সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

ইচ্ছে : অমিতা মজুমদার


প্রকাশিত:
১২ নভেম্বর ২০২১ ০১:১০

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ০২:১২

 

অর্পার যে আজকাল কি হয়েছে সে নিজেই বুঝতে পারে না। যখন তখন তার মনের মধ্যে নানারকম উদ্ভট ইচ্ছা জেগে ওঠে। কোনো কোনো ছুটির দিন সকালে মন চায় নিত্যকার একঘেয়ে রুটি আর সবজি দিয়ে নাস্তা না করে অন্য কিছু খেতে। এই যেমন লুচি আলুরদম, নয়তো ঘিয়ে লাল করে ভাজা গরম গরম পরোটা আর ঘন দুধ দিয়ে করা চায়ের একটা মগ নিয়ে বসে আয়েশ করে খেতে খেতে পত্রিকার সাহিত্য পাতায় চোখ বুলাবে। কখনো ইচ্ছে হয় সেই ছোট্টবেলার মতো একটা সুগন্ধি বোম্বাই মরিচ দেয়া ধোঁয়া ওঠা খুদের ভাত থালায় নিয়ে খেতে খেতে মনে মনে দেশ-বিদেশ ঘুরে আসার খেলাটা খেলবে একা একাই। কোনোদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতো মা বড়ো একটা গামলায় মইলা (খই ভাজলে যে আধা ভাজা ধান থাকতো সেগুলো ঢেঁকিতে কুটে পরিস্কার করে নেয়া হতো) সেই আধা ভাজা খই ভিজিয়ে রাখা হতো রাতে। সকালে ভিজে ফুলে নরম হয়ে যেত। তাতে নিজেদের ঘন গরুর দুধ, নারিকেল কোরা, আর কাঁঠালি কলা, চিনি বা গুড় দিয়ে সুন্দর করে মেখে সবাইকে বাটিতে বাটিতে দিতেন। তখন এই বিশেষ বস্তুটি তেমন আকর্ষণীয় ছিল না। কিন্তু আজকাল এই মহানগরের শত সহস্র অভিজাত উপাদেয় খাবারের ভিড়ে গ্রাম বাংলার এই সাধারণ খাবারটিই মনে আলোড়ন তুলছে অর্পার। সবাই বলতে পারে ইচ্ছে যখন করে তখন বানিয়ে খেলেইতো হয়। কে বারণ করেছে এই সামান্য ইচ্ছে পূরণ করতে ! না কেউ বারণ করেনি। কিন্তু অর্পাকে এসব করে দেবে কে? অর্পা তার অশক্ত শরীর নিয়ে যে কিছুই করতে পারে না। আর অখিলেশ! সেতো ভাবতেই পারে না এরকম ইচ্ছা কোনো মানুষের মনে জাগতে পারে !
শয্যাশায়ী হবার আগেও এই বেহিসেবী ইচ্ছেগুলো অনবরত তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। আর সে নিয়ে ঘরে বাইরে তাকে হেনস্থাও কম হতে হয়নি। তবুও তার ইচ্ছেগুলো কিছুতেই মরে যায়নি।
মাঝে মাঝে শেষ বিকেলের আলোটুকু যখন যাই যাই করতো ঠিক তখন অর্পার ইচ্ছে হতো ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে রাস্তায়। একটা খোলা রিক্সায় চলতে থাকবে অজানা গন্তব্যে। বিকেলের হিম হিম বাতাসে অর্পার সাদা কালো চুলের দু’একটা উড়ে উড়ে পড়বে ওর কপালে গালে। সেদিকে খেয়াল না করেই বকবক করে যাবে অর্থহীন সব কথা। হয়তো সে কথার বেশিরভাগই থাকবে তাদের সোনালী অতীতের আবোল তাবোল স্মৃতি। কখনো বা আউড়ে উঠবে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ। সাথের মানুষটি অপলক চেয়ে থাকবে তার দিকে সেই আগের মতো। আলতো করে কপাল থেকে সরিয়ে দেবে অবাধ্য চুলগুলোকে। মাঝে মাঝে গলা মিলাবে অর্পার সাথে সেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গানে।
কখনো কখনো ইচ্ছে করতো একা একাই বেরিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশের পানে। কিন্তু সেতো কল্পনায় সম্ভব । বাস্তবে সংসার সংসার খেলায় মেতে ওঠা অর্পাদের জীবনে তেমন ইচ্ছাপূরণের সুযোগ ঘটে না।
