সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যু ও মুক্তি : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২১ ১৮:৩৯

আপডেট:
১৭ আগস্ট ২০২১ ১৮:৪০

 

পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মৃত্যু ও মুক্তি শব্দ দুটো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। মৃত্যু মানে যেমনি সমাপ্তি তেমনি আরেক জীবনের শুরু। আবার মুক্তি মানেও আনন্দ বা শুরু। কোনোকিছুর শেষ অনেককিছুর শুরু।
‘শুরু’ ও ‘শেষ’ এ নিয়েই পৃথিবী তার ভেতরে জ্বালা-যন্ত্রণা, হাসি-আনন্দ, গ্লানি-অপমান বুকে নিয়ে মুখ বুঝে নিজ কক্ষপথে অবিরাম ছুটে চলে। এই ছুটে চলায় কোনো বিরাম না থাকলেও পৃথিবীর প্রাণীকূল এবং মানুষ নামক একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী সভ্যতার নামে তার সাথে কী কী আচরণ করে তার হিসেব রাখতে কখনো ভুল করে না।
মানুষ যেমন একজনের দুঃখ কষ্ট দেখলে কখনো কখনো ব্যথিত হয়, আবার হাসি-ঠাট্টার কিছু দেখলে বুক খুলে মুখ খুলে হাসতে সে ভুল করে না। তেমনি পৃথিবীর দুঃখ-কষ্ট কিংবা হাসি-আনন্দ দেখলে অন্যান্য গ্রহদেরও নিশ্চয়ই কষ্ট হয় কিংবা হাসি পায়।
এসব কথা নিজের ডায়েরিতে লিখে চলেছেন ড. রনেন আয়ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবানুতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন প্রফেসর। এমন সময় তাঁর মোবাইলে রিং বেজে উঠল।
‘হ্যালো কে বলছেন?’
‘আমি ডা. সীমা শাহরিয়ার বলছি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে। আমার বাবার নাম ডা. হাসান শাহরিয়ার। আপনার সাথে কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চাই। আপনি কী দয়া করে আমাকে আপনার অবসর থেকে কিছু সময় ভিক্ষে দেবেন?’ একটানা কথাগুলো বলে গেলেন সীমা।
‘সীমা শাহরিয়ার... হাসান শাহরিয়ার... তার মানে আপনি... মানে তুমি হাসানের মেয়ে সীমা। হাসানের কাছে শুনেছিলাম তুমি মেডিক্যালে পড়ছ। তা ডাক্তার হলে কবে? মানে ডাক্তারি পাশ করে গেছ?’ ড. রনেন আয়ন চিনতে পারলেন ডা. সীমাকে।
সীমা অপর পাশ থেকে বলল, ‘জি আংকেল আমি আপনার বন্ধু হাসান শাহরিয়ারের বড় মেয়ে। কয়েক বছর আগেই ডাক্তারি পাশ করেছি। তারপর বিসিএসে কোয়ালিফাই করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন শেষে এ বছরই ঢাকা মেডিক্যালে জয়েন করেছি।’
‘খুব ভালো করেছো। তা কী নিয়ে তুমি কথা বলতে চাও? ফোনে বলতে চাইলে বলতে পারো, আর না চাইলে বাসায় চলে আসো, যদিও আমি একটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করছি। তুমি বরং আগামী কাল সকাল সকাল চলে এসো। সকাল থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত আমি ফ্রি আছি।’
‘অনেক ধন্যবাদ আংকেল। আমি কাল সকাল নটায় চলে আসব। তারপর কথা হবে। এখন রাখছি।’ মোবাইল ডিসকানেক্ট করল সীমা।


