সিডনী সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলের কবি-মানস : আবু আফজাল সালেহ


প্রকাশিত:
২৪ মে ২০২১ ২০:৫৫

আপডেট:
৬ মে ২০২৪ ০৪:৫১

 

‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘‘নবী’’,/কবি ও অকবি যাহা বল মোরে মুখ বুজেঁ তাই সই সবি!/...কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো, ফের যেন তুই যাস জেলে।/গুরু ক’ন তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাচাঁ।/প্রতি শনিবারই চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন তুমি, ‘‘হাড়িঁ চাচাঁ’’।/আমি বলি, প্রিয়ে ‘হাটে ভাঙ্গি হাড়িঁ-/অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।/সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা কন ‘‘আড়ি চাচা’’ ।/যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুজিঁ টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা।/মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘‘মোল্লারা’’ কন হাত নেড়ে,/‘‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।/...‘‘আমপারা’’  পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে।’/হিন্দুর ভাবে, ‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে।’/...প্রার্থনা ক’রো- যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,/যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!’’।  ‘‘আমার কৈফিয়ত’’ কবিতায় কবি নজরুলের মানস-চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। এই কবিতায় তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার চেতনতা, কবিতায় ফার্সি-আরবির ব্যবহার, বিভিন্ন ধর্মের তথাকথিত মোড়লদের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ পাওয়া যায়। কবি কবিতা-গান-গজল লেখেন সেটাও পাওয়া যায়। কবি যে জেল খেটেছেন, আবার এমন লিখলে জেলে যেতে হতে পারেন তার শঙ্কাও করেছেন। অন্যেদের চোখে তা দেখিয়েছেন। এত কিছুর পরেও তিনি মানবতাকে উচ্চে তুলে ধরেছেন। মানুষের গ্রাস যারা কেড়ে নেয় তাদের প্রতি অভিশাপ করেছেন। এস বিষয়গুলো আলোচনা করলেই কবির সাহিত্যকর্ম ও জীবনী আলোচনা করা সম্ভব হবে।

‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’। মানুষ যদি অন্তরাত্মকে না চেনে, অন্য ধর্মকে সম্মান করতে না শিখে নিজেকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ প্রমানের জন্য ব্যস্ত থাকে, তাহলে সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে না। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। কিন্তু আজকের বাংলার বাস্তবতা উল্টো ‘সবার উপরে ধর্ম সত্য মানুষ সেখানে নাই’! নজরুল এসবের অবসান চেয়েছেন। গড়তে চেয়েছেন একটি সুন্দর অসাম্প্রদায়িক-সমাজ; শোষণমুক্ত বিশ্ব। নজরুল তাঁর চারটি সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরাণের আলোকে। তাঁর সন্তানদের নাম যথাক্রমে কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। অসাম্প্রদায়িক নিদর্শন আর কী হতে পারে! মসজিদে গজল আর ইসলামী সঙ্গীত আর মন্দিরে শ্যামাগীতি; সমানভাবে জনপ্রিয়। বিশ্বের শীর্ষ দুধর্মেও অনুসারীদের কাছে ধর্মগ্রন্থের পরেই প্রিয় সঙ্গীত! ভাবা যায়! বিশ্বের আর কোন সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে বা আইডলের কাছে এমন হয়নি। ইসলামী সংগীত, হামদ ও নাতগুলো চমৎকার। হিন্দুদের জন্য রচিত শ্যামাসংগীতও দারুণ জনপ্রিয়।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২)। কবির অনুপম নিদর্শন বিদ্রোহী কবিতা। যেটি এ  কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্তি করা হয়েছে। এ কাব্যে বিদ্রোহী মনোভাব ফুটে উঠেছে। হিন্দু-মুসলমানদের ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘দোল-চাঁপা’ (১৯২৩) কাব্যে প্রেম ও বিদ্রোহ পাশাপাশি। অবশ্য নজরুলের অনেক কবিতায় এমন। যেন, 'এক হাতে বাঁকা বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য'।  ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গান’ কাব্যগন্থ দুটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়। ‘ছায়ানট’ ও ‘পুবের হাওয়া’ কাব্যগ্রন্থ দুটি ১৯২৫ সালে প্রকাশিত। ১৯২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে দৌলতপুরে আকবর খানের বাড়িতে থাকাকালীন কিছু কবিতা ছায়ানটে স্থান দেওয়া হয়েছে। শিশুতোষ 'চিরশিশু' কবিতাটি ছায়ানটে আছে। ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫) কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো বেশিরভাগই মানবিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত ‘ঝিঙে ফুল’ সাধারণত শিশুতোষ। শিশুদের উপযোগী ১৩টি ছড়া-কবিতা স্থান পেয়েছে। ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭)  ও  ‘সিন্দু-হিন্দোল’ (১৯২৮) কাব্যে প্রেম ও প্রকৃতি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ১৯২৯ সালে রচিত হয় দুটি কাব্যগ্রন্থ- ‘চক্রবাক’ ও ‘সন্ধ্যা’। চক্রবাকের বেশিরভাগ কবিতা প্রেম বিষয়ক। আর বিদ্রোহভাব ফুটে উঠেছে ‘সন্ধ্যা’ কাব্যের কবিতাগুলোতে। এ কাব্যের মতো ‘গ্রন্থে-লিখা’ (১৯৩০) কাব্যেও বিদ্রোহীমূলক কবিতার প্রাধান্য রয়েছে। ‘প্রলয় শিখা’ ১৯৩০ সালে প্রকাশিত অন্যতম কাব্যগ্রন্থ। ‘নতুন চাঁদ’ (১৯৪৫) ও ‘শেষ সওগাত’ (১৯৫৮) কাব্য দুটির বেশিরভাগ কবিতাও বিদ্রোহী ভাবের। কিছু অন্য কবিতাও আছে। ‘ঝিঙে ফুল’-র পর আর একটি শিশুতোষ কবিতাপ্রধান কাব্যগ্রন্থ ‘সঞ্চয়ন’ (১৯৫৫)। শিশুতোষ কবিতা-ছড়ায় ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এনেছেন নতুনত্ব। ‘ঝড়’ (১৯৬০) কম আলোচিত একটি কাব্য।

‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তুর্য’  বিদ্রোহী কবিতার এ ছত্রেই তাঁর প্রেম ও বিপ্লবের সহাবস্থানের কথা বুঝিয়েছেন। কাব্যের নামাকরণেও তা বুঝা যায়। বিদ্রোহী কবিতার ১৩৯ -ছত্রে প্রেম-বিদ্রোহ পাশাপাশিই চলেছে। আমি বিদ্রোহী, আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা ইত্যাদির মতো অসংখ্য অলংকার, চিত্রকল্পের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থে মোট বারোটি কবিতা আছে। সবগুলো কবিতাই হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যভিত্তিক। মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে লেখা কবিতাগুলো হচ্ছে- কামালপাশা, আনোয়ার, রণভেরী,শাত-ইল-আরব, খেয়াপারের তরণী, কোরবানি ও মোহররম। হিন্দু-ঐতিহ্যপ্রধান কবিতাগুলো হচ্ছে, বিদ্রোহী, ধূমকেতু, প্রলয়োল্লাস, রক্তাম্বরধারিণী মা ও আগমনী। এর মধ্যে কেন, সমস্ত কবিতার মধ্যে 'বিদ্রোহী' কবিতা পাঠকের হৃদয়ে অন্যরকম স্থান পেয়েছে। শিল্পগুণে অনন্য মাত্রা পেয়েছে। এই একটি কবিতা বিশ্লেষণ করতে গেলে, সাহিত্যের সব অনুসঙ্গ টানতে হবে। সাহিত্য রস-গুণ-অলংকরের প্রায় সব শাখা আলোচনা হয়ে যাবে। অনুপ্রাসের ছড়াছড়ি বিদ্রোহী কবিতায়। অন্ত্যানুপ্রাস,মধ্যানপ্রাসসহ ধ্বনি নিয়ে খেলেছেন নজরুল। কানে মধুর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন-(১)‘...আমি চল-চঞ্চল ঠমকি-ছমকি/পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি/ ফিং দিয়া দিই তিন দোল!/আমি চপলা-চপল হিন্দোল।/...আমি হোম-শিখা,আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,/আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।/...আমি সন্নাসী, সুর সৈনিক,/আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ স্মান গৈরিক;/...আমি ক্ষ্যাপা দূর্ব্বাসা, বিশ্বমিত্র-শিষ্য,/আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!’-(বিদ্রোহী)

অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবিতা লিখতে গিয়ে জুতসই উপমা, উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। কখনোও সরাসরি কখনও প্রতীকী হিসাবে সংশ্লিষ্ট শব্দ/উপমা ব্যবহারে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন নজরুল। কিছু কবিতাংশ তুলে ধরি-

