভালো লাগে না আপা।
- তবে দায়িত্ব থাকলে হয়তো তোমার মতোই রোজ রোজ় স্কুলের ডিউটি করতে আমার ভালো নাও লাগতে পারতো।
রাবেয়া মন্তব্য করে না। চুপ করে  থাকে।
- আমি মাঝে মাঝে তোমার কাজটা করে দিতে পারি রাবেয়া। যদি চাও।
- না না আপা, আপনার কোমরে ব্যাথা। সেটা তো আমি জানি।
- তা ঠিক। তবে মাঝে মাঝে একটু হাঁটতেও বলেছেন ডাক্তার।  
- গোলাম ভাই কেমন আছেন?
- তুমি এখনো গোলাম ভাই বলো রাবেয়া? হাসে আয়েশা।
- সরি আপা, রাসুল ভাই কেমন আছেন?
দুজনেই হাসে। এশা বলে, গোলাম নামটা ও মোটেই সহ্য করতে পারে না রাবেয়া।
- তো নামটা বদলে ফেলেন নি কেনো এতোদিন?
- সে কথা কি বলি নি? বলেন, শুধু সার্টিফিকেট-এর নাম তো না, বাবা মায়ের দেয়া নাম কি না তাই। আবার হাসে দুজন।
- বাইরের লোক ঐ নামে ডাকলে কি বলেন? রাবেয়া জানতে চায়।
- হজম করেন। আমাদের বড়ো ছেলেই একদিন তুলকালাম কান্ড করেছিলো।
- মানে?
- হয়েছে কি, কর্তার গ্রাম সুবাদের এক চাচা এসেছিলেন বাসায়। টুটুল তখন বাসার সামনে খেলছিলো। উনি টুটূল কে দেখে বললেন, এই বাবা, তুমি কি গোলামের ব্যাটা? ও সেটাকে গাল মনে করে রেগে মেগে বাসায় এসে বললো। একজন অসভ্য লোক এসে কোনো কারন ছাড়াই আমাকে গোলামের ব্যাটা বলে গাল দিলেন। কেনো মা? আমি তো উনার সাথে কোনো দুষ্টুমি করিনি? একা একা খেলছিলাম।

রাবেয়া হাসে। মজা পায় গল্পটা শুনে।

- তুমি হাসছো? অনেক কষ্টে ওকে বোঝানো হলো যে ওটা গাল নয়। ওটা তোমার বাবার ভালো নাম।

হঠাত  এশার দৃষ্টি  পড়ে  মাছের ভ্যানের ওপর। খুশি হয়ে বলে ওঠে, ঐ দেখো, দুটো মাছের ভ্যান এসেছে। বাড়ি যাওয়ার সময় দেখে যাবো কি কি মাছ আছে? কি বলো?

- কিনবেন না? রাবেয়া বলে।
- না, আজ আমার রান্নার দিন না গো।
- রান্না শেষ করে এসেছেন বুঝি?
- সে তো কালই শেষ।
- আজ কিছুই রান্না করবেন না?
- আমি তো রোজ রাঁধি না। একদিন রাঁধি, কয়েক দিন খাই। এমন কি মাঝে মাঝে একদিনের ভাতও দুদিন খাই।
- বাহ! ভালো তো। আমার বাসায় রোজ টাটকা রান্না চাই। বাসি খাবে না কেউ। বাপের স্বভাব পেয়েছে ছেলে।
- বাসি হলো কেমন করে? ঢাকনাওয়ালা ভালো প্লাস্টিকের কন্টেইনারে রান্না জিনিস ভাগ ভাগ করে রাখি ফ্রিজে। পরদিন যেটা খাবো, শুধু সেইটা মাইক্রো আভেনে গরম করে নিই।
- টাটকা লাগে খেতে?
- এক্কেবারে টাটকার মতোই লাগে। এখন আর রোজ় রোজ় রান্না করতে ভালো লাগেনা রাবেয়া। দুটো মানুষের একদিনের রান্না হাঁড়ির তলায় পড়ে থাকে।
- আপনার বুদ্ধিটা খুব ভালো তো। অন্তত মাছ মাংস তো দু দিনের জন্য রান্না করে রাখতেই পারি। ডাল ভাত না হয় রোজ করলাম। আমরা তো খানেওয়ালাও বেশি।

ঘন্টা বাজলো স্কুলের। এবার বাচ্চারা বেরিয়ে আসবে। এসেই আইসক্রিম খেতে চাইবে। ফেরিওয়ালারাও এমন হয়েছে, পারে তো  তেড়ে এসে বাচ্চাদের মুখে গুঁজে দেয় রকমারি খাবার। এলা বেলা নিলোই দুটো আইসক্রিম। বই-এর ব্যাগ ছুঁড়ে দিলো দুজনের দিকে। আয়েশাকেও তারা দাদুর মতো মনে করে। দুই দাদু হেসে আনন্দের সাথে ব্যাগ নিয়ে মাছের ভ্যানের দিকে গেলো।