পরের দিন সকালভোরে রেডি হয়ে ডা. সীমা ধানমন্ডিতে ড. রনেন আয়নের বাসার উদ্দেশে রওনা হলেন। নিজের গাড়িতে নিজেই ড্রাইভ করে ডা. সীমা ঠিক সকাল নটায় ড. রনেন আয়নের বাসায় পৌঁছে গেলেন।
ড্রয়িংরুমে বসে একটি ম্যাগাজিনের উপর চোখ বোলাচ্ছেন সীমা। এমন সময় রনেন আয়ন রুমে প্রবেশ করলেন। ডা. সীমা উঠে দাঁড়ালেন ড. রনেনের সম্মানার্থে।
টি-টেবিল সামনে রেখে দুজন মুখোমুখি বসলেন।
ড. রনেন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বাবা-মা ও পরিবারের সবাই ভালা আছেন?’
সীমা বলল, ‘জি আংকেল, সবাই ভালো আছেন।’
‘তা এখন কাজের কথা বলো, কী বিষয়ে আলাপ করতে চাও?’
সীমা বলল, ‘আংকেল আপনি তো দেশ ও পৃথিবীর বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সবই জানেন। কোভিড-১৯ বিষয়ে আপনার সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে চাই।’
‘তুমি কী করোনা ভাইরাস নিয়ে খুবই চিন্তিত?’
‘জি আংকেল, একজন নবীন ডাক্তার হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি খুবই উদ্বিগ্ন।’
‘আমি কিন্তু এ নিয়ে একটুও চিন্তিত নই?’
‘কেন আংকেল? আপনার আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের কেউ আক্রান্ত হয়নি বলে?’
‘মোটেও তা নয়। আমি নিজেই অপেক্ষায় আছি কখন এই মরণ ভাইরাস আমাকে আক্রমণ করবে।’
‘সে কী?’ সীমা চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালেন ড. রণেন আয়নের দিকে।
‘হ্যাঁ মা, আমি সত্যিই এই ভাইরাসের আক্রমণে পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যেতে চাই। কিন্তু আমি এটা চাই না, আমার অপরাধের কারণে আমার দেশের ও পৃথিবীর নিরপরাধ মানুষগুলো আক্রমণের শিকার হোক।’
‘আপনার কাছে আমি এসেছিলাম কিছু পরামর্শের জন্য- এই অবস্থা থেকে দেশকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়, কীভাবে নিজেকে সেভ করে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় সে বিষয়ে আপনার মতামত নেবার জন্য। কিন্তু আপনি নিজেই তো হতাশাগ্রস্থ...!’
‘হ্যাঁ মা, আমি সত্যিই হতাশাগ্রস্থ। আমার মনে হয় আমাদের দেশ ও পৃথিবীর সকল দেশের ষাট থেকে আশি বছরের ঊর্ধ্বে সকলকেই হতাশাগ্রস্থ এবং তাদের সকলেরই এই মরণ ভাইরাসের শিকার হওয়ার অপেক্ষায় থাকা উচিত।’
‘আপনি এসব কী বলছেন? আপনার কথার কোনো মাথামুণ্ডু আমি বুঝতে পারছি না। আমি উঠছি... আপনার কথা আমার সহ্য হচ্ছে না। আপনি ভালো থাকবেন...’
‘এখনই উঠবে কেন? আমার হাতে এখনও ঘণ্টাখানেক সময় আছে। এখন বলো তোমাকে আমি কী পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারি।’
সীমা কিছুক্ষণ মাথায় হাত রেখে সোফার একপাশে মাথা হেলিয়ে বসে থাকল। তারপর বলল, ‘আপনি সবই জানেন, সবই বোঝেন এখন আমাকে পরামর্শ দিন আমি বা আমরা দেশের এই পরিস্থিতিতে কী করতে পারি?’
ড. রনেন আয়ন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ড্রয়িংরুমে পায়চারি শুরু করলেন। উনি কিছুই বলছেন না। ডা. সীমাও কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর ড. রনেন আয়ন আবার সীমার মুখোমুখি বসলেন। এমন সময় আরও দু’ কাপ চা এলো। ড. রনেন চায়ের কাপ মুখে নিয়ে আবার টি-টেবিলে রাখলেন। তারপর বললেন, ‘মা, তোমাকে বলছি, তুমি বা তোমরা তোমাদের বয়সীরা আমাদের মতো ভুল কোরো না। আমরা বুড়ো এই পৃথিবীটাকে অনেক অনেক অত্যাচার করেছি। তোমরা তা কোরো না। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের কথা নিশ্চয়ই তুমি জানো? ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল কিন্তু নিজের কথা, নিজের পরিবারের কথা ভাবেনি। শুধু নিজেকে উজাড় করে দিয়ে আর্ত-পীড়িত ও যুদ্ধাহতদের সেবা করে গেছেন। পৃথিবী তাদের কথা মনে রাখে যারা পৃথিবীর প্রানিকূল, জীবজগতের সেবা করে গেছেন। আমার মতো সংখ্যাগরিষ্ট ডক্টরেটধারীদের পৃথিবীর কোনো প্রয়োজন নেই। অনেক তপস্যা করে মহান প্রতিপালক পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। অনেক আশা করে তিনি মানুষও সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে তিনি আমাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি। পৃথিবীর গাছপালা, পশুপাখি, নদী-সাগর, পাহাড়-পর্বত সবকিছু আমাদের কাছে নিরাপদ থাকবে এজন্য আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু যুগের পর যুগ খুব অল্প বিস্তর মানুষই তার নিজের দায়িত্ব পালন করেছে। সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ যুগ যুগ ধরে পৃথিবীকে শুধু ক্ষতিই করে যাচ্ছে। এমনকি তার প্রিয় বসবাস উপযোগী গ্রহটিকে পর্যন্ত দিনের পর দিন অত্যাচার করতে করতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। পৃথিবীর বাইরে তো মানুষের আর কোনো ঠিকানা নেই। আবাস নেই। মানুষ গবেষণা করে করে হাঁফিয়ে উঠলেও, মানুষ তার বসবাস উপযোগী আর কোনো গ্রহ-উপগ্রহ খুঁজে বের করতে পারেনি। তবুও মানুষ পৃথিবীর রক্ষকেরাই তার একমাত্র আশ্রয়স্থল পৃথিবীকেই প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছে। নিজের ঘরে নিজে কেউ আগুন লাগায়? কিন্তু আমরা মানুষেরা যুগের পর যুগ নিজের ঘরেই আগুন লাগাচ্ছি, নিজের সাথেই যুদ্ধ করছি। পৃথিবী ক্ষণে ক্ষণে আমাদের অত্যাচারে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। আমরা মানুষেরা আরও সাহসী হয়ে উঠছি। দুর্বলকে আরও দুর্বল করার নেশা আমাদের পেয়ে বসেছে...’
ডা. সীমা এতক্ষণ ড. রনেন আয়নের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে গেলেন। কিছুই বলতে পারলেন না। রনেন আয়ন চায়ের কাপ মুখে নিয়ে কয়েক চুমুকেই কাপের ঠাণ্ডা চা শেষ করলেন। এই ফাঁকে সীমা বললেন, ‘আপনার হতাশার কথা এতক্ষণে আমার মাথায় ঢুকেছে। কিন্তু আংকেল এখন তো আমাদের দেশের নিরপরাধ সাধারণ মানুষদের জন্য কিছু করতে হবে। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না।’
‘কী করতে চাও তুমি?’ ড. রনেন আয়ন এবার একটু বিরক্ত হয়ে উঠলেন।
‘আমি আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও এই ক্রান্তিকালে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। আপনি আমাকে প্রেরণা দিন, পথ বাতলে দিন।’
‘এইখানেই তোমার সাথে আমার চিন্তার অনেক ফারাক।’ রনেন আয়ন বললেন।
‘কী বলতে চাইছেন আপনি, আমি বা আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াব না?’
‘নিশ্চয়ই দাঁড়াবে, তবে মানুষের পাশে আমি বা তুমি আজ না হয় দাঁড়ালাম, মানুষের বর্তমান সংকট কেটেও গেল, অনেক মানুষের প্রাণ বেঁচে গেল। কিন্তু তারপর? কিছুদিন পর তো আবার কোনো ভাইরাস, কিংবা আরও ভয়ংকর কিছু তোমাকে আক্রমণ করবে। তুমি প্রতিহত করতে পারবে? বাঁচাতে পারবে পৃথিবীর মানুষকে?’
সীমা আবারও মাথায় হাত দিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কিন্তু আংকেল, আমাদের মানুষ হিসেবে তো মানুষের পাশে দাঁড়াতেই হবে।’
‘তোমাকে হয়তো আমি এখনও বোঝাতে পারিনি- তোমার বা আমাদের কী করা উচিত বা আমরা কী করব। সে আমার ব্যর্থতা। আজ অনেক কথা বলে ফেলেছি। আমার মাথাটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আমার আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। তুমি বাড়ি যাও। আজ তুমি অফিসে না গিয়ে আমার কথাগুলো একটু মনোযোগ সহকারে চিন্তা করো, তাহলেই তুমি তোমার কী করতে হবে, আর কী করা উচিত তার উত্তরও পেয়ে যাবে। আর উত্তর খুঁজে পেলে তুমি যদি মনে করো আমাকে তোমার পাশে পাওয়া দরকার, আমার পরামর্শ তোমার দরকার তাহলে ফোন করো। আমি চেষ্টা করব।’
সীমা ড. রনেন আয়নের ধানমন্ডির বাসা থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন।


