সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

কোন লেখক কীসে লিখতেন : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:৪৬

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৯:৩২

 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণত ‘পাইলট’ কলম কালির দোয়াতে চুবিয়ে চুবিয়ে লিখতেন। পাইলটই ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কলম। ‘পথের পাঁচালি’ লেখা শুরু করেন ওইভাবেই। তবে উপন্যাসটি শেষ করেন ওই কলমে নয়, পরে কেনা একটি ‘পার্কার’ কলমে।
তাঁর ডায়েরি থেকে জানা যায়, ‘পথের পাঁচালি’ শেষ করার পর তাঁর মনে হয়েছিল পরের দিকে ‘পার্কার’ কলম দিয়ে উপন্যাসটি লেখার জন্য ‘পাইলট’ কলমটি হয়তো কিছু মনে করেছে।
তখন তিনি তাঁর ডায়েরির এই অংশটুকু লিখলেন সেই পুরনো ‘পাইলট’ কলমটি দিয়েই। আর সে লেখা শেষ করলেন এই ভাবে--- ‘এই কথাগুলো লিখলুম আমার পুরনো কলমটা দিয়ে। যেটা দিয়ে বইখানা লেখার শুরু। শেষ দিকটাতে পার্কার ফাউন্টেন পেন কিনে নতুনের মোহে একে অনাদর করেছিলুম। ওর অভিমান আজ আর থাকতে দিলুম না।’ এই না হলে কলম-প্রীতি!

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোটা নিবের শক্ত ও দামী কলম ছিল পছন্দের প্রথম তালিকায়। কারণ চাপ দিয়ে লেখার অভ্যেস ছিল বলে নিব ভোঁতা হয়ে যেত। আঙুলে কড়াও পড়ত। তবে পছন্দের কলম ছিল ‘শেফার্স’। একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তারাশঙ্করের। তিনি একটি কলম দিয়ে একটি মাত্র উপন্যাসই লিখতেন। তার পরে সেই কলম আর ব্যবহার করতেন না। যত্ন করে তুলে রাখতেন।
'গণদেবতা' লিখেছিলেন ‘পার্কার’ কলম দিয়ে। ভোরবেলায় স্নান করে নিয়ম করে লিখতে বসতেন। নিজের লেখার টেবিলে প্রথমে সাদা কাগজে নীল রঙের সুলেখা কালি দিয়ে খুব ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরে এক হাজার বার মা কালীর নাম লিখে তার পরে লেখার কাজ শুরু করতেন।

বুদ্ধদেব বসুরও প্রিয় কলম ছিল ‘শেফার্স’। তবে তাঁর সংগ্রহে ছিল ‘পার্কার’, ‘ওয়াটারম্যান’ ও ‘মঁব্লঁ’-এর মতো ডাকসাইটে কলমও। কালির রং হিসেবে তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল কালো। জিজ্ঞাসা পত্রিকার সম্পাদক শিবনারায়ণ রায় অনেক ঝঁক্কি সামলে একবার অস্ট্রেলিয়া থেকে তাঁকে দু’বোতল কালো কালি এনে দিয়েছিলেন। সে কালি তিনি অত্যন্ত ‌কৃপণের মতো খরচ করতেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের টানাটানির সংসার ছিল। লিখে আর কত টাকা পাওয়া যায়! তার ফলে কলম-বিলাস তাঁর ছিল না। একবার উপহার পান একটি ‘সোয়ান’ কলম এবং প্রেমে পড়ে যান সেই কলমের। পরবর্তিকালে বিস্তর লেখালিখি করেছেন সেই কলম দিয়ে। লিখতে লিখতে এক সময় কলমের দফারফা। নিব, জিপ সব বেরিয়ে এসেছিল। সুতো দিয়ে বেঁধে সেই কলমেই তিনি লিখে যেতেন। এমনই ভালবাসতেন সেই কলমকে।

