সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষার কালো মেঘ : রাজ


প্রকাশিত:
১৫ জুলাই ২০২১ ২০:৪৬

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০৯:৩০

 

গভীর রাত।শুধু একজন ব্যক্তি ঘুমাননি। প্রতিদিনের মতো শিশুদের মতো হাউমাউ করে কান্না করেন। রাত যতো গভীর হয় তার কান্না শব্দ ততো বেশি করুণ হয়ে উঠে ।তিনি বিশেষ করে তার ছোট্ট মেয়েটির জন্য বেশি কান্না করেন। মেয়েটির নাম - মনি। জেলখানার চারদেয়ালের মাঝে মনির ছবি আঁকেন। চারদেয়ালে শুধু একটিই নাম- মনি, মনি,  মনি। জেলখানায় আমরা যারা ছিলাম। আমরা সবাই উনার জীবনের গল্প জানি। উনার বাসা বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলায়। গরু চোরাচালান  করতে গিয়ে ভারতীয় বিএসএফ এর হাতে ধরা পরেন। তারপর ভারতে উনি ৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হোন।

যখন উনি ধরা পরেন তখন উনার মেয়ের মনির বয়স ছিল - পাঁচ বছর। আমরা উনার সাথে কথা বলে যতোটুকু জেনেছি - তারা খুবই দরিদ্র। বাড়িতে তার বয়স্ক মা, বউ ও মনি। যেদিন ধরা পরেন সেদিনও তাদের বাড়িতে কোন খাবার ছিল না। ছোট একমাত্র আদরের মেয়ে মনি আহমেদের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো। সবসময় আহমেদের কাছে কাছে থাকতো। একটু  চোখের আড়াল হতে দিতোনা। একটু আড়াল হলে "আব্বু, আব্বু "ডাকে চিৎকার করে বাড়ির সবার কান ঝালাপালা করে দিতো। আহমেদ যখন এসব গল্প বলতো সে খুবই ভেঙে পরতো।আমি কয়েকদিন হতে লক্ষ্য করে দেখলাম-আহমেদের চোখের নীচে ভীষণ  কালি পরে গেছে। সে নীচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। আমি উনার পাশে বসে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই সে মাথা উপরে তুলে বলল- রাজ দাদা "সরি "।

আমি বললাম - ঠিক আছে, আহমেদ ভাই। আমি মাথা নেড়ে বললাম - আচ্ছা আপনি বলতে থাকুন। এরপরে আহমদ হঠাৎ আমাকে পাগলের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে বলল-"রাজদা -আমার মনি মামনি আমার জন্য কাঁদছে মনেহয়। মায়ের অসুখ। বউটাও এতিম। জেলখানার চারদেয়ালে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে দাদা। ৭ বছরের মধ্যে মাত্র দু'বছর গেলো। আমি পাগল হয়ে যাবো দাদা।" আমি আহমদ কে স্বান্তনা দিয়ে বললাম - সব ঠিক হয়ে যাবে আহমদ ভাই। সে আরো বলল-"রাজদা জানো আমার কাছে দুবছর এখানে দু'শ বছর মনে হয়। একবার কি হয়েছিল জানো দাদা? " আমি বললাম - "কি?"

"ভীষণ জ্বর হয়েছিল - মনি মামনির। কোন ডাক্তার দেখাতে পারিনি দাদা। সাতদিন বুকে জড়িয়ে রেখেছিলাম। সাতটি দিন মামনি চোখ বুজে ছিল। আর আব্বু আব্বু চোখ বুজে ডাকতো। কী ভীষণ জ্বর পুরো শরীর দিয়ে প্রচন্ড তাপ বের হচ্ছিল। টাকার অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারিনি দাদা।এমনি জ্বর সেরে উঠেছিল।" বলে আবারো ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল।

প্রতিটি মানুষের জীবনের গল্প আছে। পৃথিবীর কোন মানুষ যেমন এক নয়। ঠিক তাদের জীবনের গল্প গুলো আলাদা আলাদা।হাতের আঙ্গুলের ছাপের মতো। জীবনের গল্প গুলো কিছুটা হয়তো আহমদের মতো। সে যেমন তার একমাত্র আদরের মেয়ে মনির ছবি জেলখানা চারদেয়ালে এঁকে রাখেন। তেমনি আমাদের জীবননের গল্প গুলো জীবনের চারদেয়ালে আমরা এঁকে রাখি। যতোটুকু মনেহয় আহমদ ছবি আঁকায় পারদর্শী ছিল না। সে কখনো হাসতো, কখনো কাঁদত। 