আজ সারাদিন সীমা আর কোথাও বেরোল না। ড. রনেন আয়নের কথাগুলো বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে তার মস্তিষ্কের নিউরণে অনুরণন ছড়াতে লাগল। গভীর রাত পর্যন্ত ডা. সীমা গভীর মনোযোগে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এমন কেন? পৃথিবীর আজ এ অবস্থা কেন হলো? এসব নিয়ে আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছে। এক সময় চিন্তার রেখায় ছেদ পড়ল। তার এখন কী করা উচিত তার উত্তরও খুঁজে পেল।

পরের দিন সকালভোরে ডা. সীমা শাহরিয়ার ঢাকা মেডিক্যালের নিজের অফিসরুমে গিয়ে বসলেন। তারপর সাধ্যমতো রোগী দেখে বেরিয়ে পড়লেন, চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়ে হাসপাতালের বাইরেটা পরিষ্কার করার কাজে। পর পর তিন দিন তিনি এ কাজ করে হাসপাতালের বাইরেটা একেবারে তকতকে ঝকঝকে করে ফেললেন। তারপর নিজের বাড়ির চারপাশও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেললেন। হাসপাতালের কর্তব্যরত সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, যার যার বাড়িঘর, চারপাশের রাস্তাঘাট একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই গাছ ও কীটপতঙ্গের ক্ষতি করা যাবে না।
এক পর্যায়ে তিনি থামলেন। ভাবলেন এভাবে কী মানবতার সেবা করা সম্ভব? উত্তর পেলেন হ্যাঁ সম্ভব। যার যার নিজের কাজটুকু করার পর অবসরে নিজের বাসগৃহকে যেমন সুন্দর ছিমছাম করে সাজানো দরকার, তেমনি পৃথিবীকেও অবসর সময়ে সুন্দর করে সাজাতে হবে আমাদেরই। পৃথিবী আমাদের যতটুকু দিতে চায় সেটুকু নিয়ে পৃথিবীকে তার মতো করে থাকতে দিতে হবে। তবেই পৃথিবী স্বীকার করবে আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব।

৪.
ড. রনেন আয়ন গবেষণা করে চলেছেন। দিন-রাত। বিরতি নেই। বন্ধুর মেয়ে সীমাকে সে কীভাবে সাহায্য করতে পারে এ নিয়ে তার গবেষণা বিরামহীনভাবে চলছে।
একটা পর্যায়ে সে একটা সূত্র খুঁজে পেল। সূত্র আর কিছুই না। মানুষকে বাঁচানোর সূত্র না। মানুষ যখন পৃথিবীতে এসেছে তখন তো তাকে মরতেই হবে। কিন্তু এই মহামারী থেকে যারা বেঁচে যাবে তাদেরকে কীভাবে বাঁচাতে হবে তারই সূত্র। শুধু মানুষ বাঁচলেই পৃথিবী বাঁচবে না। পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে পৃথিবীর প্রত্যেকটা সদস্যকে বাঁচতে দিতে হবে। তবেই পৃথিবী ও তার বুকে ধারণ করা সবকিছু বাঁচবে।
তার গবেষণার শেষ কথা। পৃথিবী থেকে কিছু আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে হবে। আর সে আবর্জনাও পৃথিবী নিজে ধারণ করবে। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা পৃথিবীকে কিছুই দিতে পারে না। তারা শুধু পৃথিবীকে ক্ষতিই করে চলেছে প্রতিনিয়ত। তারা তো পৃথিবীর আবর্জনা। ড. রনেন আয়ন নিজেকেও আবর্জনা ভাবেন। তিনি একান্তভাবেই চাচ্ছেন তার মতো আবর্জনা যারা আছে তাদেরকে করোনা ভাইরাস পৃথিবী থেকে বিদায় করে পৃথিবীটাকে একটু স্বস্তি দিক।
ড. রনেন আয়ন দিনের পর দিন গবেষণা করে পৃথিবীকে বাঁচানোর একটা তালিকা করলেন।

৬.
ডা. সীমা রায়হান হঠাৎ একদিন ফোন পেলেন। ড. রনেন আয়ন তাকে ফোন করেছেন। তিনি বললেন, ‘মা সীমা, আমি তোমাকে কিছু কাগজ দিয়ে যেতে চাই। আমি হয়তো আর বেশিদিন বাঁচব না। মরে যাওয়ার আগে আমি কাগজগুলো তোমার হাতে দিয়ে যেতে চাই।’
সীমা বললেন, ‘আংকেল, আমি কী আজই আসব?’
‘তুমি আসবে, আমি তো কোভিড পজেটিভ?’
‘আংকেল, আমি তো ডাক্তার, আমি আমার নিজের সেফটি বুঝি।’
‘তবুও আরেকটু ভেবে দ্যাখো।’
‘আংকেল, ভাবাভাবির কিছু নেই। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আসছি। আপনি বাসায় আছেন তো?’
‘হ্যাঁ মা, আমি বাসায় আছি। আমি কোনো হাসপাতালে ভর্তি হবো না। তোমাদের হাসপাতালগুলোর যে অবস্থা।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে আংকেল, আমি আসছি।’