নীহারঞ্জন গুপ্ত তাঁর সাহিত্য জীবন শুরুই করেছিলেন 'শেফার্স’ কলম দিয়ে। প্রথমবার যখন রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি হন, তখন তিনি বিশ্বকবিকে অনুরোধ করেছিলেন সেই কলমটি দিয়ে কিছু লিখে দিতে। কবি লিখে দিয়েছিলেন--- ‘তুমি অনেক বড় হবে।’ সে কলম আজীবন সঙ্গে ছিল তাঁর।
প্রখ্যাত গোয়েন্দা ঔপন্যাসিক আগাথা ক্রিস্টির সঙ্গে একবার ইংল্যান্ডে দেখা করেছিলেন তিনি। লেখিকা তাঁকে একটি কলম উপহার দিয়েছিলেন। সেই কলমও আজীবনের সঙ্গী ছিল তাঁর। সেই কলম দিয়ে বহু উপন্যাস লিখেছেন।
আরও একটি কলমও তাঁর আজীবনের সঙ্গী ছিল। তাঁর লেখা ‘মায়ামৃগ’ অবলম্বনে হওয়া নাটক যে দিন ৫০০ রজনী পার করল, সে দিন তাঁকে সোনার নিব বসানো একটি কলম উপহার দেওয়া হয়। সেটাও ছিল তাঁর অতি প্রিয় কলম।

সত্যজিৎ রায় ইংরেজি লেখার জন্য টাইপরাইটার ব্যবহার করতেন ঠিকই, তবে বাংলায় একটি শব্দ লিখতে হলেও ঝরনা কলম হাতে তুলে নিতেন। তাঁকে কখনও ডট পেন ব্যবহার করতে কেউ দেখেননি। অবশ্য তাঁর আমলে যে সব ডট পেন ছিল সে সব পেনের কালি খুব তাড়াতাড়িই শুকিয়ে যেত। ফলে খুব সমস্যা হতো। কলম থেকে রিফিল বের করে দু'হাতের তালুতে রেখে ঘষতে হত। কখনও কখনও পুরো রিফিলটা মোমবাতির শিখায় ধরে একবার এ দিক আর একবার ও দিক করতে হত।
কলম ছাড়াও তাঁর পছন্দ ছিল দামি সাদা ফুলস্কেপ কাগজ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রকমারি ফাউন্টেন পেনে লিখে গেছেন তিনি। লাইনের ওপরে-নীচে
যথেষ্ট ফাঁক থাকত। অক্ষর হত বেশ বড় বড়। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুর বর্ণটি তিনি লিখতেন নীল, বেগুনি, সবুজ, অথবা খয়েরি রঙের কালিতে। প্রত্যেকটি আলাদা। পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটি প্রায় থাকতই না। ফাঁকে ফাঁকে পরিমার্জনা করতেন লাল কালিতে।

রমাপদ চৌধুরী প্রথম গল্প লেখেন জাপানি পাইলট কলম দিয়ে। ১০ বছর ধরে ওই কলমেই লিখেছেন। তার পর লিখতে শুরু করেন ‘শেফার্স’ দিয়ে। তখন থেকেই তিনি সেই কলমের প্রেমে পড়ে যান।
একবার ট্রামে যাওয়ার সময় সেই সাধের কলমটি পকেটমারি হয়ে যাওয়ায় তিনি এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে, ‘শেফার্স’ দিয়ে লেখাই ছেড়ে দেন।
পরবর্তিকালে আমেরিকা থেকে তাঁর বড় জামাই তাঁকে একটি ‘শেফার্স’ পেন এনে দেন।
তিনিও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই একটি কলম দিয়ে কখনও দুটি উপন্যাস লেখেননি। তাঁর মনে হত, একই কলমে লিখলে নতুন উপন্যাসে আগের উপন্যাসের প্রভাব চলে আসবে। উপন্যাস লেখা শেষ হয়ে গেলেই সেই কলমগুলোকে তিনি অতি যত্ন করে রেখে দিতেন।
মৃত্যুর ক'দিন আগেই যে কলম দিয়ে তিনি 'বনপলাশীর পদাবলী' লিখেছেন, 'লালবাঈ' লিখেছেন এবং 'খারিজ' লিখেছেন, সেই তিনটি কলম তিনি দিয়ে যান আমার একমাত্র ছেলে শুভঙ্কর সিংহকে। যে কলম দিয়ে সে লিখেছে--- 'গড : এনসিয়েন্ট এলিয়েন অর আ মিথ?' ২৬ পাউন্ড বা ২৯ ডলার কিংবা ভারতীয় মুদ্রায় ৮০০ টাকা দামের যে বইটি মুড়ি-মুড়কির মতো বিকিয়েছে। প্রথম চার মাসে বিক্রি হয়েছে ৮০ হাজারেরও বেশি কপি।

