সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া : শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
২৩ আগস্ট ২০২১ ২২:৪৮

আপডেট:
২৪ আগস্ট ২০২১ ০০:২৯

ছবিঃ ড. শাহনাজ পারভীন

 

প্রতিদিনকার মত আজকের ভোরেও নাম না জানা নানা পাখিরা সব ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছে। পাখিগুলো এত সুন্দর! পৃথিবীতে ফুল আর প্রজাপতির পরেই বোধহয় পাখিদের স্থান। তবে পাখির রাজ্যে সবচেয়ে কোন পাখিটা বেশি সুন্দর তা বলা কঠিন। নীলটুনিটাই মনে হয় সবচেয়ে বেশি সুন্দর। কী ওদের গায়ের রং, কী ওদের ওড়ার ঢং, কী সুন্দর ওদের গান, কী অপূর্ব তাদের বাসা! কী সুন্দর করে ঘুরে ঘুরে ওরা ওদের বাচ্চাদের জন্য খাদ্য যোগাড় করে। সুমাইয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখে। সকাল থেকেই আতা গাছের ডালে নীল টোনাটা ডেকে ডেকে অস্থির। কয় দিন ধরে টুনি পাখিটা চুপ করে বাসার ভেতর থেকে তার ঠোঁটটা একটু বাইরে বের করে ডিমে তা দিচ্ছে। সে অত গান টান গায় না। সারাদিন এক মনে ডিম তা দেয়। সুমাইয়া খুব মন দিয়ে ওদেরকে সকাল বিকেল দেখে। সঙ্গী সাথী যাই হোক ওরাই ওর কাছের। তাই বুঝি নীল টোনা প্রতিদিন সকালে ওর সেলের সামনে বসে মরিয়া হয়ে ওকে গান শোনায়। ওরাও কী সুমাইয়ার মত ভোর হওয়ার অপেক্ষায় উদগ্রীব। উতালা হয়ে অপেক্ষা করছে সূর্যের না ফোটা সোনা রং যা কোনদিন ওর দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে নি কিংবা ছলকে উঠে নি সেইসব দেখবার জন্য? কিন্তু না, ও আবার ভাবে কোথায় আকাশের ডানাওয়ালা মুক্ত স্বাধীন পাখি আর কোথায় জন্মের প্রায় পর থেকেই জেলখানার এই ফাসির সেলে বেড়ে ওঠা আমি? সাত বাই চার ফুট দেয়ালে চোখের দৃষ্টি আটকে যাওয়া সীমানা। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই ঘরকেই ও ঘর বলে জেনেছে। ঘরের বাসিন্দা বলতে মা উজালা ওর একমাত্র পৃথিবী। মাঝে মাঝে দুই একজন খালা আসে দিন, মাস কিংবা বছরও হয়ত কেটে যায় তারপর একদিন বিকালে বিকালে ঘন ঘন লোক জন আসে, ভাত আনা মামা খালাদের মুখে কানা ঘুষা কিছু কথা শোনে তারপর হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে এই ঘরে আর কেউ নেই। সে খালা নেই, খালার কাপড় চোপড় পানের ডিব্বা দাঁত মাজার পেষ্ট ব্রাশ, তসবিহ দানা ফুল তোলা জায়নামাজ, রঙিন স্যাণ্ডেল কিচ্ছু নেই। আবার সেই ও আর ওর মা। মাও যে এমন! হাজার বার জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর দেয়না। ডেকে ডেকে যখন ও ক্লান্ত হয়ে যায় চোখ ফেটে যখন অঝোরে পানি ঝরে তখন মা এসে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। মুখে কিছু বলে না। ওর সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁদতে থাকে। তাই ও আর সহজে ওর মাকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। একা একাই থাকে। মা ও একদম চুপ। গারদের শিক্ ধরে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকা ওর প্রাত্যাহিক রুটিন। এখানকার লোকজন যখন এ পাশ দিয়ে যায় তখন ওকে দেখলে ওরা কিছুটা সময় দাঁড়ায়। তাও সব সময় না। ডাকলেই বলে-
-হাতে সময় নেই রে। তুই দাঁড়া। আমি একটু পরে আসছি।
ও দাঁড়িয়ে থাকে ঠাঁই। ওদের আর সময় হয় না। কিংবা মনে থাকে না। ও দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। পরে দেখা হলে দাঁতে জিভ কেটে অন্যদিনের মত আজও জলিল মামা বলে-
-যা! সুমাইয়া, আমি তো একদম ভুলে গেছিলাম। কাজের চোটে একটুও মনে ছিল না । তুই তো আবার আমার ডাকতি পারতিস।
-আমার একবার মনে হইছিল। কিন্তু আপনাগের তো কত কাম থাকে। আমার তো আর কাম কাজ নেই। সময় কাটে না মামা। তাই আপনারে ডাকছিলাম।
-ক, তাড়াতাড়ি ক। কী কবি?
