সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

শিকার : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
১৬ জুন ২০২১ ২১:৪০

আপডেট:
১৯ মার্চ ২০২৪ ১৩:৪৫

 

পূর্ণিমার রাত। ছোট নদীটা সাঁতরে এপারের ঘন জঙ্গল পেরিয়ে বন সংলগ্ন রাস্তায় এসে থামে। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে নিঃশব্দে নেমে আসে মাছের ঘেরের কাছে। ঘেরের মাঝখানে টং ঘরে যাওয়ার জন্য দুটো বাঁশ দেয়া আছে। কয়েক গজ সামনেই শিকার রয়েছে।বাঁশের গোড়ায় এসে টুপ করে বসে পড়ে। খুব নিঃশব্দে। কেবল চকচকে চোখ দুটো স্থির হয়ে থাকে টং ঘরের চৌকিতে জ্বলতে থাকা লাল আলোটার দিকে।
রাসেল। বয়স পঁচিশ হবে। ঢাকায় একটা ছোট চাকরি করতো। করোনা সংকটের মধ্যে তার চাকুরিটা চলে যায়। মাস তিনেক বহু চেষ্টা করেও চাকরি জোটাতে পারেনি। ফিরে আসে নিজের শহর খুলনাতে। বেশ কমাস বসে থাকার পর সুন্দরবন সংলগ্ন এই প্রজেক্টে কাজ পেয়েছে।
রাসেলের আজকে ডিউটি পড়েছে প্রজেক্টের শেষের অংশে একেবারে বনের কাছাকাছি। প্রথম দিকে একটু ভয় ভয় লাগতো। এখন অতটা লাগে না। মাঝে মাঝে যে লাগেনা তা কিন্তু নয়। কারণ ইদানীং বাঘের উৎপাত একটু বেড়েছে। আজ এর বাছুর তো কাল ওর ছাগল। বলা যায় না কখন আবার মানুষের ঘাড়ে এসে পড়ে। ম্যানেজার মিজান সাবধান করে দিয়েছে। কোন ভাবেই যেন টং ঘর থেকে বাইরে বের না হয়।
চাঁদের আলোয় চার দিকটা ঝলমল করছে। চাঁদের আলো পানিতে পড়ে চিকচিক করছে। কেমন মায়াবী পরিবেশ। বাড়িতে রেখে আসা পারুলের কথা খুব মনে পড়ছে। নতুন বৌটাকে নিয়ে যদি এখানে থাকতে পারতো! পারুলকে ফোন দেয়। দুজনে গল্পে ডুবে যায়। পারুল চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে চায়। রফিক ফোন টা নিয়ে ভিডিওতে দেখাতে থাকে। ফোন টা সামনের দিকে নিতেই দেখতে পাই স্থির তাকিয়ে থাকা দুটো জ্বলজ্বলে চোখ।
শ্যামল এই বনের ধারের গাঁয়েরই ছেলে। ঘেরের মাছ বড় হবার পর এই সময়টা এই এখানেই থাকতে হয়। বাড়িতে যাওয়া নিষেধ। আজও সবিতা ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করছিল। ছেলেটার নাকি জ্বর। বারবার সাহেবকে বলে ছুটি নিয়ে দুদিনের জন্য বাড়িতে যেতে বলেছে। দেখি কাল ম্যানেজারকে বলে। ছেলেটার জন্য যদি ছুটি দেয়। ভাবে শ্যামল।
অনেক রাত হয়ে গেছে। তাও ঘুম আসছে না ওর। ছেলেটার জন্য বেশ চিন্তা হচ্ছে। উঠে বাইরে এসে দাঁড়ায়। পূর্ণিমার আলোয় সব কেমন ফকফকা। গা টা কেমন ছমছম করে ওঠে শ্যামলের। বনের ধারের মানুষ। বিপদের গন্ধ টের পেয়ে যায়। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে দাঁ টা হাতে নিয়ে বের হয়। রাসেল একা আছে জঙ্গলের কাছাকাছি। একটু চক্কর মেরে আসি। ভাবে শ্যামল।
সতর্ক হয়ে চলছে সে। চারিদিকে পরিস্কার সব। বেশ দূর থেকেই চোখ আটকে যায় শ্যামলের।রাসেলের টং ঘরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা হলুদ প্রানীটায়। পা আঁটকে যায় মাটিতে। নিঃশব্দে পিছু হটতে থাকে। নিরাপদ দুরত্বে থেকে হালকা একটা শিষ দেয়। সতর্ক হয়ে যায় ঘেরের সব শ্রমিক। বুঝতে পারে বিপদ আসছে।
আগে থেকেই নির্দেশনা দেয়া আছে। যে যার মতো লাঠি সোটা নিয়ে ঘরের বাইরে আসে। শ্যামল ইশারায় বুঝিয়ে দেয় কি করতে হবে। রাসেলকে বাঁচাতেই হবে ক্ষুধার্ত বাঘিনীর হাত থেকে। দলবেঁধে ওরা নিঃশব্দে এগিয়ে যায়।
রাসেলের হাত থেমে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মুহূর্তেই চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসে। বাঁশের গোড়ায় বসে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। দৃষ্টি এই ঘরের দিকে। মাথা নীচু করে ফেলে সে। হাত যেমন ছিল তেমন রাখে শক্ত করে। দোয়া দরুদ পড়তে থাকে। বাঁচার কোন উপায় নেই। নিশ্চিত মৃত্যু।
শেফালির মুখটা ভেসে ওঠে। শেফালি কি বাঘটাকে দেখেছে? ও তো ভিডিওতে দেখাচ্ছিল চারপাশটা। একবার ভাবে শেফালির সাথে শেষ বার একটু কথা বলে নিই। পরক্ষণেই সে চিন্তা বাদ দেয়। মরার মতো পড়ে থাকে। আর আল্লাহকে মনে মনে ডাকতে থাকে। এরমধ্যে হালকা শিষের শব্দ ওর কানে আসে।
তাহলে প্রজেক্টের মানুষ টের পেয়ে গেছে।
চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকে ও। এক সেকেন্ড কেও মনে হচ্ছে এক ঘন্টা। হঠাৎ বাঘটা উঠে দাঁড়ায়। সামনে এগোনোর জন্য পা বাড়াতেই একটা দাঁ এসে গায়ে বাড়ি লেগে সামনের পানিতে ঝপ করে পরে।
রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে গর্জন করে ওঠে বাঘিনী। সারা এলাকা কেঁপে ওঠে। রাসেল জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হাতের ফোনটা বেজেই চলে। শেফালী অনর্গল ফোন দিয়েই চলেছে।
লাঠি সোটা নিয়ে সবাই এগিয়ে আসে। বাঘিনী পিছু হটে যায়। ঘুরে জঙ্গলের দিকে চলে যায়। পানি সাঁতরে ওপারে চলে যায়। দুটো বাচ্চা নদীর ওপারে চুপ করে বসে ছিল গাছের আড়ালে। ক্ষুধায় কাতর বাচ্চাদুটো। খালি মুখে মা কে ফিরে আসতে দেখে। ক্লান্ত পায়ে মাকে ফিরতে দেখে। মায়ের সাথে সাথে বাচ্চাদুটোও চলে যায় গহীন বনে।
শ্যামল দৌড়ে টং ঘরে যেয়ে ঢোকে। দেখে রাসেল অজ্ঞান হয়ে আছে। চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতেই চোখ মেলে তাকায়। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
তাড়াতাড়ি চলো।
ক্ষুধার্থ বাঘিনী। আবারও ফিরে আসতে পারে।
রাসেল টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়। বাঁশের সেই জায়গায় এসে থামে। যেখানে কিছুক্ষণ আগেই বাঘটা ছিল। সাক্ষাৎ যমদূত। এখান থেকে এক লাফই যথেষ্ট ছিল বাঘের। সবাই তাদের ঘরে ফিরে আসে। এরমধ্যে গ্রামের বেশ কিছু লোকজন এসে হাজির হয় প্রজেক্টে। সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেয়, আজ রাতে পাহারায় থাকতে হবে। আর কাল বিকেলের আগেই একটা ছাগল বেঁধে রেখে আসতে হবে জঙ্গলের ঐ দিকটায়। নিশ্চিত ফিরে আসবে আবার সেই বাঘটা।
রাতটা নির্ঘুম কাটে সবার।
সকাল বেলা নদীর ধার দিয়ে আসা নৌকার মাঝিরা দেখেছে বাঘের পায়ের ছাপ। সাথে ছোট ছোট পায়ের ছাপ চলে গেছে জঙ্গলের দিকে। বনের ধারের এই এলাকার মানুষের অবস্থা খুব বেশি ভালো না। অভাবি সংসার সবার। ছাগল দিতে কেউ রাজি হয় না। শ্যামল তার বৌ কে ফোন দেয়। বলে, তার একটা ছাগল দিতে। বৌ প্রথমে রাজি হয় না। বলে,ছেলাডার অসুখ। টাকা পয়সাও নাই। এই হাঁটে ছাগলডা বেঁইচা পোলাডারে ভালো ডাক্তার দেহাবো ভাবছিলাম।
তুমি চিন্তা কইরো না বৌ। একটা উপায় হবে। মানুষের জানের চাইতে তোমার ছাগল বড় হইলো।

