সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

‘সর্বহারা কাব্য’: খেটেখুটে খাওয়া মানুষের জয়গান : আবু আফজাল সালেহ ‍


প্রকাশিত:
২৫ আগস্ট ২০২১ ২১:০৩

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:২৫

ছবিঃ কাজী নজরুল ইসলাম

 

বাংলা কবিতায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ  থেকে ফিরে এসে এই কবি বাঙালির চৈতন্যে প্রথম বড় ধরনের ধাক্কা দিলেন; তিনি ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। লিখলেন হিন্দু মুসলমান মিলনের বহু কবিতা ও গান। ‘অসহায় জাতি ডুবিছে মরিয়া, জানে না সন্তরণ/কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি গান।/হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কান্ডারি! বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।’-(কাণ্ডারী হুশিয়ার)

নজরুলের সর্বহারা ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়। এখানে সমাজের খেটেখুটে খাওয়া শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা বলা হয়ছে। এরকম ১০টি কবিতার সমন্বয়ে চমৎকার কাব্য এটি। আমার কৈফিয়ত নামীয় বিখ্যাত কবিতাটি এ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া অন্য নয়টি কবিতা হচ্ছে- সর্বহারা, কৃষাণের গান, শ্রমিকের গান, ধীবরদের গান, ছাত্রদলের গান, কাণ্ডারী হুঁশিয়ার, ফরিয়াদ, প্রার্থনা ও গোকুল নাগ। সর্বহারা কবিতায় শেষের দিকের কবির আহ্ববান: ‘...মাঝিরে তোর নাও ভাসিয়ে/মাটির বুকে চল!/শক্ত মাটির ঘায়ে হউক/রক্ত পদতল।/প্রলয়-পথিক চলবি ফিরি/দলবি পাহাড়-কানন-গিরি;/হাঁকছে বাদল ঘিরি ঘিরি,/নাচছে সিন্ধুজল।/চল রে জলের যাত্রী এবার/মাটির বুকে চল।।’-(সর্বহারা)। শ্রমিকের ঘামে সভ্যতা তৈরি। কিন্তু তাদেরকে মূল্যায়ন করা হয় না। এ অবস্থা নজরুলের আগে বা তাঁর সময়েও বিদ্যমান ছিল। বর্তমানেও এ বৈষম্য বিদ্যমান। এ ব্যাপারে নজরুলের কঠিন আহ্ববান: ‘...আমরা পাতাল খুঁড়ে খনি/আনি ফণীর মাথার মণি,/তাই পেয়ে সব শনি হল ধনী রে।/এবার ফণি-মনসার নাগ-নাগিনী/আয় রে গর্জে মার ছোবল।/ধর হাতুরি, তোল কাঁধে শাবল...'-(শ্রমিকের গান)

 

ছাত্রসমাজকেও একত্রিত হতে বলেছেন। কোনো অধিকার আদায় বা আন্দোলন-সংগ্রামে যুব ও ছাত্রসমাজকে জেগে উঠতে হয়। ছাত্রদের প্রতি কবির আহ্বান: ‘আমরা শক্তি আমরা বল/আমরা ছাত্রদল।/মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান/ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।/আমরা ছাত্রদল।।’-(ছাত্রদলের গান)। দেখা যায়, সব যুগেই ছাত্রদেরকে বলিদান করা হয়। বিপথে নিয়ে দাবি আদায় থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়। তারুণ্যশক্তিকে সবাই ভয় পায়। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উল্লেখিত কবিতায় বলেন:-‘মোদের কক্ষ্যচ্যুত ধূমকেতু-প্রায়/লক্ষ্যহারা প্রাণ,/আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর/নিত্য বলিদান।/যখন লক্ষ্ণীদেবী  স্বর্গে ওঠেন/আমরা পশি নীল অতল।/আমরা ছাত্রদল।।' ছাত্রদের কল্যাণেই ইতিবাচক বিশ্ব দেখা সম্ভব। কবি ছাদলের প্রতিনিধি হিসাবে কবিতাটির শেষে বলেন- ‘আমরা রচি ভালোবাসার/আশার ভবিষ্যৎ,/মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়/আকাশ-ছায়াপথ।/মোদের চোখে বিশ্ববাসীর/স্বপ্ন দেখা হোক সফল।/ আমরা ছাত্রদল।।'