- না, কিছু না। এই এমনিই।
- ও, তয় তুই থাক। আমি ডিউটি শেষ করার আগে একবার আসপানে।
- ও মামা, দাঁড়াও দাঁড়াও, মনে পড়িচে। শোন আম্বিয়া খালা কোন রুমি গেচে। সে তো কালকের তে আরা আমাগের রুমি নাই। আম্বিয়া খালারে কবা, আমি খালার জন্যি গেটে দাঁড়াই রইছি। খালা চলে গেচে ক্যা। তুমি খালারে কবা, আমাগের রুমি আসতি। আমি আর ওনার দাঁত মাজার পেস্ট নিবান না। নষ্ট করবান না।আমি তো আজকে চলেই যাচ্চি। মা একা একা থাকপেনে। তুমি এট্টু খালারে কয়েনে, মার কাছে আসে থাকতি। আমি চলে গিলি মা একা একা থাকপেনে। তুমি এট্টু খালারে কও না এইজাগা আসতি। আমি যাওয়ার সময় এট্টু দেহে যাতাম। আম্বিয়া খালার কতা আমার মনে পরতিচে।
হায় আল্লাহ। কি যে কাম নিছি এত দুঃখ আর সৈহ্য করা যায় না। কোথায় ওর আম্বিয়া খালা। তারে তো পরশু মধ্যরাতে ফাঁসি দিছে। কাল সকালেই তো তার লাশ নিয়ে কত কি হইলো। সাংবাদিকরা সব ছবি তুললো। গ্রামের বাড়ির লোকজন এসে লাশ নিয়ে গেল। ও কি কিছুই জানে না? আবার মনে মনে ভাবে, ও আর কিভাবেই বা জানবে? ওর জানার জায়গা তো, ওর পৃথিবীতো ওর ঐ গরাদখানার ঘর আর ধরে থাকা শিক। এই সেলের কুঠুরি। কেউ না বললি কি করে ও জানবে? ও কিচ্ছু টের পায় না। ও কি করে টের পাবে এই বড় জেলখানার ভিতরে, এর বাইরে অনেক বড় পৃথিবীর কনে কি হচ্ছে। ও কি জানে, আজ বাদে কাল ওর মারও এই রকম ফাঁসি হয়ে যাবেনে। ঔ চলে যাবেনে এই অনেক বড় পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। কী জানি ওর সাথে কী আমার আর কোন দিনও দেখা হবেনে। নাকি ঔ বড় হয়ে ওর মার মত ওর স্বামীরে খুন করে জেলে ঢোকপেনে। ওর মার মতই ঔ আবার দুই বছরের দুধির বাচ্চা নিয়ে বছরের পর বছর জেলে পচপেনে। কিন্তু যার জন্নি ওর বাপরে ওর মা খুন করিচে তার সাথে তো আর ইহ জনমেও দেখা হবেন না। ঘর করা তো দূরির কতা।
-ও মামা, তুমি এত কি ভাবতিচো? আমার কথার এট্টা উত্তরও তো তুমি দিলে না। কি ভাবো এত তোমরা?
সুমাইয়া এক হ্যাচকা টানে যেন জলিলকে ওর সামনে এনে দাঁড় করায়।
- না, মা কি আর ভাবব? ভাবতিছি দুনিয়া বড় কঠিন জাগা। আচ্ছা সুমাইয়া তোর কাছে আমি এট্টা জিনিষ শুনি, তুই তার উত্তর দে।
- কী, তা কবা তো?
-আচ্ছা কতো, কাল বিকেল বেলা যে তিনজন মেয়েলোক তোদের সাথে দেখা করতি আসলো ওরা কারা? তুই চিনিস?