(১) ‘‘কাল-বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার/তখনি রক্ত শোষে না’রে তার/দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্র চন্ড সুখে/’পুচ্ছ সাপটি’ খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে’’-(ধূমকেতু)
(২) ‘কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,/বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র!’-(মোহররম, উৎপ্রেক্ষা অলংকারের প্রয়োগ)
(৩) ‘(আজ) চারিদিক হতে ধনিক বণিক শোষণকারীর জাত/(ও ভাই) জোঁকের মতন শুষছে রক্ত কাড়ছে থালার ভাত’- (কৃষকের গান, সাম্যবাদী)
(৪) ‘যত শ্রমিক শুষে নিঙড়ে প্রজা,/রাজা উজির মারছে মজা’-( শ্রমিকের গান, সর্বহারা)অলংকারের যুতসই প্রয়োগ দেখা যায় নজরুলের অন্যান্য কবিতায়-
(৫) ‘... ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই/অসূর-পুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল ভাই!...হিংসুটে  ঐ জীবগুলো তাই নাম ডুবালে সৈনিকের,/তাই তারা আজ নেস্তা-নাবুদ, আমরা মোটেই হইনি জের!’- (কামাল পাশা)
(৬) ‘...হৈ হৈ রব/ঐ ভৈরব/হাঁকে, লাখে লাখে/ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে/লাল গৈরিক-গায় সৈনিক ধায় তালে তালে/ওই পালে পালে,...’-(আগমনী, অনুপ্রাসের প্রয়োগ, এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে তাঁর কবিতায়)

কবি নজরুল ভাবতেন মুক্তির জন্য ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প কোনও পথ নেই। 'ধূমকেতু' পত্রিকায় স্বাধীনতার দাবি আগেই করেছিলেন। ভারতবাসীকে স্বাধীনতার দাবি করতে উৎসাহিত করেন গানে, এভাবে-‘ আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ।/এই দুলালাম বিজয়-নিশান, মরতে আছি-মরব শেষ। 'ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ‘‘আনন্দময়ীর আগমনে’’  কবিতায়, ‘আর  কতকাল  থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/ স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।/দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা আসবি কখন সর্বনাশী?’

‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া’। মানুষের কল্যাণে ধর্ম সৃষ্টি। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে শোষণ-ত্রাসন সৃষ্টি করা হয় বলে কবি নজরুল মনে করতেন। বর্তমানেও একই অবস্থা বিরাজমান। কার্ল মার্ক্সের 'আফিম তত্ত্ব'-র মতো নজরুল বললেন, ‘কাটায় উঠেছি ধর্ম-আফিম নেশা,/ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা,/ভাঙি 'মন্দির', ভাঙি মসজিদ,/ভাঙিয়া গীর্জা গাহি সঙ্গীত-/এক মানবের এক রক্ত মেশা’-(বিংশ শতাব্দী, প্রলয় শিখা)। যেন সত্যেন্দ্রনাথের ‘কালো আর ধলা বাহিরে কেবল, ভেতরে সবার সমান রাঙা’-র মতো। আর একটা কবিতাংশের কথা উল্লেখই করা যায়। ‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,/আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করোনি প্রভু।/তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,/মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি।’  সাম্যবাদী কাব্যের ‘মানুষ’ কবিতায় স্রষ্টার প্রতি ‘ভুখা মুসাফির’-র আত্মকথন। কবি নজরুলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অত্র অঞ্চলের প্রধান দুটি ধর্মের অনাচার-অসাম্যের প্রতি সমান আঘাত হেনেছেন। মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের তথাকথিতদের ওপর আক্রোশ ঝরে পড়েছে কবিতার পরতে পরতে। তাঁর কবিতায় 'মানুষ'-ই মূখ্য উপজীব্য। অসাম্প্রদায়িক এমন সাহিত্যিক বিশ্বে বিরলই।  ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় বারাঙ্গনাদের সম্মানিত করেছেন নজরুল। ‘মা’ হিসাবেই মেনে নিয়েছেন। ‘কালের চরকা ঘোর,/দেড়শত কোটি মানুষের ঘাড়ে চড়ে দেড়শত চোর’  নজরুলের এমন বাণী প্রতিধ্বনিত হয় বঙ্গবন্ধু মুজিবের ‘সাড়ে সাত কোটি কম্বলের মধ্যে আমারটা কই’ বলার মধ্যেই। ‘ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর’। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় ভাঙা-গড়ার খেলা দেখিয়েছেন। আবার ‘‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’’ কবিতায় বলেন, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা,/ধ্বংসের বুকে হাসুক মা তোর/সৃষ্টি নব পূর্ণিমা।’  হিন্দুদের ঐতিহ্য ব্যবহার করে ধ্বংসের মধ্যে সৃষ্টির প্রার্থনা করেছেন কবি। ‘নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই’ অথবা ‘পীড়িতের নাই জাতি ও ধর্ম, অধীন ভারতময়, তারা পরাধীন, তারা নিপীড়িত, এই এক পরিচয়’  বলে স্বাধীনতা চেয়েছেন। শোষণ-পীড়িতের অবসান চেয়েছেন। ‘একতাই বল’ হিসাবে অগ্রসর হতে বলেছেন। ধর্মকে কেন্দ্র করে কোনও বিভাজন চাননি তিনি। বিভাজন থাকলে স্বাধীনতা বা অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়। কৃষকের চোখে নজরুল বলেছেন, ‘আজ জাগরে কৃষাণ সব ত গেছে, কিসের বা আর ভয়,/এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়’-(কৃষাণের গান)। এমন অভয় বাণী নজরুলের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব।

