সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

দুর্যোধন পান্ডবদের আগে স্বর্গে পৌঁছেছিলেন কেন? : অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ


প্রকাশিত:
১৬ জুন ২০২১ ২১:৪৯

আপডেট:
১৯ মার্চ ২০২৪ ০৯:৪৭

 

দুর্যোধন আজীবন অধার্মিক, অত্যাচারী, নিষ্ঠুর, স্বজন বিরোধী, দাম্ভিক ও দুর্বিনীত। এমনটাই আমরা বরাবর জেনে এসেছি। তাহলে, মনুষ্যেত্তর কোন্ গুনে তিনি পান্ডবদের আগেই স্বর্গে পৌঁছে ছিলেন? প্রশ্নটা বরাবর মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। অবশেষে এর উত্তর পেলাম কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে।

কৌবর পক্ষে একে একে প্রধান মহারথীগণ নিহত হওয়ার পর যখন দুর্যোধন প্রবল আশঙ্কার মধ্যে প্রহর গুনছিলেন। সেই সময়, কৃপাচার্য দুর্যোধনকে বলেছিলেন, ‘হে রাজন! তুমি এবার ওদের সঙ্গে সন্ধি করো। আমার মনে হয় কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের বাক্য লঙ্ঘন করতে সমর্থ হবেন না। হে মহারাজ! আমি দীনতা বা প্রাণরক্ষার নিমিত্ত একথা বলছি না। একথা তোমার হিতকর বলেই বলছি।’

দুর্যোধন বললেন, ‘হে আচার্য! আপনি পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে যুদ্ধ করেছেন, এখনো বন্ধুজনোচিত বাক্যই বলছেন, কিন্তু আমি কীরূপে এ কাজ করতে পারি! আমি আপনার বাক্য শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়েও বলছি, পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করা উচিত নয়, যুদ্ধ করাই শ্রেয়। দেখুন, আমি বহুবিধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান, ব্রাহ্মণগণকে প্রভূত দক্ষিণাদান, বেদাধ্যয়ন ও বিপক্ষগণের শীর্ষস্থানীয়রূপে অবস্থান করেছি। আমি যা চেয়েছি সবই পেয়েছি। আমার ভৃত্যগণ অতি সুখে প্রতিপালিত হয়েছে। আমি দুঃখীদের দুঃখ দূর করেছি, স্বরাজ্য প্রতিপালন, ভোগ্যদ্রব্য উপভোগ এবং ধর্ম-অর্থ-কামের সেবা করেছি। ক্ষত্রিয়ধর্ম ও পিতৃঋণ থেকেও আমার মুক্তিলাভ হয়েছে। এই পৃথিবীতে কিছুতেই সুখ নেই। কেবল কীর্তিলাভ করাই লোকের কর্তব্য। আমি ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়গণ গৃহমধ্যে রোগভোগ করে মরতে চায় না। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুই আমার কাম্য।

তদ্ব্যতীত, আমার জন্য নিহত পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, মহাবীর জয়দ্রথ এবং কর্ণ, যে আমার কথা ভেবে পৃথিবীর ঐশ্বর্য ও কৃষ্ণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁদের কথা আমি কী করে ভুলতে পারি? কতো অবনীপাল আমার জন্য যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের নিকটও আমি বহুরূপে ঋণী। 

সেই কৃতজ্ঞতার শোধ কি আমি নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে তাঁদের দিতে পারি? যুদ্ধক্ষেত্রে আমার প্রাণ দিয়েই আমি ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করে তাঁদের সঙ্গে মিলিত হতে চাই।’

আচার্যপুত্র অশ্বত্থামা বললেন, ‘শুনুন, পণ্ডিতেরা স্বামীভক্তি, দেশকালাদি সম্পত্তি, রণপটুতা ও নীতি এই কয়েকটিকে যুদ্ধের সাধন বলে নির্দেশ করেছেন। আমাদের যেসব দেবতুল্য লোকপ্রবীর মহারথগণ নীতিজ্ঞ, রণদক্ষ, প্রভুপরায়ণ, ও নিয়ত যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁরা কেউ যুদ্ধের দ্বারা পরাজিত হননি। পাণ্ডবরা তাঁদের পিছন থেকে লুকিয়ে হত্যা করেছেন।'