সমরেশ বসুর এক বন্ধুর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া ‘শেফার্স’ কলমটির প্রতি ছিল নিদারুণ মুগ্ধতা। ওই কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে পাঠকের হৃদয় জয় করা অজস্র লেখা। তবে এর পাশাপাশি ‘পার্কার’ কলমও তিনি পছন্দ করতেন।
ফুলস্কেপ কাগজে চমৎকার হস্তাক্ষরে তিনি যখন পাতার পর পাতা লিখে যেতেন তখন তা ছিল দেখবার মতো। তাঁর লেখা প্রতিটি পাতায় থাকত প্রায় ৪০টি করে লাইন। শব্দ সংখ্যা থাকত কমবেশি ৬০০ থেকে ৬৫০।
তবে তিনি বল পেনেও লিখতেন। ডান দিকে হেলে থাকা সারিবদ্ধ অক্ষরগুলোকে দেখে মনে হত যেন ধান বিছিয়ে রেখেছেন। কালো কালিতে লিখতেন, কখনও কখনও নীল কালিতেও। লিখতেন বেশ দামি কাগজে।

বুদ্ধদেব গুহর কলমের প্রতি ছিল অসম্ভব ভালবাসা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামীদামি কোম্পানির দামি দামি পেন সংগ্রহ করতেন। সেই পেন রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য দু'জন লোকও ছিল এবং প্রথম কারও সঙ্গে আলাপ হলেই তিনি তাকে একটি কলম উপহার দিতেন।
বত্রিশ-তেত্রিশ বছর আগে আমার তৎকালীন বস রমাপদ চৌধুরীর নির্দেশে একদিন আনন্দবাজার পত্রিকার পুজো সংখ্যার লেখা আনার জন্য ধর্মতলার অম্বর রেস্তোরাঁ কাম বারের ওপরে তাঁর নিজস্ব চার্টার্ড ফার্মে গিয়েছিলাম। লেখা নিয়ে ফিরে আসার সময় উনি আমাকে একটি শেফার্ড পেন উপহার দিয়েছিলেন।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাছে ডট পেন একেবারে দু’চক্ষের বিষ। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার সময় বাবা তাঁকে একটি ‘পার্কার জুনিয়র’ কলম কিনে দিয়েছিলেন। খুব যত্ন করে রেখেছিলেন সেই কলম। পরবর্তিকালে সেই কলম দিয়ে তিনি প্রচুর লেখা লেখেন।
হঠাৎ একদিন হাত থেকে পড়ে সেই কলমটার নিব ভেঙে যায়। সারানোর পরও আগের ফ্লো আসেনি। কলমের খুব শখ থাকা সত্ত্বেও পয়সার অভাবে তিনি সেভাবে কখনও শখ মেটাতে পারেননি। তবে তাঁর সংগ্রহে এখন মঁব্লঁ আছে।
লেখার জন্য ক্যামেলের কালো রঙের কালিই তাঁর বেশি পছন্দ। নীল রঙের কালি একেবারেই না-পসন্দ। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার কোনও কোনও অক্ষর এক এক জায়গায় এতই ছোট্ট যে, বুঝতে গেলে সময় লাগে। কখনও কখনও আতস কাচের দরকার হয়। বিশেষ করে সেই সব শব্দ, যেগুলো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একেবারেই নিজস্ব সম্পদ।