‘বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’। কবি বিশ্বকে মুঠোয় পুরে দেখতে চেয়েছেন। ‘সংকল্প’ কবিতার শেষ এমনই- ‘...হাউই চড়ে চায় যেতে কে/চন্দ্রলোকের অচিনপুরে;/শুনব আমি, ইঙ্গিত কোন/মঙ্গল হতে আসছে উড়ে।/পাতাল ফেড়ে নামব আমি/উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,/বিশ্বজগৎ দেখব আমি/আপন হাতের মুঠোয় পুরে’। বর্তমানের যুগ প্রযুক্তির যুগ। এক স্মার্টফোনে বিশ্ব ও আকাশ-পাতালের সবকিছুই সহজলভ্য। এখন  কোনকিছুই দূরের নয়। কবি নজরুল সেই কবেই ভেবে রেখেছেন এমন। শিশুতোষ ‘সংকল্প’ কবিতায় তা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কবি নজরুলের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নজরুলের পিতৃতুল্য, গুরুর মতো। কবিগুরুও নজরুলকে স্নেহ করতেন। প্রথম কারাবন্দি হওয়ার পর রবিঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। ‘গোরা’ নাটকের গানের গীতিকার রবীন্দ্রনাথ; সুরকার নজরুল। নজরুলও কিছু সাহিত্য রবিঠাকুরকে নিবেদিত করেছেন। ঘুরে বেড়ানোর সময় নজরুলের কাঁধের ব্যাগে ‘গীত বিতান’ থাকত বলে নজরুলের নাতি অরিন্দম কাজী সাক্ষাৎকারে বলেছেন। তিনি আরও বলেন, দাদু(নজরুল) ধুতি-পাঞ্জাবি পছন্দ করতেন। রঙিন চশমা দেখলে চঞ্চল হয়ে উঠতেন। আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, তাদের একে অপরের প্রতি বোঝাপড়া ভালোই ছিল। নাহলে এমন সম্ভব নয়। ১৯৪০ সালে কাজী নজরুল ইসলাম ‘আকাশ বাণী’ রেডিওতে শিশুদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। নবযুগ পত্রিকার প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সৈনিক হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কাজী নজরুল।

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাভাষার অন্যতম সাহিত্যিক বাংলাদেশের জাতীয় কবি কবিতা ও গান পশ্চিমবঙ্গসহ দুই বাংলাতেই সমানভাবে সমাদৃত। শিশু তরুণ বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের কাছে কবির লেখা সমান জনপ্রিয়। কবিতা ও গানে বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে, মানুষের প্রতি মানুষের অত্যাচার ও দাসত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। রবীন্দ্রবলয়ে থেকে নতুন এক যুগ সৃষ্টি করা সহজ নয়। নজরুল তা করতে সক্ষম হয়েছেন। গান শুনে যেমন বলা যায় এটা রবীন্দ্রনাথের, তেমনি নজরুলের গানের অংশবিশেষ শুনেই বলা যায় যে, এটা নজরুলের। কবিতার ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন। এবার কবির গানের সুরেই বলি,‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে...’। না, আমরা নজরুলকে ভুলি নাই, ভুলতে পারব না। নজরুল বেঁচে থাকুন বাঙালির হৃদয়ে। পাঠক-স্রোতার হৃদয়ে চির অম্লান তিনি।

 

আবু আফজাল সালেহ
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top