-কী যে কও না মামা? চেনবো না ক্যা। তুমি তাগের দেকিলে?
-হু, দেকিলাম তো। তোর হাতে চিপস দিল একজন, সে কিডা?
-ওমা তুমি তো সবই দেকিচো। তা তুমারে তো আমি দেকপার পারলাম না। তুমি কনে ছিলে?
-আমি তখন ব্যস্ত ছিলাম। ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই দেখিছিলাম।
-ও, যে আমারে চিপস দিল উনি আনার নানা। আর ঐ যে এট্টু বুড়ো মত লাল শাড়ি পরা উনি আমার নানী। যেইতি কালো শাড়ি পরা ছিল উনি আমার বড় মামী। জানো মামা, আমারে না আজকে নানী বাড়ি নিয়ে যাবি। আজকে সকালেই তো আসপি। সেই জন্নিই তো আমি সাজে গুজে রইচি।
-তাই তো আমি তো তা খেয়াল করিনি। এত সুন্দর চুড়ি তুই কনে পালি? কি সুন্দর লাল চুড়ি। লাল লিপিস্টিক।
-এসব ঈদির দিন আমার ছোট মামা নিয়াইচিল। তাই পরিচি। চুড়ি এট্টু ছোট হয়ে গেছে না মামা?
-না, না, ঠিকই তো আচে। বড় সৌন্দর্য দেখাচ্ছে রে। তোর মা কি করতেছে রে সুমাইয়া।
- মা আবার কী করবি? ঐ শুয়ে শুয়ে কানতেছে। আমি চলে যাবো তো তাই।
- তোর খারাপ লাগতেছে না? তোর মার জন্নি তোর পরান পুরতেচে না?
-তাতো পুরতেছে। আমি তো মারে কলাম আমি তুমারে থুয়ে একলা যাবো না। একেবারে তুমার সাথে যাবানে। তা তো মা শুনতেছে না। মা কচ্ছে তুই যা মধু, আমি দুই তিনদিন পর আসপানে। কন, মামা এত বছর যদি আমরা একসাথে থাকপার পারলাম তো আর দুই তিন দিনি আর কী ওতো। আম্বিয়া খালাও চলে গেল। আমিও যদি চলে যাই, মা তো একলা একলা ভয় পাবেনে মামা। আমি বার বার কচ্চি তা না, আমার কতা কেউ শুনতি চাচ্চে না। আমারে আজকেই নিয়ে যাবি। ওযে আমার বড় নানী আচে না। ঐ যে আসলো একদিন, আপনার মনে আছে মামা। ঐ নানীর নাকি মেলা অসুখ। আমারে দেখবার চাচ্ছে। মারেও দেখতি চাচ্ছে কিন্তু জর্জ সাহেব কইছে মার ছুটি দিতি এখনো দুইতিন দিন দেরি আছে।
-তাই নাকি? তুই তো সব খবরই রাখিস সুমাইয়া?
গোপনে অশ্রু মোছে জলিল। আহারে, কী ভাবে সান্ত¦না দেবে সে? বাপকে মেরেছে মা, আর মা ঝোলবে ফাঁসির দড়িতি। ঐ টুকুর দুধির বাচ্চা। ওর কী দোষ। জলিলের দিব্যি মনে পড়ে আজ থেকে চার পাঁচ বছর আগে সুমাইয়ার মা চুয়াডাঙ্গা জেলখানা থেকে ফাঁসির আসামী হয়ে যশোর জেলখানায় আসে। সেই থেকে ও ওর মার সাথে। তখন ওর বয়স দুই বছর কি আড়াই বছর। ও তো বুদ্ধি হওয়ার পর বাইরের পৃথিবী দেখিনি। সূর্য দেখিনি। আকাশ দেখিনি। কিন্তু এর মদ্যি তাও তো ভালই ছিল। কিন্তু মা বাপ ছাড়া কে ওরে সারাজীবন দেখাশুনা করবেনে। কে ওরে আদর সোহাগ করে বড় করবেনে। এই অনাদরের বাচ্চাগুলোই তো বড় হয়ে বড় বড় অপরাধ করে জেলে আসে। জলিলের বুকের মদ্যিও মোচর মেরে ওঠে। ওর জলি যদি আজ বেঁচে থাকতো তাইলি সেও তো ওর মতই বড় হতো। জন্মের সময় মেয়েডা আমার মরতি মরতি বেঁচে গেল। সেই একমাত্র মেয়েডা আমার মরলো জেলখানার পুকুরি ডুবে। পেটেরতেই বাচ্চাডার সমস্যা ছিল। ডাক্তার আলটাসোনো করে বলিছিলো
-মেয়ে হবে আপনাদের।