রবিশংকর মূলত সঙ্গীতের লোক, তাই নিয়ম করে লেখার দরকার পড়ত না। তবে যখন লিখতেন তখন কলম হত কখনও ‘কারঁ দাশ’, কখনও ‘পার্কার ফিফটি ওয়ান’ কখনও আবার ‘পার্কার ডুয়োফোল্ড’। লেখালেখির সময় কখনও অন্য কেউ কলম বাড়িয়ে দিলে উনি মিষ্টি হেসে বুকপকেট থেকে নিজের কলমই বার করে নিতেন।

আর হ্যাঁ, কলকাতার তাবড় তাবড় কবি-লেখক, যাঁরা মূলত ফাউন্টেন পেনে লিখতেন, তাঁদের কলম বিগড়োলেই ছুটে যেতেন লিন্ডসে স্ট্রিটের পেন হসপিটালে। বাদশার পাশেই ছিল ছোট্ট সেই কলমের দোকানটি। পেন সারানোর পাশাপাশি তাঁরা কলমও বিক্রি করতেন। তবে ঝরনা কলম ছাড়া অন্য কোনও কলম তাঁরা বিক্রি করতেন না।

সঞ্জীবদা, মানে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়েরও ছিল ঝরনা কলমের প্রতি দুর্বলতা। আসলে তখন যাঁরা লেখালেখি করতেন, তাঁদের প্রত্যেকেই ঝরনা কলম দিয়েই লিখতেন।
একদিন বিকেলের দিকে সঞ্জীবদা আমাকে বললেন, চল, একবার লিন্ডসে স্ট্রিটে যাব। আমাকে একটা ভাল কলম এনে দেবে বলেছে।
সেই আমার প্রথম ‘পেন হসপিটাল’ যাওয়া।