কোরাসমূলক কবিতা হচ্ছে ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’। ব্রিটিশ শাসনে সমাজে নানা অন্যায় বিরাজমান। দ্যোদুল্যমান নিয়ম-নীতি। সংকটাপন্ন জাতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বাঙালিকে জাগাতে চেয়েছেন কবি নজরুল। ‘কাণ্ডারী গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার/লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।/দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,/ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?/ কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।/এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার...।’ এই কবিতায় অনুপ্রাসের দারুণ প্রয়োগ করেছেন কবি। অবশ্য কবি নজরুলের এমন অনুপ্রাসের ছড়াছড়ির ঝলক দেখিয়েছেন অনেক কবিতায়। নজরুল এখানেও অনন্য। রূপকধর্মী এ কবিতায় জাতিকে উত্তরণ করাতে চেয়েছেন। ‘প্রার্থনা’' কবিতাটির ফর্ম ব্যতিক্রম। গানের মতো এটি। ‘এস যুগ-সারথি নিশঙ্ক নির্ভয়/এস চির-সুন্দর অভেদ অসংশয়/জয় জয়।/জয় জয়।...’। 'ছাত্রদলের গান' কবিতাটিও ব্যতিক্রম। অনেকে ছড়া হিসাবেও বিবেচনায় এনে থাকেন। শৈশবের জনপ্রিয় কবিতা হচ্ছে ‘ছাত্রদলের গান’।

 

‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতাটি তো নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকর্ম, সমালোচনার ফিরিস্তি। এটাকে নজরুলের ‘ইস্তেহার’ও বলা যায়। ‘‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,/কবি ও অকবি যাহা বল মোরে মুখ বুজেঁ তাই সই সবি!/...কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো, ফের যেন তুই যাস জেলে।/গুরু ক’ন তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাচাঁ।/প্রতি শনিবারই চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন তুমি, ‘হাড়িঁ চাচাঁ’।/আমি বলি, প্রিয়ে ‘হাটে ভাঙ্গি হাড়িঁ-/অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।/সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা কন ‘আড়ি চাচা’।/যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুজিঁ টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা।/মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘‘মোল্লারা’’ কন হাত নেড়ে,/‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।/...‘আমপারা’ পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে।’/হিন্দুর ভাবে, ‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে।’/...প্রার্থনা ক’রো- যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,/যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!’’- ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় কবি নজরুলের মানস-চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। এই কবিতায় তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার চেতনতা, কবিতায় ফার্সি-আরবির ব্যবহার, বিভিন্ন ধর্মের তথাকথিত মোড়লদের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ পাওয়া যায়। কবি কবিতা-গান-গজল লেখেন সেটাও পাওয়া যায়। কবি যে জেল খেটেছেন, আবার এমন লিখলে জেলে যেতে হতে পারেন তার শঙ্কাও করেছেন। অন্যেদের চোখে তা দেখিয়েছেন। এত কিছুর পরেও তিনি মানবতাকে উচ্চে তুলে ধরেছেন। মানুষের গ্রাস যারা কেড়ে নেয় তাদের প্রতি অভিশাপ করেছেন। এসব বিষয়গুলো আলোচনা করলেই কবির সাহিত্যকর্ম ও জীবনী আলোচনা করা সম্ভব হবে।

 

‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে বিভিন্ন পেশার মানুষ ও তাদের অধিকার নিয়ে লেখা হয়েছে। ধীবরের গান, শ্রমিকের গান, কৃষাণের গান-এমন নামীয় কবিতাগুলো বিভিন্ন পেশার জয়গান করা হয়েছে। ব্রিটিশ শাসক ও মহাজন কর্তৃক শোষণ-বঞ্চনার কথা বলা হয়েছে। তাদের দাবি নিয়ে সোচ্চার হতে বলা হয়েছে। কবি নজরুল এসব দাবি বা অধিকার আদায়ে একাত্মতা প্রকাশ করে কবিতায় রূপ দিয়েছেন। এমন সব কবিতায় কবির সাম্যবাদী রূপ প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে।

 

আবু আফজাল সালেহ ‍
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top