ডা. সীমা রায়হান নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে ড. রনেন আয়নের বাসায় পৌঁছে গেলেন। ডা. সীমা সরাসরি রনেন আয়নের থাকার ঘরে ঢুকলেন। ড. রনেন আয়নকে দেখে মনেই হচ্ছে না তিনি কোভিড পজেটিভ।
ডা. সীমা বললেন, ‘আপনি কতদিন ধরে পজেটিভ?’
‘দশ-এগারো দিন তো হবেই’, ড. রনেন হালকা কাশতে কাশতে বললেন, ‘আমি কিন্তু তোমাকে আমার কোভিড পজেটিভ এটা জানানো বা আমার চিকিৎসার জন্য তোমাকে এখানে ডেকে আনিনি।’
ডা. সীমা বললেন, ‘আপনি তো আমাকে বলেইছিলেন যে, আপনি আমাকে কিছু কাগজপত্র দেবেন। সেটা নিতেই আমি এসেছি।’
ড. রনেন আয়ন নিজের বিছানার নিচ থেকে এলোমেলো কিছু কাগজ বের করে ডা. সীমার কাছে দিলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘সিরিয়ালি পেজ নম্বর আছে। তুমি একটু মিলিয়ে নাও।’
সীমা কাগজগুলো সিরিয়াল করে নিজের ব্যাগে ভরতে ভরতে বললেন, ‘আপনি কী কোনো চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু কোনো লাভ হবে না। আর আমি চিকিৎসা নিতেও চাই না। আমাদের মতো আবর্জনা পৃথিবীতে থেকেও কোনো লাভ নেই। আবর্জনা যত তাড়াতাড়ি পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেতে পারে ততই পৃথিবী ও তোমাদের মঙ্গল।’
ডা. সীমা বললেন, ‘আপনার ছেলেমেয়েদেরকে আপনার অসুস্থতার কথা জানিয়েছেন?’
‘না, জানাব না।’
‘কেন?’
‘কারণ নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত তো নিজেকেই করতে হবে না কী?’
‘বুঝলাম না আংকেল।’ ডা. সীমা বললেন।
‘আচ্ছা বুঝিয়ে বলছি, আমরা যারা ষাট পেরোনো পৃথিবীর বাসিন্দা, আমরা কিন্তু কেউই আমাদের দায়িত্বটা পালন করতে পারিনি। প্রথমত, আমরা আমাদের সন্তানদেরকে পৃথিবীটা যে আমাদের একমাত্র বাসস্থান এই শিক্ষা দিতে পারিনি। বোঝাতে পারিনি পৃথিবীটাকে ভালোবাসতে হবে, পৃথিবীর সকল সদস্যকে ভালোবাসতে হবে। আমরা নিজেরাও পৃথিবীকে ভালোবাসিনি। আমরা কতোকিছু ভালোবাসি। খাবার ভালোবাসি, পোশাক ভালোবাসি, গাড়ি-বাড়ি, স্ত্রী-সন্তান ভালোবাসি। কিন্তু যে পৃথিবী আমাদের আলো দিয়ে, বাতাস দিয়ে, পানি দিয়ে, খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে সেই পৃথিবীকে আমরা নিজেরাও ভালোবাসিনি আমাদের পরবর্তী জেনারেশনকেও শেখাতে পারিনি পৃথিবীকেই বেশি ভালোবাসতে হবে। আর আমাদের এই ভুল, অবহেলার কারণেই আমরা সকলেই পৃথিবীকে ভালোবাসার পরিবর্তে শুধু অত্যাচার করে গেছি। পৃথিবীটাকে তিলে তিলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছি। তো সেজন্যে তো প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। কী বলো?’
‘আংকেল, সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর সৃষ্টিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে- সে তো ঠিক তবুও...।’
‘আমার অসুস্থতা এবং আমার মৃত্যুর সময় আমি আমার আপনজনদেরকেও জানাচ্ছি না বা জানাতে চাই না। আমি বিলীন হওয়ার আগে একটু হলেও প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে চাই। আর সেই প্রায়শ্চিত্তটা হচ্ছে... অনেক হয়েছে, আর কাউকে জ্বালাব না। আর এতে নিশ্চয়ই, তুমি আমাকে আনএডুকেটেড, আনকালচারড ভাবছ।’
‘আংকেল তেমনটা না। তবে আপনি আমার ভেতরের ‘আমি’টাকে জাগিয়ে দিতে পেরেছেন। সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি যতদিন বাঁচব সবার আগে পৃথিবীটাকেই বেশি ভালোবাসব।’