একজনের কলমে সমস্যা দেখা দিলেই চা খাওয়ার নাম করে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তেন। আর কেউ না যান, নীরেনদা, মানে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং রমাপদ চৌধুরী, যাঁরা ছিলেন একেবারে হরিহর আত্মা, তাঁরা দু'জনে টুকটুক করে চলে যেতেন পেন হসপিটালে।
আমিও তাঁদের সঙ্গে দু'-চার বার গিয়েছি। এবং গিয়ে বুঝেছি, শুধু কলম সারানো নয়, কলম কেনাও নয়, কলমের অজুহাতে তাঁরা আসলে অনাদি কেবিনে কবিরাজি কাটলেট খেতে আসেন। সে গল্প অবশ্য অন্য।
লেখক মাত্রেরই যে কলম নিয়ে অবসেশন থাকে, তা কিন্তু নয়। এমন অনেক কবি-সাহিত্যিক আছেন, যাঁরা কলম নিয়ে কখনও মাথাই ঘামান না। হাতের সামনে যে কলম পান সেই কলমেই লেখেন।
যেমন, আশাপূর্ণা দেবীর বিশেষ কোনও কলমের প্রতি সে রকম টান কখনও ছিল না। বরং তাঁর পছন্দ ছিল কালির প্রতি। তাঁর প্রিয় কালি ছিল ‘কুইঙ্ক’। তিনি টেবিল চেয়ারেও লিখতেন না। তাঁর লেখার প্রিয় জায়গা ছিল বিছানা। কারণ তিনি উপুড় হয়ে আধশোয়া অবস্থায় লিখতে ভালবাসতেন।
প্রতিভা বসুও কলম নিয়ে কখনও মাথা ঘামাতেন না। হাতের কাছে যা পেতেন তা-ই দিয়েই একের পর এক লেখা লিখে যেতেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পছন্দ করতেন দামি কাগজ, দামি কলম নয়। তাই ‘দেশ’ পত্রিকার সাদা ধবধবে দামি লেটারহেডে পাতার পর পাতা লিখে যেতেন এলেবেলে যে কোনও পেন দিয়ে। এমনকী ডট পেন দিয়েও।
হুমায়ুন আহমেদেরও কলম নিয়ে কোনও প্যাশন ছিল না। তিনি লিখতেন অতি সাধারণ বল পেনে। যদিও তিনি প্রচুর দামি দামি কলম উপহার হিসেবে পেতেন।
বিশেষ কোনও কলমের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাক বা না থাক, বিশেষ বিশেষ কাগজের প্রতি কারও কারও ছিল অত্যন্ত আগ্রহ। সন্তোষকুমার ঘোষ লিখতেন নিউজ প্রিন্ট দিয়ে তৈরি প্যাডে। তখন যেহেতু নিউজ প্রিন্টেই খবরের কাগজ ছাপা হত এবং সেই কাগজের প্যাডেই খবর লেখার চল ছিল, তাই খবরের কাগজে কাজ করার সুবাদে, তিনি তাঁর গল্প, উপন্যাসও খুব কম দামি, পুরনো কাগজের মতো দেখতে ওই নিউজ প্রিন্টেই লিখতেন। বাজে কাগজ বলেই হয়তো পাণ্ডুলিপির গায়ে তিনি আতর বা সেন্ট মাখিয়ে দিতেন। তবে নিন্দুকেরা বলাবলি করত, ওটা নাকি ছিল মহিলা কম্পোজিটরদের প্রতি তাঁর সুগন্ধ-উপহার!
তবে বাড়িতে যখন লিখতেন, তিনি কিন্তু সাদা ধবধবে কাগজেই লিখতেন। এটা আমি নিজের চোখেই দেখেছি। কারণ তাঁর ছেলে সায়ন্তন ঘোষ, ওরফে টিটো, যে এখন বর্তমান পত্রিকার এম. ডি. সে ছিল আমার কলেজের বন্ধু। ওর সঙ্গে আমি প্রায়ই ওদের নিউ আলিপুরের বাড়িতে যেতাম।
বিমল কর ও রমাপদ চৌধুরী লিখতে পছন্দ করতেন ল্যাব কপি বা প্র্যাকটিক্যাল খাতার কাগজে। মসৃণ ও ঝকঝকে সে কাগজের এক দিকটা থাকত সাদা আর অন্য দিকটা রুল টানা। এটা ওঁরা নিজেরাই লেটারপ্রেস থেকে ছাপিয়ে নিয়ে আসতেন।
তবে মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন আগে প্রকাশিত রমাপদ বাবুর 'হারানো খাতা' বইটির পাণ্ডুলিপি কিন্তু ওই কাগজে লেখা নয়। দু'পিঠ সাদা সাধারণ কাগজে লেখা। কারণ চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ওই পাণ্ডুলিপিটি আমি আমার বইয়ের আলমারি পরিষ্কার করতে গিয়ে হঠাৎ একদিন খুঁজে পাই। পেয়েই, রমাপদ বাবুকে পৌঁছে দিয়েছিলাম। সম্পাদনাও করেছিলাম আমি। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসেবে বেরিয়েছিল সেটি। পরে বই হয়ে বেরোয় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। সেই বইয়ের ছ'পাতা জুড়ে লেখা দীর্ঘ ভূমিকায় উনি শুধু আমার কথাই লিখেছেন।
সমরেশ মজুমদার ঝড়ের বেগে লেখেন। পাণ্ডুলিপি দেখলেই তা বোঝা যায়। তবে পড়তে অসুবিধে হয় না। তবে উনি কখনও 'নিয়ে আয়' লেখেন না। লেখেন 'নিয়ায়'।
আমাকে প্রধান চরিত্র করে, নায়কের নাম 'সিদ্ধার্থ সিংহ' দিয়েই আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে উনি যে ধারাবাহিক উপন্যাসটি লিখেছিলেন, সেই উপন্যাসটিতেই এর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।
মহিলা হলেও বাণী বসু বা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের পাণ্ডুলিপি মেয়েলি ধরণের নয়। লেখার ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ সতর্ক। মনে আছে, আমি তখন প্রত্যেক রবিবার সুচিত্রাদির বাড়িতে যাই। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে, একটু ভাতঘুম দিয়ে ওখান থেকেই সন্ধেবেলায় অফিসে যাই।
একদিন গিয়ে দেখি, কুণালদারা বাইরের ঘরে। ভিতরঘরে সুচিত্রাদি লিখছেন। আমি সুচিত্রাদিকে ডাকতে যাচ্ছিলাম, কুণালদা বললেন, ওকে ডাকিস না।
কেন? প্রশ্ন করতেই উনি বললেন, ওর ভাই গুরুতর অসুস্থ। যে কোনও সময় খারাপ খবর আসতে পারে। তাই ও পুজোর লেখাটা আগেভাগে শেষ করে দিতে চায়। ও বলে গেছে, যদি কোনও চরম দুঃসংবাদও আসে, লেখাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন আমরা ওকে সেটা না জানাই।
আমি জানতাম, ওই ভাই ছিল সুচিত্রাদির অত্যন্ত আদরের। এত ভালবাসতেন তাকে, তবু! আমি অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম, একেই বলে লেখার প্রতি লেখকের ডেডিকেশন।
আর বাণীদি যে কী অবস্থার মধ্যে লেখেন, যাঁরা বাণীদিকে চেনেন, তাঁরাই একমাত্র জানেন।
শঙ্খ ঘোষের পাণ্ডুলিপি পরিচ্ছন্নতার জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেতে পারে। কারণ, তাঁর পাণ্ডুলিপিতে কোনও কাটাকুটি থাকত না।
আর জয় গোস্বামীর পাণ্ডুলিপি শঙ্খ ঘোষের একদম উলটো। বিস্তর কাটাকুটি। প্রায় প্রতিটি লাইনেই সংযোজন বা বাতিল। এমনকী পাতায় লেখা বসে যাওয়ার পরেও দেখেছি, দু'-চারটি শব্দ পাল্টানোর জন্য তাঁর সে কী আকুতি।