ফরমালিনের অত্যাচারে একটা লাভ হয়েছে। এখন প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা বাঁশের তৈরি চৌবাচ্চায় পানির মধ্যে বড়ো মাছ রাখে ওরা। এই রুই, কাতল, মিরকা, শোল, মহাশোল (কেউ বলে মাইশোল), পাঙাশ, কই, মাগুর  ছাড়াও  ডালা বা থালায় থাকে নানা রকম ছোটো মাছ। ট্যাংরা, পুঁটি, মলা, ঢেলা, কাচকি,এবং পাঁচমিশালিও।

 

আয়েশা আর রাবেয়া মাছের ভ্যানের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রাবেয়া মাছ দেখতে শুরু করে। মনে হয় কিনবে। একটা মাইশোলের দাম করলো।

- এখন মাছ কিনবে? আয়েশা একটু অবাক হয়।
- আজ কদিন ধরে মাছ নেই বাসায়। নিয়ে যাই কদিন চলবে। বেশ বড়ো আর তাজা আছে মাছটা।
- এতো বেলায় গিয়ে রান্না করবে?
- বেলা কোথায় আপা? বারোটার পরেই আমাকে রান্না করতে হয়। বুয়াটা আসে দেরি করে। বাচ্চাদের বাসায় নিয়ে গিয়ে একটু টিফিন খেতে দিই।ওরা খেলা করে, আমি রাঁধি।
- এবার রোজ় রোজ রান্নার ব্যাপারটা কমিয়ে ফেলো তো বাপু।
- বৌটা খেটে খুটে আসে, বাসি তরকারি খেতে পারে না। ছেলেও চায় টাটকা। তা ছাড়া আমার কাজই বা কি? সংসারের কাজেই দিন কাটাই।
- এই কথা বলো না রাবেয়া। মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি কাজ করে।এজন্যই তো গিন্নিদের আজকাল ‘হোম মেকার’ বলে।
- বলেছো ঠিকই। দোষটা আসলে আমাদের। আমরা নিজেরাই হীনমন্য। নিজেদের বড়ো করে দেখতে পারি না।
- যাক বাদ দাও। কেটেই গেছে জীবন।

বিচিত্র এই পৃথিবী। সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবারে আয় রোজগারই বা কি ছিলো? বিয়ের গয়না বেচে একরকম জোর করে আজিমপুরে তিন কাঠা জায়গা কিনেছিলো রাবেয়া। সে  তখন চাকরি করতো একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। বাচ্চাদের হাতে খড়ি সেই স্কুলেই। আস্তে আস্তে সেখানে মাথা গোঁজার মতো দুই ঘরের একটা বাড়িও বানায়। ক্রমে দোতলাও করে। তিন ছেলে মেয়ে মানুষ করেছে কষ্ট করেই। সরকারি অফিসের কেরানি ছিলেন দবির ভাই। বড্ড সত মানুষ ছিলেন বলে এদিক ওদিক থেকে টাকা কামাই করতে পারেন নি। ধান্দা জিনিসটাই বোঝেন নি। কিন্তু খেয়ে পরে ছেলে মেয়ে মানুষ করতে পেরেছেন দুজনের আয় রোজগার দিয়ে। সাদা মাটা জীবনে নিজের যত্ন হয়ত কখনোই নিতে পারেন নি। সুঠাম শরীর ছিল বলে পেরে গেছেন। স্বামীর কথা বলতে গেলে এখনও রাবেয়ার চোখ সরোবর হয়ে ওঠে।

কদিন পর নাতনি দুটোকে নিয়ে বেড়াতে এলো রাবেয়া। সাথে তার পাশের বাড়ির প্রতিবেশি ফাতিমা। রাবেয়া ওকে বলে ওশিন। সেই জাপানি সিনেমা থেকে নামটা ধার করেছে। কারনও অবশ্য আছে একটা। সেকথা পরে হবে। আয়েশা খুশি হয়। যাক তাদের “নানু দাদু” সংস্থার সদস্য বাড়লো আর একজন। মোট নয় জন হয়েছে। তারা মাঝে মাঝে পালা করে এক একজনের বাসায় বসবে। কিছুক্ষন গল্প গুজব করবে। আর চা খাওয়া হবে একসঙ্গে। টা থাকলে খুবই ভালো। না হলেও কথা নেই। মাসে একটা খাই দাই হয়। বয়সি জীবনের একঘেয়ে নিস্তরঙ্গ সময়ের পালে একটু ফুর ফুরে  ফাগুন বাতাস লাগে। এই আর কি। চৈত্রের খরতাপের পরে পড়ন্ত বিকেলের হাওয়ার মতো। জরায় দুর্বল, বয়সের ভারে কিছুটা নুব্জ, রঙহীন জীবনে রঙধনু দেখা না গেলেও টেনে টেনে আয়ুর পথটুকু তো পাড়ি দিতে হবে। সেই পথের আলো অস্বচ্ছ হলেও বিস্বাদ না হয়।

 

বেগম জাহান আরা
কবি ও সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top