৭.
ডা. সীমা শাহরিয়ার বাড়ি ফিরে আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছে। বারবার ড. রনেন আয়নের শেষ কথাগুলো তার ভেতরে তোলপাড় করে যাচ্ছে। ‘পৃথিবীকে ভালোবাসতে হবে।’ এভাবে কোনোদিনই আমি ভেবে দেখিনি যে, মহান প্রতিপালক সুন্দর এই পৃথিবীতে আমাদের পাঠিয়েছেন শুধু নিজের জন্য নয়, মানুষসহ পৃথিবীর প্রানিকুল, গাছপালা, মাটি, পানি, বাতাস সবাইকে ভালোবাসতে হবে, সবার সাথে সমান আচরণ করতে হবে। তবেই আমাদের মুক্তি। সেই ব্রত নিয়েই আমি আমার বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবো।
ডা. সীমার ভেতর অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। কয়েকদিন পরে তিনি খবর পেলেন ডা. রনেন আয়ন মৃত্যুবরণ করেছেন।
ডা. সীমা তার বাবার সাহায্যে ডা. রনেন আয়নকে তাঁর গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ে দাফনের ব্যবস্থা করেন।
এরপর তিনি ঢাকা মেডিক্যালের চাকরি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করলেন, তিনি গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাবেন। তার আবেদন গৃহীত হলো। তিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে গেলেন। দারিদ্র্যপীড়িত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শপথ নিলেন। উত্তরবঙ্গের অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষের মাঝে তিনি নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ব্রত গ্রহণ করলেন। তিনি ‘আমাদের জীবন ও প্রকৃতি’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করালেন। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে প্রকৃতিকে বাঁচানো, প্রকৃতিকে রক্ষা করা। প্রকৃতির ক্ষত সারানো। গ্রামের একশো জন তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। তাদের প্রধান কাজ রাস্তার পাশে, নিজেদের বাড়ির আঙিনায় গাছ লাগানো, গবাধিপশু পালন। প্রতিদিনের রুটিন কাজ হলো প্রকৃতি নিধন রক্ষা, প্রকৃতিকে বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। এ কাজে অনেক প্রতিকূলতা দেখা দিলো। এক পর্যায়ে ডা. সীমা শাহরিয়ার ডা. রনেনের মতো হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি হাল ছাড়লেন না। ডা. রনেন আয়ন তাকে পৃথিবীকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তার ভেতরের ‘আমি’টাকে জাগিয়েছেন। সেই অনুপ্রেরণায় ডা. সীমা একটার পর একটা গ্রাম জনপদকে পৃথিবীকে আবর্জনামুক্ত রাখতে, প্রকৃতিকে সমুন্নত রাখতে, সৃষ্টির সকলকিছুকে দেখ-ভাল করার জন্য দিনের পর দিন ক্লান্তিহীন কাজ করে যেতে লাগলেন।

ডা. সীমা শাহরিয়ার মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন, করোনা ভাইরাস মানুষকে যেমন মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিচ্ছে তেমনি অনেক মানুষ নিজেকে নতুন করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করছেন। অনেকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে নিজেকে আর্তমানবতার সেবায় বিলিয়ে দিচ্ছেন। পৃথিবীতে সবুজ গাছপালা, বনবনানী যেমন প্রয়োজন, তেমনি নীল সাগরের পানি, নদী-নালা-খাল-বিল ও নীল আকাশ প্রয়োজন। যেমন মানুষের প্রয়োজন, তেমনি পশুপাখির প্রয়োজন। পৃথিবীতে আসলে আমরা একে অপরের পরিপূরক। কেউ অপরিহার্য নই। মৃত্যু ও মুক্তির স্বাদ আমাদের গ্রহণ করতেই হয়।

 

মশিউর রহমান
শিশুসাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
প্রকাশক, সৃজনী
পরিচালক (প্রচার), বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top