সে বলল-রাজদা আমার ৭ বছর জেল হয়েছে মনে কোন দুঃখ নেই। কিন্তু জেলখানার চিকিৎসক যখন বলল - আমার মরণ রোগ ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরল।তারপর বেদনার একটা হাসি দিয়ে বললেন - আর মাত্র ১ বছর বাঁচব। পৃথিবীর কোন কারাগার আমাকে আর আঁটকে রাখতে পারবেনা। আমি মুক্তি পাবো দাদা। আমি মুক্তি পাবো। অট্রহাসিতে ফেটে পরল আহমদ। জানেন - দাদা, আমার ভীষণ ইচ্ছে হয় - আমার মনি মামনি ও আমার পরিবার কে এক পলক দেখার। হে ঈশ্বর! আমি জানি এ ইচ্ছে আমার পূরণ হবেনা। আমার লাশটা কোথায় দাফন হবে সেটাও জানিনা। আচ্ছা দাদা সব বিপদ কি তাহলে গরীবের উপরে আসে!"

আমি কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছি। 

মাঝে মধ্যে পাগলের প্রলাপ বকে আহমদ। "আসছি মামনি মনি। আসছি তোমার জন্য বাতাসা চকলেট নিয়ে!" কখনো হাসেন কখনো কাঁদেন। এই মেঘ এই ঝড়বৃষ্টি এমনই তার জীবন। 

নাদুস নুদুস আহমদ ক্যানসারে কঙ্কালসার হয়ে গেছেন।

 সে এবারে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। রাজদা -আমি আমার পরিবারকে স্বপ্নে বহুবার দেখেছি। যখন স্বপ্নে দেখি সবই বাস্তব। কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে গেলে আর স্হীর থাকতে পারিনা, দাদা।মনেহয় জেলখানা ভেঙে আমার দেশে ফিরে যায়। ইস!  দাদা জীবনটা যদি স্বপ্ন হতো! 

 আমি জীবনে অনেক পাপ করেছি বোধহয়। না হলে আমার জীবনে এমন ঘটবে কেনো? 

দাদা -আমি জেলখানায় বলে রেখেছি আমি মারা গেলে বুকের উপরে যেনে আমার আঁকা মনি মামনির একটা ছবি দেওয়া হয়।ইসরে অভাবের তাড়নায় এতিম বউকে কতোনা নির্যাতন করেছি। যদি একবার সুযোগ পেতাম মাফ চাওয়ার । 

আমি চারদেয়ালের আহমদের আঁকা ছবি গুলোর দিকে মনোনিবেশ করলাম। কি সুন্দর আঁকা!উনার মনের কথা গুলো ফুটে উঠেছে প্রতিটি ছবিতে। আহমদের জীবনের গল্প  

সত্যি ভীষণ করুণ। ওর জীবনের শেষ মুহূর্তের কিছু দিন আমি তার পাশে ছিলাম। তিনি যখন আর নড়াচড়া করতে পারছিল না। তখন দেয়ালে পিঠ ঠেক দিয়ে উদাস হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তার আঁকা ছোট্ট মেয়ে মনির ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতো।

তাকে কেঁদে কেঁদে শোকে কাতর হতে দেখেছি। তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরা দেখেছি। আহমদের জীবনের শেষ ইচ্ছে মতো তার নিজের আঁকা মনির ছবির একটি পেনসিল স্কেচ দেওয়া হয়েছিল। মাঝে মধ্যে অবচেতন হয়ে যেতো আহমদ। আবার চেতন ফিরলে -"মা মনি বলে মৃদু স্বরে ডেকে উঠতো। সামনে ঈদ তোমার জন্য নতুন জামা কিনে নিয়ে ফিরবো মা। তুই কাঁদিস না। মা আমি আসছি......  বিড়বিড় করে আরো কি কি যে বলে কিছু বুঝতে পারছিলাম কিছু বুঝতে পারিনি। আজ পৃথিবীর আর কোন কোন কিছু আমাকে রুখতে পারবেনা মামনি। আমি আসছি।"

তারপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন আহমদ ভাই।আমরা সবাই কেঁদে উঠলাম। তিনি দু'চোখ মেলে মৃত্যু বরণ করেছিলেন। আমি তার দুচোখ বন্ধ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু করিনি কারন আমি তার খোলা দুচোখে তার মেয়েকে শেষ দেখার আকুল আবেদন দেখেছিলাম। চিরদিনের জন্য সে চলে গেছে কিন্তু একজন বাবা তার মেয়ের প্রতি ভালোবাসার অফুরন্ত স্মৃতি জেলখানার চারদেয়ালে রেখে গেছেন।যা কোনদিন ভুলবার নয়।

 


বিষয়: রাজ


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top