দুধ বয় : ড.ময়ূরী মিত্র 


প্রকাশিত:
২৭ মে ২০২১ ২০:২০

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৫ ০১:৫৫

 

দুধ বয়

ভোরেই জ্বলেছে উনুন। এক সসপ্যান দুধ ফুটছে। আর তাতে মলটোভা গুলছেন পিসিমনি। ওই দুধ ফোটা আর প্রাণপণ চামচ নড়ার শব্দে সকালবেলা আমার ঘুম ছাড়ত। উঠেই কী যে আনন্দ হতো আমার। দেখতাম কত না  -- নতুন মানুষে ভরেছে আমাদের ভাড়াবাড়ির ঘর!

হয়েছে কী ----আমার সেই শিশুকালে আমাদের বাড়িতে বাস করতেন ওবাংলা থেকে আসা অনেক কাকা অনেক পিসি। আমার ছোট্ট মাথায় সবার সব মুখ ধরে রাখতে পারতাম না। প্রায়ই এক কাকার শরীরে  অন্য কাকার মুখ বসিয়ে  ফেলতাম। রাতে ঘুমের ঘোরে আরো গোলাত সব। শরীরের ওপরের মুখ বা মুখের তলার শরীর।|  

দেশভাগ তখন লম্বা এক জোঁক হয়ে ঘুরছে দুদেশে। প্রতিদিন সীমা ডিঙিয়ে কেউ না কেউ এসেই যেত। ঘুমচোখে এপার ওপার সব ভুল হত। একটি বাড়িতে অনেক মানুষের ভিড় এত ভালো লাগত মনে হতো, সবাই কাকা পিসিরাই আজ বুঝি প্রথম এলেন বাড়িতে। আমার খোকাচোখ পুরনোকেও নতুন বানিয়ে ছাড়ত। বাচ্চা চাষীর ঝুড়িতে তখন কেবলই নতুন ফসল।  

ঠাকুরদা নিয়ম করলেন জলখাবার সবার একরকম হবে। মনে আছে, একটা প্রায় অন্ধকার প্যাসেজে সার দিয়ে কাকা পিসিরা অনেকখানি চিনিগোলা চায়ে বাসি রুটির গোছা চুবিয়ে খাচ্ছেন। কাপে চা কম থাকতো বলে একসাথে দুটো করে রুটি চোবাতেন। কাকাদের সমান খাবো বলে আমিও ঐরকম চায়ে চোবানো চারটে করে রুটি খেতে শুরু করলাম। ছোট্ট পেটটা আমার শক্ত বাতাবি লেবু হয়ে যেত। তবু ভারী লজ্জা "বেবি দুধ" খাওয়ায়। সেটা কতটা দুধ খাব না বলে আর কতটা খাদ্যব্যবস্থায় সাম্য আনব বলে তা বলতে পারি না। তবে সসপ্যানের সব দুধ আমার গর্ভে গেলে কাকাদের চায়ে যে দুধ মোটেই পড়বে না সে বেশ বুঝতাম।  

ভাড়াবাড়ির তিনটে মাত্র ঘরে অনেক মানুষের সাথে ঠেসে থাকতে থাকতেই ভালোবাসা চেনা শুরু হলো আমার। সেবার ক্লাসে পড়া পারিনি বলে খুব মার দিলেন আমার এক ওবাংলার পিসি সুতপা। সবে খুলনা থেকে কলকাতায় এসেছেন। ভালো চেনা না হলেও ভালোবাসাটা দ্রুত হয়ে গিয়েছিল আমাদের। মার খেয়ে সারাদিন আমি কথাই বলিনি পিসির সাথে। দিনভর গজগজ করছিলাম নিজের মনে। সন্ধেতে শুনেছিলাম সমস্তটা দিন জল অব্দি খাননি সুতপা। রাতে মা খাবার সাজিয়ে দিলেন আমাকে আর পিসিকে। পরিষ্কার শুনলাম পিসিকে বলছেন, "বেশ করেছিস। আবার পড়া না পারলে আবার মারবি।" 