কর্ণ দরিদ্র ও দুঃস্থ মানুষদের কাছে কল্পবৃক্ষ স্বরূপ ছিলেন। যাচকদের কখনোই প্রত্যাখ্যান করতেন না। সাধু ব্যক্তিরা তাঁকে সৎপুরুষ বলে অতীব শ্রদ্ধা করতেন। কর্ণ কৃষ্ণেরও বন্ধু ছিলেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও কৃষ্ণ তাঁকে ধর্মচ্যুত করতে পারেননি। দুর্যোধনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি। এই সততা কুরুপক্ষের সকলের মধ্যেই বর্তমান ছিলো। দুর্যোধন নিজে একজন বিশেষ মানুষই ছিলেন। তাঁর পক্ষের রাজাগণ এবং সৈন্যগণ তাঁর প্রতি সেজন্যই এতো একনিষ্ঠ ছিলো।

 

তিনি যুধিষ্ঠিরের মতো যুদ্ধের মধ্যে আরামশয্যায় শুয়ে বসে দিন কাটাননি। অবিশ্রান্ত যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকেছেন। পিতৃবৎসল, মিত্রবৎসল, প্রজাবৎসল—এসব গুণ তাঁর মধ্যে প্রভূত পরিমাণে ছিলো। একটি মিথ্যাবাক্যও তিনি উচ্চারণ করেছেন এমন ঘোষণা বিদুরও করতে পারেননি।

যেদিন কর্ণ অন্যায়যুদ্ধে অসহায় অবস্থায় নিহত হলেন, সেই সময়ে যুধিষ্ঠির তাঁর সুবর্ণময় উত্তম শয্যায় শুয়ে আলস্য যাপন করছিলেন। সহর্ষে অর্জুন ও কৃষ্ণ প্রবেশ করলেন। তাঁদের মুখ দেখেই যুধিষ্ঠির বুঝতে পারলেন কর্ণকে তাঁরা নিহত করতে পেরেছেন। তাঁর মুখে উত্তেজনার ভাব ফুটে উঠলো। তিনি গাত্রোত্থান করলেন। শুভসংবাদ অবগত হলেন। কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে তিনি কর্ণের মৃতদেহ দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে সমরক্ষেত্রে এসে দাঁড়ালেন। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘এর কথা ভেবে আমি ভয়ে তেরো বৎসর ভালো করে ঘুমোতে পারিনি। আজ সুখে নিদ্রা যাবো।’

কর্ণের মৃত্যুর পরে পাণ্ডবরা নিজেদের নিরাপদ বোধ করছিলেন। 

 

শ্রীকৃষ্ণের শঠতা ও মিথ্যাচারেই অর্জুনের মতো মহাযোদ্ধা একবারের জন্যও রণক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতার প্রমাণ রাখার অবকাশ পাননি । ভীষ্ম-দ্রোণ -জয়দ্রথ-ভূরিশ্রবা-কর্ণ কারো সঙ্গে তাঁকে সরাসরি যুদ্ধ করতে দেননি বাসুদেব। প্রত্যেককে যুদ্ধ ছাড়াই পিছন থেকে অতর্কিতে অথবা অসৎপন্থায় নিহত করিয়েছেন। যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণর এই অন্যায় কুকর্ম অব্যাহত ছিলো।

শ্রীকৃষ্ণ এরূপে তাঁর ভগবান- স্বরূপতা ও ধর্ম  পালন করে আমাদের যুদ্ধ জয়ের রণকৌশল শিখিয়েছেন। মাতা গান্ধারীর অভিশাপে শ্রীকৃষ্ণের যদুবংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং শ্রীকৃষ্ণের শেষ পরিণতিও হয়েছিল মর্মান্তিক। একথা মহাভারতের ইতিহাস।

