সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

জীবনের আসল স্বাদ : রহমান তৌহিদ


প্রকাশিত:
১১ আগস্ট ২০২১ ১৯:৩২

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৫১

 

এক অপরাহ্নে কন্যাকে নিয়ে বাসার কাছাকাছি মাঝারি মানের ফাস্টফুডের দোকানে গেছি। এটা ওটা কেনার পর চোখে পড়ল বাটার বন। আজকাল আর দাম জিজ্ঞাসা করতে হয় না, পণ্যের মোড়কে লেখা থাকে। আড়চোখে দেখি, পয়ত্রিশ টাকা। আমার হাত বাটার বন স্পর্শ করা মাত্র স্মার্ট সেলসম্যান বললেন, স্যার এটা আমাদের সিগনেচার প্রোডাক্ট। একটা দিই।
বাসায় এনে বাটার বন মুখে দিয়ে আমার বত্রিশ / তেত্রিশ বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল। স্বাদ এমন একটা জিনিশ যা মানুষের স্মৃতিকে উসকে দেয়। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আমি সে সময় বাটার বনের ভক্ত ছিলাম - বলা যেতে পারে বাটার বন পাগলা। তারপর বাটার বন খেয়ে ক’য়েকবার হতাশ হয়েছি। মাঝে ক’য়েকবার তারকা হোটেলে বুফেতে বাটার বন চেখে দেখেছি - ভাল লেগেছে কিন্তু গাঁটের পয়সা খরচ করে তারকা হোটেলের বুফেতে অন্যান্য লোভনীয় খাবার রেখে বাটার বন খাওয়ার মতো পাগলা তো এতদিনে আমি নেই।
যা বলছিলাম, জীবনের আসল স্বাদ। এই শব্দগুচ্ছের সাথে আমার পরিচয় ক্যাটবেরির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। ক্যাটবেরির ডেইরি মিল্ক আমি আগেও খেতাম কিন্তু এই বিজ্ঞাপন দেখার পর খেয়ে হতাশ হলাম। এটাকে বলে প্রত্যাশার ধকল। বিজ্ঞাপন আমার মনে যে প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছিল, বাস্তবে আমি তা পেলাম না। হয়ত আপনি বলবেন, আমার এটা খেয়ে অভ্যাস নেই। হতে পারে , আমার রুচি তৈরি করেছে মহল্লার বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।
ফিরে যাই শৈশবে। জীবনের আসল স্বাদ বলতে আমরা বুঝতাম, কাঁচা আমের ভর্তা, জাম, জামরুল, ডেউয়া, গাব, করমচা, তেতুল ইত্যাদিতে। ইত্যাদি বললাম এ কারণে যে, যা বলেছি তাতেই আপনাদের জিভে জল আসতে পারে।
একসময় জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলতেন, কাউকে বুঝতে হলে দেখতে হবে সে কী খায় আর কী বই পড়ে।
তারপর যোগ হল, সে কী গান শোনে।
সে কী ছবি দেখে।
সে কী পোষাক পরে।
সে কার সাথে মেশে।
শৈশবের খানা খাদ্যের কথা তো বললাম। এবার বইয়ের কথা বলি। কৈশোরের থানা সদরের পাবলিক লাইব্রেরী, স্কুল -কলেজ লাইব্রেরি আমরা ফানাফানা করে ফেলতাম। ‘ইঁচড়ে পাকা’ বাগধারাটি আমাদের কাছে উপাধিই মনে হতো যখন কেউ জানতো সেই বয়সেই আমরা বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র শেষ করে রবীন্দ্রনাথ ধরেছি।
কলেজের প্রথম বর্ষে ইংরেজির ক্লাসে স্যার জিজ্ঞাসা করেন, কে কে পড়েছো যাবাবরের ‘দৃষ্টিপাত’।
একা একা হাত তুলতে দ্বিধা লাগে, তারপরও না তুলে পারি না।
বল , বইয়ের শেষদিকে চারুদত্ত আধারকার প্রেম সম্পর্কে কী বলেছেন?