তাই ওর মা আমার নামের সাথে নাম মিলিয়ে মেয়ের নাম ঠিক করে রাখিছিলো জলি। কিন্তু কপালের কি ফ্যাড়া জন্মের সময়ি প্রায় মরে যাওয়া মেয়েডা কত যতœ আত্তির করতি করতি ফুলির মত সুন্দর হয়েু বেঁচে উঠলো। সেই মেয়ে মরে গেল দুই বছর বয়সে পানিতি পরে যেয়ে। মেয়েডা মরে যাওয়ার দিন কতক পরেই আসে সুমাইয়া। তাই তো জলিল কাজে অকাজে এদিকি আসে। শিক্ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সুমাইয়ার মধ্যে দেখে জলির ভেসে ওঠা মুখ। সুমাইয়া আজ চলে যাবে। ওর মার ফাঁসির সব কার্যক্রম শেষ। দুই একের মধ্যেই হবে। তার আগে তো মেয়েটাকে সরিয়ে দিতে হবে। তাই খুব তোড়জোড় করে ওর বের বরার ব্যবস্থা পাকাপাকি হইছে গতকাল। গতকালই ওর নানা নানীকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু জলিলের চোখে বাঁধ ভাঙা জলের স্রোত কেন? ও কি জলির শোক ভুলতে চেয়েছিল সুমাইয়ার মুখ দেখে।
-ও মামা, তুমি যাবা আমারে দেখতি?
হঠাৎ করে সুমাইয়ার মুখে এই কথা শুনে জলিল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। ওর হাত দুটো ধরে।
-হ, হ, যাবানে তোরে দেখতি। তুই যে আমার মেয়ের মতন সুমাইয়া।
-মামা আমি এট্টা জিনিষ দেখছি। তুমার মত আমারে কেউ আদর করে না মামা। তুমি কিন্তু আমারে দেখতি যাবা। আর মারে এট্টু ভালো গোস দিও, তরকারি দিও। এতদিন যা দিতে মা শুধু আমারেই দিয়ে দিত। তুমি কিন্তু মারে এট্টু ভালো খাবার দিও।
- হ, দিবানে। তোর অত চিন্তা করার দারকার নাই। তুই ভালো থাকিস সুমাইয়া। স্কুলে ভর্তি হোস।
স্কুলের কথা মনে পড়ায় হঠাৎ করেই সুমাইয়া পাল্টে যায়। খুশিতে আটখানা হয়ে বলে
- তোমারে তো কই নাই মামা। নানা আমারে বই খাতা দিয়ে গেছে। নানী আমারে স্কুলে ভর্তি কইরা দিব। মা কইছে, আমি অনেক বড় হব। জজ ব্যারেস্টার। তারপর আমি জেলখানার তে আমার মারে ছারাইয়া নেব। একেবারে ছারায়ে নেব। আর কোন দিন জেলখানায় আসতি দেব না, এর মদ্যি আর থাকতি দেব না।
এইটুকু বলেই সুমাইয়া বলে মামা তুমি এখন যাও। আমি আমার বইখাতা গুছাই নেই। নাই বুলে যাবানে। নানীরা চলে আসপেনে এখনি। তুমি কিন্তু যাবা আমারে দেকতি। ভুলবা না কিন্তু...সুমাইয়া দ্রুত পায়ে সেলের মধ্যে ঢুকে যায়। জলিল তখনও সেলের শিক্ ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে সুমাইয়ার দ্রুত পায়ে নাচতে থাকা দেখে। ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে পানিতে ডুবে যাওয়া জলির মুখ। ফাঁসিতে ঝুল থাকা উজালার করুণ চোখ। ও চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত ওখান থেকে সরে যায়।

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক
অধ্যক্ষ, তালবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ, যশোর
সভাপতি, অগ্নিবীণা, যশোর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top