যুদ্ধের শেষে সেই শ্মশানভূমির একাকিত্বে অশক্ত শরীরে দুর্যোধন যাপন করেছিলেন জীবনের শেষ ত্রিশ ঘন্টা। জঙ্ঘাস্থি ছিল স্থানচ্যুত।

সেই যন্ত্রণা তিনি কতক্ষণ ভোগ করেছিলেন জানা নেই। একসময় তার নিম্নাঙ্গ নিশ্চয়ই অবশ হয়ে গিয়েছিল। চলৎশক্তিহীন অসহায় মুমূর্ষু দুর্যোধন সেই দুর্জয় শীতেও আকণ্ঠ পিপাসায় একটু জলের জন্য হাহাকার করেছিলেন। কেউ শোনেনি। বহু ক্লেশের মধ্যে দিয়ে দুর্যোধন জেনেছিলেন জীবনের মর্ম তত্ত্ব।  মৃত্যুর সঙ্গে সংঘর্ষে তার জীবনী শক্তি যখন আর প্রায় কিছু অবশিষ্ট নেই, তখন এলেন অশ্বত্থমা । প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দুর্যোধন শুনলেন গুরুপুত্রের ভীষণ প্রতিজ্ঞা।  যন্ত্রণাদগ্ধ ক্ষীণ কণ্ঠে নিষেধ করেছিলেন তিনি,  'না.... অশ্বত্থমা....

না।' তার  অহংকারের হর্ম তখন চুরমার হয়ে ধুলোয় মিশে গিয়েছিল। কোনো অহংকার তখন আর অবশিষ্ট ছিল না। পান্ডবদের সঙ্গে সমস্ত বৈরিতা তখন অন্তর্হিত ‌। প্রহরকাল এর মধ্যে অশ্বত্থমা হাজির করলেন দ্রৌপদীর পাঁচ কিশোর পুত্রের ছিন্নমূন্ড। নীরন্ধ্র অন্ধকারেও দুর্যোধন স্পর্শ করেই আর্তনাদ করে উঠেছিলেন।

গুরুপুত্রকে বলেছিলেন, 'একি করলে গুরুপুত্র? ওরা যে আমার উত্তর পুরুষ।' 

ভোররাতে দুর্যোধনের পরিজন এলেন শেষ দর্শনে। মাতা গান্ধারীকে দেখে দুর্যোধন বলেছিলেন, 'তোমার জন্যই বোধহয় আমি অপেক্ষায় ছিলাম মা। তোমার পায়ের ধুলো আমার মাথায় দিয়ে এবার পাপী পুত্রের জননী হবার কলঙ্ক থেকে মুক্ত হও তুমি। আর পাপিষ্ঠকে যদি মার্জনা করতে পারো, তাহলে আশীর্বাদ করো, আগামী জন্মে আবার যেন তোমায় মা বলে ডাক আর সৌভাগ্য হয়।' 

পুত্রের দুরবস্থায় আজীবন ধর্মচারীরও হৃদয় টলে গিয়েছিল। জ্বলে উঠেছিল প্রতিশোধের আগুন। মায়ের অগ্নি মূর্ত্তি প্রত্যক্ষ করে মুমূর্ষু দুর্যোধন চিৎকার করে বলে উঠলেন,  'না মা না, তুমি পান্ডবদের অভিশাপ দিও না। ওরা যে তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার আর কোন দ্বিধা নেই মনে। আমাকে শেষ যাত্রার অনুমতি দাও। আর দেখো সে যাত্রা যেন পান্ডবদের সমাধির উপর দিয়ে না যায়।'

অন্তিম লগ্নে তিনি অন্তর থেকে মার্জনা করেছিলেন পান্ডবদের।‌ তাই তার স্থান হয়েছিল মানবাকাঙ্খিত অমৃতলোকে।।

 

অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top