মুখস্ত ছিল, বলেই ফেললাম, ‘প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য মৃত্যুকে দেয় মহিমা ... ’
দর্শক শ্রোতা মুগ্ধ হলে মনে যে তৃপ্তি পাওয়া যায়, সেটাও যে জীবনের আসল স্বাদ হতে পারে সেদিন বুঝতে পারলাম।
এরপর পদার্থবিজ্ঞান ক্লাস ফাঁকি দিয়ে টেবিল টেনিস খেলেছি, আর চুপি চুপি বলি পদার্থ বিজ্ঞানে উচ্চ মাধ্যমিকে লেটার মার্কও পেয়েছি। কেন ক্লাস ফাঁকি দিয়েছি? গাজী স্যারের প্রতি সম্মান রেখে বলি, তিনি যা পড়াতেন তার চেয়ে ভাল কথা দুইটি টেক্সট বুকে লেখা ছিল আর আমি আগের দিন তা ভাল ভাবে পড়ে ফেলতাম। প্রথম প্রথম তার ক্লাসে মন দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু নতুনত্বহীন, মডুলেশনহীন নিরস কথাগুলো আমার কাছে ‘গাজীর গীত’ মনে হতো। প্রশ্ন করেও হতাশ হতাম; প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর না দিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতেন। তাই, একসময় মনে হল, এই ‘গাজীর গীত’ না শুনে বরং টেবিল টেনিস খেলি, ইহাতে জীবনের আসল স্বাদ পাওয়া যাবে। জীবনে অপ্রয়োজনীয় জিনিস বর্জন করার দুঃসাহস আমি সে বয়সেই দেখাতে পেরেছিলাম বলে আজ নিজেকে বাহবা দিই।
ঈদ সংখ্যা পত্রিকায় সমসাময়িক সাহিত্যিকদের গল্প, উপন্যাস ছাপা হয়। কলেজ লাইব্রেরিতে এগুলো রাখা হয় কিন্তু তা আসা মাত্রই শিক্ষকেরা তা বাসায় নিয়ে যান। ছাত্ররা পড়ার সুযোগ পায় না। কারো মাথা ব্যথাও নেই। আমার একটু হলো। যাযাবরের দৃষ্টিপাত পড়ার সুবাদে ইংরেজি স্যারের চোখে পড়া আমি তারই সুপারিশে সে সুযোগ শিক্ষকদের মতো আমিও পেলাম। এ সময় সৈয়দ শামসুল হক, রাহাত খান, আবদুল মান্নান সৈয়দ , সাজ্জাদ কাদির পড়ার সুযোগ হল। প্রতি বৃহষ্পতিবার কলেজ লাইব্রেরি থেকে একটা বই নিয়ে রবিবারে ফেরৎ দিয়েছি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলা প্রবন্ধ রচনায় তাই সাহস করে লিখতে পারলাম : সমকালীন বাংলা নাটক। জীবনের আসল স্বাদ একটু একটু করে পরিবর্তন হতে লাগলো।
আমাদের কলেজ জীবনে বিচিত্রানুষ্ঠান হতো। আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে কিঞ্চিৎ গান বাজনা। অবধারিতভাবে সেখানে নির্ধারিত শিল্পী এবং তাদের বহুলশ্রুত সঙ্গীত। যেমন বিশেষ একজন শিল্পী মঞ্চে উঠলেই আমরা বলতে পারতাম প্রথমে তিনি গাইবেন,
‘বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি, কতকাল দেখি না তোমায় ...’
গান শেষে আমরা হাততালি দেব এবং সমস্বরে বলবো, ওয়ান মোর, ওয়ান মোর ...
তারপর তিনি হাসিমুখে গাইবেন , ‘আমার সোনার হরিণ চাই, আমার সোনার হরিণ চাই... ’
এই সোনার হরিণ গাইতে গাইতেই আমাদের সেই দিদি সরকার বাড়ির মেয়ে হয়ে ব্যানার্জি বাড়ির দাদার সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে ফেললেন। এ আর এক ধরণের জীবনের আসল স্বাদ।
এরপর জীবনানন্দ দাশ নামে জীবনের আনন্দবর্ধনকারী এক কবির সাথে পরিচয় হল।
‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতা শুরু হয়েছে এভাবে :
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আধারে যখন গিয়েছে ডুবে পূর্ণিমার চাঁদ
মরিবার হল তার স্বাদ।’
..
‘যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।’
...
‘চমৎকার, ধরা যাক দু’একটা ইদুর এবার।’
অনেক বছর জীবনানন্দে আচ্ছন্ন আমি, তার কবিতায় জীবনের আসল স্বাদ খুঁজেছি।
জীবন বহমান নদীর মতো। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে নতুন পথে পরিচালিত করে। হাল ঠিকমতো ধরে রাখতে পারি না, তাই ¯স্রোতের তোড়ে ভেসে চলেছি।
এরপর একটা বাগধারা শিখে ফেললাম, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো।
এই শেখাটা কাজে লাগলো। আগের মতো আর আসল খুঁজি না।
‘জলে ভেজা পদ্ম আমি , শুধু পেলাম ছলনা …’
অনেকের মতো আমারও প্রিয় গান তবে গীতিকারে মতো অত হতাশার কথা বলবো না। ছলনার সাথে সাথে ভালবাসাও পেয়েছি।
কোন কালে কাকে একটু বিনে পয়সায় পড়িয়েছিলাম, সে ডাক্তার হয়ে এসে কৃতজ্ঞতা জানায়। কাকে কবে একটু স্নেহের বকাবকি করেছিলাম, আমি ভুলে গেছি, কিন্তু সে মনে রেখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, শুনেও তৃপ্তি হয়।
আর ল্যাপটপের কীবোর্ডকে অত্যাচার করে ছাইপাশ যা লিখি, তা পড়ে পরিচিত -অপরিচিত কেউ যখন বলে, তার জীবনের সাথে , ভাবনার সাথে মিলে গেছে , তখন মনে হয় এটাই জীবনের আসল স্বাদ।
এক প্রাজ্ঞজন লিখেছেন, জীবনের আসল স্বাদ একাকীত্বের মাঝে পাওয়া যায় যদি সেটা উপভোগ করার মতো ধৈর্য থাকে।
আমি রম্য লেখক, তাই ধৈর্য সংক্রান্ত বাণীটি পড়ে আমার যে গল্পটা মনে পড়ে গেল, সেটা দিয়ে শেষ করি।
এক কৃপণ ব্যক্তি জুম্মার ওয়াজে হুজুরের বয়ান মন দিয়ে শুনেু । একদিন হুজুর ওয়াজের শেষ পর্যায়ে বললেন, ‘ভাইসব, আল্লাহর রাস্তায় এক টাকা দান করলে সত্তর টাকা ফেরৎ পাওয়া যায়।’ তো, এক টাকা দান করে সত্তর টাকার ফেরৎ পাওয়ার লোভে সে এক টাকা মসজিদে দান করে ফেলল। এবার ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, কবে সত্তর টাকা ফেরৎ আসবে। পরের জুম্মায় হুজুর একই ওয়াজ করে। কৃপণ ব্যক্তিটি এক টাকার শোকে হা হুতাশ করে। চিন্তায় চিন্তায় এক পর্যায়ে তার ডায়রিয়া হয়ে গেল ( চিন্তায় ডায়রিয়া হয় কিনা আমি নিশ্চিৎ নই- আমি যার কাছে শুনেছিলাম, তিনি এভাবে বলেছিলেন)। তো এ অবস্থায় সে গ্রামের পথ দিয়ে হাটছিল। এ সময় ডায়রিয়াজনিত প্রাকৃতিক ডাক প্রবল হওয়াতে দ্রুত ঝোপের ধারে গিয়ে বসল। বসেই দেখতে পেল একটি টাকার থলে। দ্রুত কর্ম শেষে সে ব্যাগের টাকা গুণে দেখে সত্তর। খুশীতে লাফাতে লাফাতে হুজুরে কাছে গিয়ে বলে,‘ হুজুর ওয়াজ করেছেন খাসা। এক টাকা দান করলে সত্তর টাকা পাওয়া যায়, কথা সত্য। কিন্তু সেটা পেতে ডায়রিয়া হয়ে যায়।’


রহমান তৌহিদ
রম্য লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top