সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

ও ঢেউ খেলে রে : রহমান তৌহিদ


প্রকাশিত:
১০ জুলাই ২০২১ ২০:২০

আপডেট:
১০ জুলাই ২০২১ ২০:৪৬

 

শৈশবে একবার বন্যার পানিতে ডুবে যেতে যেতে বেঁচে গিয়েছিলাম। নানীবাড়ির উঠানে পানি চলে এসেছিল। সেটা উনিশ শো একাত্তর। মুরব্বীদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনতে শুনতে এ কথা জেনেছি। আমার স্মৃতিশক্তি প্রখর নয় অথবা সে বয়সের কথা আমার মনে থাকার কথা নয়। ভুলেই গিয়েছিলাম। করোনার তৃতীয় ঢেউ কেন যেন স্মৃতিকে উসকে দিল। আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলাম, আমি ডুবে যাচ্ছি - আমার বোন মাথার চুল ধরে আমাকে টেনে তুলছে। এভাবে চুল ধরে অনেককে অনেকে পানিতে ডোবার থেকে রক্ষা করেছে।

পিতার চাকরিসূত্রে শৈশবে আমরা যে মহকুমা শহরে বাস করতাম সেখানে একটা মরা নদী ছিল। সেটাতে স্রোত ছিল না। তবে নদীর জল দাপিয়ে সাঁতার কাটাতে কোন বাঁধা ছিল না। এরপর চলে এলাম এক থানা সদরে। এখানে নদীতে জোয়ার ভাটা খেলে। ঢেউও আছে ছোট ছোট। বড় বড় নৌকায় করে মালামাল আসে। নানীবাড়ী যাওয়ার পথের একটা অংশ যেতে হয় লঞ্চে করে। একবার এক ঘোর বর্ষায় লঞ্চে চড়েই নদীর ঢেউ সত্যিকার অর্থে অনুভব করলাম। তখন ছোট ছিলাম , তাই ছোট ঢেউও ভয়ঙ্কর লেগেছিল।

এরপর ঢেউ সম্পর্কে আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করলো নজরুলের সেই বিখ্যাত গান ‘পদ্মার ঢেউ রে, মোর শুণ্য হৃদয় ...।’ নদীর ঢেউয়ের সাথে নৌকা, লঞ্চ চলাচলের অসুবিধা, পাড় ভাঙ্গার সমস্যা, পলিমাটি জমা ইত্যাদির সম্পর্ক পর্যন্ত নির্ণয়ের জ্ঞান তখন আমার ছিল। এই শুণ্য হৃদয়ের ব্যাপারটা কেবল বুঝতে শুরু করেছি।

যাহোক স্কুলের উচু ক্লাসে উঠে কবিতা আবৃত্তির ভুত যখন মাথায় চাপলো, তখন কন্ঠের উঠানামা অর্থাৎ ঢেউ বিষয়টি একটু বোধের মধ্যে এল। খেলার মাঠে দর্শকের ঢেউ, গানের আসরে শ্রোতার ঢেউ আর ফসলের মাঠে শস্যের ঢেউ সবই উপভোগ্য মনে হল।

এসময় মহকুমা সদরে বিজ্ঞান মেলায় তিন সদস্যের স্কুল টিমের নেতৃত্বের সুবাদে  নতুন ঢেউয়ের সাথে পরিচিত হলাম। থানা সদরে আমরাই সেরা ছাত্র। কেউ আমাদের ঘাটাতো না। মহকুমা সদরে বিজ্ঞান মেলার স্টলে নানা প্রশ্ন। বয়েজ স্কুলের ছাত্রদের উদ্দেশ্য উত্যক্ত করা। গায়ে পড়ে ঝগড়া করার বিষয়টি সেই বুঝলাম। জ্ঞানী হওয়ার চেয়েও কৌশলী হওয়া যে বেশি প্রয়োজন সেটা তখন শিখেছিলাম। তারপর ছিল গার্লস স্কুলের মেয়েদের ন্যাকান্যাকা প্রশ্ন। তাদের প্রশ্ন শুনলে নিউটন, আইনস্টাইন পর্যন্ত ঘাবড়ে যাবে। আমাদের এক বন্ধু তো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে তাদের চুলের ঢেউ বিশ্লেষণ করতে শুরু করে দিল। একটু পরে দেখি হাসির ঢেউ। বুঝলাম বাংলাদেশে বিজ্ঞান কিভাবে আহত ও নিহত হয়। যাহোক, সেই ঢেউ নিয়ে মাতামাতি করা বন্ধুটিসহ বিকেলে গিয়েছি মহকুমা সদরের বইয়ের দোকানে। বইয়ের তাকে নতুন বই খুঁজছি। আমাদের থানায় ঐতিহ্যবাহী পাবলিক লাইব্রেরীতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল  তাই আমার লক্ষ্য নতুন বই।