রাগী মুখে সুতপার দিকে আড়ে দেখতে দেখতে খেয়ে যাচ্ছি গপাগপ। বোধহয় সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছেন কলকাতার পিসি অপর্ণা  -- এসে বসে গেছেন আমাদের পাশে। কী যেন একটা লুকিয়ে রেখেছেন না পিঠের দিকে ? মারামারি করে দেখলাম --- MA ক্লাসের দিস্তা নোটের খাতায় আমার জন্য লিখে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের ভাবসম্প্রসারণ। কাল যা ক্লাশে মুখস্থ বলব আমি। 

আর তারপর? সুতপা আর অপর্ণা তাঁদের চারটে হাত ক্রস করে ফেলেছেন। ভাবছি কী বানাবেন এঁরা জোড়া জোড়া হাতে? ওমা!  এ যে দেখি একটি হাতপালকি। ব্যাস! হাতগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পা গলিয়ে আমি উঠে পড়লাম আমার পালকিগাড়িতে। ওঠবার স্টাইল দেখে তখনকে বলবে সেটা পালকি না পক্ষীরাজ! পালকি তখন ঘোড়ার গতিতে ছুটেছে ! টগবগ টগবগ! এদেশ। সেদেশ। নানাদেশ। কত দেশ –কত্ত।

পিসীমায়ের একটি দীপে আলোয় ভর্তি ভূখণ্ড। সীমানা ছাড়ায়ে। দুকূল হারায়ে। প্লাবিত।  

★ ★ বিশ্বকবি  ---লেখাটি  তোমায় দি?  তুমিই তো বেশি কেঁদেছ, বাংলা যাতে ভাগ না হয়। সে নিরুচ্চার কান্না টের পাই। তাই তোমাকেই। 

★★ আছে এক পুনশ্চ: যে সব কীর্তিমান বাবা মা মানুষভরা পরিবার ভেঙে বাচ্চার মনমগজের দফায় রত তাঁদের "ভিষম দরকারি" ঠোক্করটাও মারলাম।

 

পুষ্পগন্ধে 

গোলাপ পদ্ম ---পলাশ ডালিয়া-- কিছুটি নয়। আমাকে টানে বকুল | আমার চোখ নাক -- প্রাণমন শুষে নেয় একেবারে। তখন আমরা বেলগাছিয়ার ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। বাড়ির কাছেই ছিল লেডিজ পার্ক। সেই পার্কটি ছিল বকুল গাছে ভর্তি।

খুব ভোরে ঠাকুরদা আর পিসির সাথে গিয়ে রাশি রাশি বকুল জড়ো করতাম। তারপর বাড়ি ফিরে সেই বকুল দিয়ে ঠাকুরের মালা গাঁথা। ঠাকুর দেবতায় তো কোনোদিন মনমতি নেই আমার। কিন্তু ছেলেবয়সে বকুলের মালা গাঁথতে বসে কেমন একটা বাড়তি মনোযোগ আর নিষ্ঠা আসতো আমার। আমার এই বকুলপ্রেম দেখে কলেজজীবনে জুটে যাওয়া বান্ধবের দল কত যে হাসাহাসি করতো!   

একদিন এক বন্ধু কলাপাতায় বেশ কিছু বকুল এনে আমায় উপহারও দিয়ে ফেললে। সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল বলে বকুলগুলো তার ভিজে গিয়েছিলো। ভেজা বকুল বাস ছড়াচ্ছিলো আর আমারও তার প্রতি প্রেমের ঝোঁক তীব্র হচ্ছিলো। গন্ধ মৃদু তো প্রেমেরও ছুটি। 

বকুল মত্ততা একবারে তুঙ্গে উঠেছিল বিয়ের বাজার করতে গিয়ে। বায়না ধরলাম বকুল রঙেরই বেনারসি চাই। বহু খুঁজে মা সেই বকুলরঙা বেনারসিতেই সাজিয়েছিলেন তাঁর উন্মাদিনী কন্যাকে। রঙটা আজো মনে ধরে আছে আমার। বেনারসির ভেতরটা বকুল চন্দনে মাখামাখি --- পাড়টা রাঙা জবা। 

বকুল প্রেম পাকাপাকি হল। ঠাকুরদা একটি বকুল গাছ পুঁতলেন আমাদের সল্টলেকের বাড়িতে। আঙিনার সেই গাছ বড় হয়েছে। বাদলে চক্কর মেরে দীর্ঘ হয় বকুলগন্ধী বাতাস। আমার প্রিয়র সেই বিস্মৃত শ্বাস।

 

ড.ময়ূরী মিত্র 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top