এ বার আসা যাক বিদেশি লেখকদের কথায়। আলেকজান্ডার দ্যুমা কল্পকাহিনি লিখতেন নীল কাগজে। কবিতা লিখতেন হলুদ কাগজে আর প্রবন্ধ লিখতেন গোলাপি কাগজে।
হ্যারি পটারের লেখিকা জে কে রাওলিং পুরনো আমলের কলম ও পুরনো লালচে হয়ে যাওয়া কাগজ ছাড়া লিখতেনই না।
বিখ্যাত আমেরিকান লেখক জন স্টেইনবেক ছিলেন পেনসিলের মহাভক্ত। নতুন কিছু লেখা শুরু করার আগেই সামনে গুনে গুনে ২৪টা চোখা চোখা পেনসিল রাখতেন। একটা ভোঁতা হওয়া মাত্রই আরেকটা নিয়ে লিখতে শুরু করতেন।
গোয়েন্দা শার্লক হোমসের লেখক আর্থার কোনান ডয়েল লিখতেন ১৯২১ সালে বানানো ‘পার্কার ডুয়োফোল্ড’ নামের একটি কলম দিয়ে।
ওয়েলসের জাতীয় কবি ডিলাস থমাসও ‘পার্কার’ ব্র্যান্ডের কলম ছাড়া লিখতেন না। তাঁর ভীষণ পছন্দ ছিল ‘পার্কার ৫২’।
রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক ভ্লাদিমির নভোকভ লিখতেন ‘ব্ল্যাকউইং ৬০২’ মডেলের পেনসিল দিয়ে।
‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নোতরদাম’ লেখার আগে ভিক্টর হুগো নিজেকে গৃহবন্দি করে ফেলেছিলেন। দোকান থেকে এক বোতল কালি কিনে এনেছিলেন। তার পর মাসখানেকের খাবার জোগাড় করে জামাকাপড় সব একটা আলমারিতে তালা মেরে, সেই চাবি জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। যাতে তিনি বাইরে বেরোতে না পারেন। বইটি লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সত্যি সত্যিই উনি ঘর ছেড়ে বেরোননি।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top