এসময় বন্ধুটি বিশেষ একটা বইয়ের দিকে বারবার তাকাচ্ছে বলে লক্ষ্য করলেন দোকানদার।

দোকানদার জিজ্ঞাসা করলেন, কোন বিশেষ বই খুঁজছো?

বন্ধু : না মানে।

দোকানদার : বলে ফেল।

এবার বিশেষ বইটি হাতে নিয়ে বললেন, এটা?

বন্ধু মাথা নাড়ায়, কথা বলে না।

দোকানদার : কোন স্কুল? এ বই পড়ার বয়স তোমার হয়নি।

এবার বন্ধু দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। আমি দোকানদারের হাতে বইটির নাম লক্ষ্য করি : যৌবনের ঢেউ।

এরপর পড়াশুনার ঢেউয়ে আমরা হরিয়ে গেলাম।

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে আবার পড়লাম ঢেউয়ের পাল্লায়। সাইন ওয়েভ, কস ওয়েভ জীবনটা ত্যানাত্যানা করে ফেললো। অসিলোসকোপের ওয়েভ বিশ্লেষণ করতে করতে হার্ট বিট বেড়ে গেল।

চাকরি জীবনে এসে পড়লাম রেডিও ওয়েভের মধ্যে। সেই ঢেউ। আমি কম্বল ছাড়তে চাইলে কি হবে, কম্বল আমাকে ছাড়ে না।

দেশ আমার মাটি আমার অনুষ্ঠানের নানীর মুখে শোনা গল্প। নিজের মতো করে বলি:

গানের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার। সমবেত কন্ঠে “ও ঢেউ খেলেরে” গানটির মহড়া হয়েছে কয়েকবার। মাইক্রোফোনের সামনে গোল হয়েছে বসেছে শিল্পীরা। অন এয়ার বাতি জ্বলার পরও গান শুরু না করায় কন্ট্রোল বুথে থাকা সঙ্গীত প্রযোজক হাত নিচ থেকে উপরে তুলে শুরু করতে ইশারা করলেন। কিন্তু, শিল্পীরা বুঝতে না পেরে সবাই একযোগে দাঁড়িয়ে “ও ঢেউ খেলেরে ” গাইতে লাগলো। মাইক্রোফোনগুলো যেহেতু শিল্পী বসে গাইবে এমন পজিশনে লাগানো আছে তাই সঙ্গীত প্রযোজক এবার হাত উপর থেকে নিচে অর্থাৎ বসতে   ইশারা করলেন। বসে সবাই চুপ করে গেলেন। আবার সঙ্গীত প্রযোজকের হাত নিচ থেকে উপরে। তিনি  গান শুরু করতে ইশারা করেন আর তারা উঠে দাঁড়িয়ে গান শুরু করে। এভাবে সত্যি সত্যিই নদীর ঢেউ উঠেছিল সেদিনের সমবেত সঙ্গীতে।

