সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

নাছোড়বান্দা ভাইজান (রম্য গল্প) : রহমান তৌহিদ


প্রকাশিত:
১১ মে ২০২১ ২১:৫৬

আপডেট:
১১ মে ২০২১ ২২:১৪

 

ভাইজান শব্দটি দাপ্তরিক নয়, তবে তিনি তা প্রায় দাপ্তরিক করেই ছেড়েছেন। দপ্তরকে কিভাবে নিজের স্বার্থে বাড়ি ঘর বানিয়ে ফেলা যায়, তা তাকে না দেখলে বুঝা যাবে না। প্রথম আলাপে তিনি আপনার মন জয় করে ফেলবেন। জিজ্ঞাসাবাদ ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে, যতক্ষণ না তিনি আপনার সাথে তার আত্মীয়তার কোনো সূত্র বের না করতে পারেন। লতায়-পাতায়, শাখা-প্রশাখায় এমনকি শিরা-উপশিরা পর্যন্ত যেতে তার আপত্তি নেই। তবুও একটা সম্পর্ক তার পাতানো চাই। সম্পর্ক পাতাতে তিনি নাছোড়বান্দা। তাই, রসিকজন তার নাম দিয়েছে নাছোড়বান্দা ভাইজান।

সকালে দপ্তরে ঢুকেই নাছোড়বান্দা ভাইজানের ধান্ধা কার রুমে প্রথম কফি পান সারা যায়।

উদ্দেশ্যহীনভাবে তিনি পিএবিএক্স নম্বরে ফোন করবেন।

ওপাশ থেকে হয়তো শোনা গেল, স্যার, ইফতেখার বলছি স্যার।

তোমাকে তো ফোন করতে চাই নি, করতে চেয়েছিলাম মাহবুবকে। তোমার কাছে গেল কিভাবে?

ফোনটা তো স্যার আপনি করেছেন, আমি করি নি। কেমনে আসলো, আপনিই ভাল জানেন।

বেশি পণ্ডিত হয়ে গেছ? বেশি পাকামি করবা না। দিলে মেজাজটা খারাপ করে।

সরি স্যার।

শুধু সরি বললে হবে। পানি গরম করতে বলো। আমি আসছি। কফি –বানাতে বল, চিনি কম। আর সঙ্গে বিস্কুট থাকলে দিও। শুকনো বিস্কুট থাকলে ভালোটা আনিয়ে নাও।

জী স্যার।

সকালের চা পান সঙ্গে ফ্রি জ্ঞান বিতরণ। বিস্কুটটা ভাল হলে সকালের ব্যবহারের জন্য আবেগাপ্লুত হয়ে বলে ফেলবেন, আরে তোকে পছন্দ করি বলেই তো সকাল সকাল ঝাড়লাম। আর সকলের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে তোর রুমে এসেছি।

এবারের খোঁজ বেলা এগারোটায় কোনো মিটিং আছে কিনা? নিজের না থাক, অন্য দপ্তরের থাকলেও চলবে। কোন না কোন অজুহাতে তিনি সেখানে উঁকি মারবেন। মানুষ এখনও এত খারাপ হয়নি যে, একজন অফিসার উঁকি মারলে, তাকে ডাকবেন না।

আরে আসুন, আসুন

না থাক, আপনারা মিটিং করছেন।

আরে আসুন না, কি আর এমন মিটিং। আপনি থাকলে একটু কনট্রিবিউট করতে পারবেন। এই স্যারকে নাস্তা দাও।

কনট্রিবিউট কি করবেন, তা সবাই জানে। নাস্তা খাওয়ার উসিলায় দু’চারকথা বলা।

নাছোড়বান্দা ভাইজান এবার নিজের কাজে মন দেন। ডগ স্কোয়াডের কুকুর যেমন গন্ধ শুঁকে মাদক বের করতে পারেন, নাছোড়বান্দা ভাইজান তেমনি ফাইলের গতিবিধি দেখেই বুঝতে পারেন এতে কি আছে। যদি কোন ফাইল আসার আগেই তদবির আসা শুরু হয় তবে, বুঝতে হবে এতে কিছু আছে। আর যদি একবারেই তদবির না আসে তবেও কিছু সমস্যা আছে। স্বাভাবিক গতিতে ফাইল আসা, হালকা পাতলা তদবির – এগুলো না দেখেই স্বাক্ষর করেন তিনি। আর বাদবাকীগুলো থেকে শুরু হয় ধান্ধা।

আপনার ফাইলটা দেখলাম। আমি হতাশ ...

কেন স্যার?

কেন হতাশ হলাম, সেটা বের করুন। দেখি কেমন বুদ্ধি।

জুনিয়র কলিগ অনেকক্ষণ ঘাটাঘাটি করেও বুঝলো না কেন ভাইজান স্যার হতাশ হলেন।

বুঝলেন নাতো, এবার বুঝাই। এত সহজে যদি অনুমতি দিয়ে দেন, তো পার্টি আপনাকে গুণবে?

স্যার, নীতিমালা অনুযায়ী আমি তো কোন সমস্যা দেখছি না।

আপনার সে চোখ থাকলে তো দেখবেন। কেরানী যেভাবে ফাইল তোলে , সেভাবেই স্বাক্ষর করে উপরে তুলে দেন। আপনি কি পোস্ট অফিস?