কোনোদিন দুপুরবেলা আলসেমিতে পেয়ে বসতো অর্পাকে। তার ইচ্ছে করতো না দুপুরের খাবার খেতে। খাবার খেতে হলে রান্না করো, খাবার পরিবেশন, থালাবাসন গুছানো, টেবিল পরিস্কার করো। রোজ রোজ হাজারটা ঝক্কি ঝামেলা করতে কার ইচ্ছে করে। মনে মনে ভাবতো ইশ অখিলেশ যদি আজ বলতো, চলো দুজনে বাইরে কোথাও খেয়ে আসি। কত ভালো হতো। সে গিয়ে রানীর মতো বসতো টেবিলে। নানারকম খাবার সাজিয়ে রাখত তার সামনে, সে তৃপ্তি করে খেতো তারপরে কেউ এসে সব পরিস্কার করে নিতো। কিন্তু অখিলেশ সে কথা মনেও আনবে না। বড়জোড় বেশ আয়েশ করে বাজার করে এনে খুব গদ্গদ ভাবে অর্পাকে বলবে দেখো তোমার জন্য বাজারের সব থেকে বড় ইলিশটা এনেছি। এরকম পাবদা মাছ কেউ কিনবে না এত দাম দিয়ে। বলাই বাহুল্য রান্নাটা অর্পাকেই করতে হবে। আর অর্পা রাঁধতে গিয়ে ঠিক ভাববে অখিলেশ সর্ষে ইলিশ খেতে পছন্দ করে, পাবদা মাছের পাতলা ঝোল পছন্দ অখিলেশের। বাস হয়ে গেল অর্পার ইচ্ছেপূরণ !
এই এত বছরে অর্পা অখিলেশের কাছে এমনটা যে আশা করা ঠিক না তা বুঝে গেছে। কিন্তু অর্পা যে চিরকাল একটুখানি দলছুট। তাইতো তার মনে হয় যখন সে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয় তখন কি অখিলেশ পারে না পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে আজ না গেলে হয় না? অন্তত একদিনের জন্য হলেও এমন আবদার অখিলেশ করতেই পারতো। এইতো সেদিন যখন বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য সেজেগুজে বের হয় ছেলে মেয়ের চোখ এড়িয়ে অখিলেশ চুপিচুপি বলতেই পারতো আজো তোমাকে দেখে বুকের মধ্যে সাগরের উথালপাতাল ঢেউ ওঠে।
অর্পা ভাবে একটা দিন কি অকারণে হেসে ওঠা যায় না তাতে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে এমন কি মহা প্রলয় ঘটে যাবে ! অর্পার এমন খামখেয়ালী ইচ্ছেগুলোর যেন নেই কোনো লাগাম। হয়তো কোনো এক ঘনবর্ষার রাতে ওর ইচ্ছে হয় সারা রাত জেগে অখিলেশের সাথে গল্প করলে কেমন হয়? কিন্তু সেতো জানে অখিলেশ কেমন ঘুমকাতুরে। আর ঘুমের সময় তার ্কোনো হুঁশ থাকে না। তার সঘন নাসিকা গর্জন অর্পাকে সতর্ক করে দেয়। তাই তাকে বিরক্ত করা হয়ে ওঠে না।
মাঝে মাঝে নিজের উপর বেশ রাগ হয় তার এই বেহিসেবি ইচ্ছেগুলোর জন্য। সীমা, রাজিয়া, কল্পনাদের সাথে এসব কথা বলতেও পারে না। ওরা কেউ এমন ইচ্ছার কথা কখনো বলে না। ওরা বলে এখন আমাদের বয়েস হয়েছে আমাদের কি এরকম করা সাজে ! সবার কথার মধ্যে কি সুন্দর গঠনমুলক চিন্তাভাবনা। কেউ বলে ছেলের জন্য কেমন বৌ আনবে, কেউ বলে নাতিটাকে নিয়ে তার চিন্তার অন্ত নেই। আবার কেউ বলে তিন বেলা নিজেই হাত পুড়িয়ে রান্না করে কারণ তার কর্তা অন্য কারো হাতের রান্না কিছুতেই মুখেই তুলতে পারে না। কারও রাতে কর্তার পায়ে মালিশ করে দিতে হয় যাতে একটু আরাম করে ঘুমাতে পারে। এরকম কথার মাঝে এদের নিজের মনের কোন ইচ্ছে আছে কী না তা খোঁজার চেষ্টা করে অর্পা। কিন্তু পায় না। তাই নিজের কথা আর বলে না। প্রথমদিকে ওদের সাথে গল্প করতে গিয়ে জানতে চাইতো সারাদিন খাটাখাটনির পর রাতে ওদের ইচ্ছে করে না বিছানাটা কেউ করে রাখুক। মশারিটা টানিয়ে ঠিকমতো গুঁজে কেউ অপেক্ষা করুক ওদের জন্য। তাতে সবাই এমন হাহা করে উঠলো যে সে যেন কোন সৃষ্টিছাড়া কথা বলেছে।
পঞ্চাশ পেরিয়ে এসেও সে যখন রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ দেখে থমকে দাঁঁড়ায় তখন বন্ধুরা বিরক্ত হয়। বন্ধু কথাটায়ও অনেকেরই আপত্তি অর্পা মেয়ে। মেয়েদের আবার বন্ধু হয় নাকি? বান্ধবী দু-চারজন থাকতে পারে কিন্তু মেয়ে বা ছেলে বন্ধু কখনো নয়। বৃষ্টি এলেই কিশোরির মতো বর্ষায় ভিঁজতে চায় বলে নেচে ওঠে, তখন চারপাশে কেমন বিদ্রুপের হাসি শোনে। আবার পথ চলতে গিয়ে অকারণে থেমে গিয়ে সাথিদের বলে ওঠে চলো না সবাই মিলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা আর সিঙ্গাড়া খেয়ে আসি। তখন পাশ থেকে হেঁটে যাওয়া তরুণ তরুণী বাঁকা চোখে ফিরে চায়।
তবুও এইসব ইচ্ছেরা অর্পার মনের মাঝে অনবরত ঘন্টি বাজাতে থাকে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top