প্রজেক্টের ম্যানেজার পিছনে দাঁড়িয়ে শ্যামলের সব কথা শোনে।
চিন্তা কইরো না শ্যামল।
স্যারে কইছে তোমার ছাগলের দাম দিয়া দিব। সাথে তোমার ছেলের চিকিৎসার খরচের জন্য টাকাও দিব।
তোমার জন্য রাসেলের জীবন বাঁচছে। তুমি যদি সাহস নিয়ে কালকের রাতে না যাইতা তাহলে কি হইতো কওতো। খুশিতে চকচক করে ওঠে শ্যামলের চোখ।
স্যার কয়দিন খুব সাবধানে থাকতে হইবো কইল।
একা একা কেউ জানি ঘুরাঘুরি না করে।
স্যার আপনি সবাইরে কইয়া দেন।

ছাগলটা নদীর এপারে জঙ্গলের ধারে বেঁধে রাখা হয়ছে।
সবাই সতর্ক হয়ে আছে।
সময় যায়।সবার চোখ ঢুলুঢুলু।
হঠাৎ ছাগলের তীব্র চিৎকার। সাথে সাথে ক্ষুধার্থ বাহিনীর গর্জন শোনা যায়।
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
কেঁপে ওঠে সমস্ত এলাকা।
শিকারী বাঘিনী শিকার মুখে নিয়ে সাঁতরে নদীটা পার হয়ে বনে ঢুকে যায়।
মায়ের মুখে খাবার দেখে বাচ্চাদুটোর চোখ চকচক করতে থাকে। মায়ের পাশে পাশে চলতে চলতে ঢুকে যায় বনের গভীরে।

সকালে গ্রামের সবাই সেই জায়গায় যেয়ে ছোপ ছোপ রক্ত দেখতে পাই।
বাঘের পায়ের ছাপ তখনও নরম কাঁদায় স্পষ্ট দেখা যায়।
ছোটটা একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয় শ্যামলের বুক থেকে। নিজের পোষা অবলা প্রানীটা বাঘের শিকারে পরিনত হলো।



শাহানারা পারভীন শিখা
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top