স্যার, আপনি বড় অফিসার। আমি ফাইল তুলেছি, ভুল হলে সংশোধন করে দেন।

আপনি ভুল করবেন আর আমি সংশোধন করবো, পেয়েছেন কি?

স্যার, আমি অফিসার ছোট, আমার মাথা ছোট। আপনি অফিসার বড়, আপনার মাথায় ঘিলু বেশি, আমি যা লিখেছি পছন্দ হলে স্বাক্ষর করে দেন, না হলে কোন কোন জায়গায় সমস্যা আছে তা লিখে ফাইল ফেরৎ দিন।

নাছোড়বান্দা ভাইজান স্যার এবার খসখস করে লিখে দিলেন, আলোচনা করুন।

এটা কি হল স্যার। এতক্ষণ তাহলে কি করলাম।

আজ আমার মেজাজ খারাপ, আর একদিন আলাপ করবো।

এই আলাপের সূত্র ধরে আর একদিন মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করে ফেললেন নাছোড়বান্দা ভাইজান স্যার।

এদিকে, তার অফিস সহায়ক কেন্টিন থেকে খাবার আনার জন্য অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে। স্যার কি খাবে তার নির্দেশ অতি যত্ন সহকারে শুনতে হবে। একটু এদিক ওদিক হলে সর্বনাশ।

অবশেষে জানা গেল, তিনি আজ ডায়েট করছেন। কিচ্ছু খাবেন না।

তবে, কেন্টিনে যাও, লাউ রাঁধলে ভিন্ন কথা। আমার কথা বলে বিশ টাকার লাউ আনবে।

যদি লাউ না পাই।

না পেলে কেন্টিন থেকে ফোন দেবে, তখন বলব।

স্যার ফোনে টাকা নাই।

যাও, আমার চোখের সামনে থেকে যাও। লাউ পেলে খাব, না পেলে ডায়েট।

স্যার, আপনি কি কিটো ডায়েট করছেন?

আউট, গেট আউট।

নাছোড়বান্দা ভাইজান স্যারের মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। যতসব ফাজিল পোলাপান জুটেছে তার দপ্তরে।

লাউ পাওয়া গেছে। বিশ টাকার লাউ খেয়ে তার ক্ষুধা আরো বেড়ে গেল। ড্রয়ারে কিছু দামি বিস্কুট থাকে, গণ্যমান্য ব্যক্তি এলে বের করেন। বাধ্য হয়ে বের করলেন। খেতে খেতে খোঁজ নিলেন, তিনটায় কোন মিটিং আছে কিনা। নাই। হতাশ হয়ে আরো দু’টো বিস্কুট খেয়ে ফেললেন।

এই সময়টা একটু ঝিমানি আসে। টেলিফোন ডিরেকটরী নিয়ে বসলেন। একটা পুরানো অভ্যাস তিনি ধরে রেখেছেন। পরিচিত মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। কাকে কখন, কোন কাজে লাগে কে জানে। কেবল কাজের সময় ফোন করলে, মানুষ ভাবতে পারে, লোকটা স্বার্থপর। তাই তিনি কারণে অকারণে রুটিন করে ফোন করেন। তারপরও তিনি লক্ষ্য করেছেন, কাউকে ফোন করলে, যতক্ষণ কাজের কথা বলছেন না, ততক্ষণ অপরপক্ষের কোন তাড়া থাকে না। কিন্তু কাজের কথা তথা তদবির শুরু করলে তিনি বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কারো জন্য তদবির করতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু না করে পারেন না। লোকে এসে ধরে, ভাই অমুক আপনার বন্ধু। একটু বলে দেন। আপনি বললে কাজ হবে।

নাছোড়বান্দা ভাইজান বলেন। তিনি নাছোড়বান্দার মতোই বলেন। কারো কাজ হয়, কারো হয় না।

তার টেবিলে সিরামিকের তৈরি একটি কচ্ছপ আছে। সেটার গল্প দিয়ে শেষ করি।

দাপ্তরিক কাজে কক্সবাজার গেছেন। স্থানীয় অফিসের ইনচার্জে্র বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তিনি টিম লিডার। টিম মেম্বারবা কাজ করছে, তিনি ইনচার্জকে নিয়ে ঘুরছেন আর ঘুরছেন। বউয়ের পছন্দ, শালীর পছন্দ, বড় বসের পছন্দ মাফিক জিনিসপত্র কেনা হয়েছে। ইনচার্জ বিল মিটিয়েছেন। তার পছন্দ মতো কিছু নিতে বললেই তিনি বলেন, কোন শখ নাই রে ভাই। শেষে ইনচার্জ বললেন, স্যার আমার পছন্দ মতো একটা উপহার দেই। টেবিলে সাজিয়ে রাখবেন।

সিরামিকের তৈরি সুন্দর কচ্ছপ।

কচ্ছপ এমন নাছোড়বান্দা প্রানী, কামড় দিলে আর ছাড়ে না।

 

রহমান তৌহিদ
রম্য লেখক, ২১, লেক সার্কাস, কলাবাগান, ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top