আর এক ঢেউ এর গল্প। প্রফেশনাল টেপ রেকর্ডারে  নাটকের স্পুল টেপ চালিয়ে দিয়ে টেকনিশিয়ান কন্ট্রোল রুমে এসে গল্প জুড়েছে। তিরিশ মিনিট চলবে নিশ্চিন্তে। কিছুক্ষণ পরে ঢাকা ক এর মনিটর থেকে অপরিচিত শব্দ শিফট ইন চার্জের কানে আসলো । তিনি টেকনিশিয়ানকে জিজ্ঞাসা করায় জবাব পাওয়া গেল : নাটক চলছে তো স্যার। নদীতে নৌকা চলার ঢেউ এর শব্দ। অবশ্য শিফট ইন চার্জ টেকনিশিয়ানের কথায় বিশ্বাস না করে দ্রুত বুথে গিয়ে দেখেন যে, মেশিনে টেপ জড়িয়ে ঢেউ খেলছে।

এভাবে ঢেউ খেলে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি। স্রোতের অনুকূলে দাঁড় বেয়ে ঘন্টায় এত কিলোমিটার আর প্রতিকূলে এত কিলোমিটার নৌকা চালানোর অংক যে জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ তা এতদিনে বুঝেছি।

নদীর ঢেউ ছেড়ে সমুদ্রের ঢেউ দেখতে গাঁটের পয়সা খরচ করে প্রথমে কক্সবাজার গিয়েছি। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন জাহাজে চড়ে ঢেউয়ের মাতামাতি দেখেছি। ভরা পূর্ণিমায় সেন্টমার্টিনের নির্জন প্রান্তে রাতের সমুদ্রের গর্জন অনুভব করেছি। ঢেউ আসলে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার বিষয়। তাই তো পথিক নবী দরদী কন্ঠে গেয়েছেন:

আমার একটা নদী ছিল, জানলো না তো কেউ

নদীর জল ছিল না, কূল ছিল না, ছিল শুধু ঢেউ।

এজন্যই বুঝি তুরাগ নদীর তীরে বোট ক্লাব গড়ে ওঠে। রুপের ঢেউ, বিত্তের বৈভব আর শরাবের নহর বইয়ে দিয়ে আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে  সেখানে রাত বিরাতে জ্বিন-পরীরা হানা দেয়।

আমার সেই বন্ধুটি সেদিন মেসেঞ্জারে নক দিয়ে বলে, দোস্ত করোনা তৃতীয় ঢেউ ...

সেই বন্ধুটির কথা মনে আছে তো, যে  ‘যৌবনের ঢেউ’ বইটি দোকানের তাকে দেখেও চাইতে সাহস করেনি।

ঢেউ সংক্রান্ত লেখা শেষ করা আগে যে গল্পটা না বললেই নয়, তা হলো:

আফগানিস্থানের এক মন্ত্রী একবার এক বন্ধুপ্রতিম দেশে সফরে গেছেন। এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় তিনি তার পাসপোর্ট জমা দিলেন।

ইমিগ্রেশন অফিসার : স্যার, আপনি মন্ত্রী বুঝলাম, তা কোন মন্ত্রণালয়ের একটু বলবেন কি?

মন্ত্রী : শিপিং মন্ত্রণালয়।

ইমিগ্রেশন অফিসার : স্যার, আমার জানামতে, আফগানিস্থানে কোন সমুদ্র বন্দর নেই অথচ আপনি শিপিং মন্ত্রী ... 

মন্ত্রী : আপনি ঠিকই জানেন। এবার একটু ভেবে দেখেন,  আপনার দেশে কি আইন মন্ত্রী নেই ?

ইমিগ্রেশন অফিসার কি বুঝেছিলেন তা যদি আপনি বুঝতে পারেন তো আমার লেখা স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করবো।

আর একটা কথা, যার কাছ থেকে এ গল্প আমি শুনেছিলাম, তিনি দেশের নামটি বলেন নি। আমিও ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করি নি।

আপনি নিশ্চয় আমার সাথে একমত হবেন যে, এতদিনে আমি ঢেউয়ের গতি বুঝতে শিখেছি।

 

রহমান তৌহিদ
লেক সার্কাস , কলাবাগান ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top