সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

অতীন্দ্রিয়বাদ : সৌম্য ঘোষ


প্রকাশিত:
৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০১:২১

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৪১

ছবিঃ সৌম্য ঘোষ

 

‘মিষ্টিসিজম’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ অতীন্দ্রিয়বাদ বা মরমিবাদ। অতীন্দ্রিয়বাদ হচ্ছে এমন এক গূঢ় তত্ত্ব যা স্রষ্টা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্থাৎ 'সর্বত্রই বিরাজমান তাঁর অস্তিত্ব' সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি। বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মমত, যথা– হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিষ্টান, ইহুদি, ইসলাম প্রত্যেকটিতে অতীন্দ্রিয়ের চর্চা অদ্যাবধি চলে আসছে। পথ, মত ও পদ্ধতি হয়তো ভিন্ন, কিন্তু উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এক। আর এর প্রভাব বিশ্বের প্রচলিত সব ভাষার সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা ও গানে অতি উজ্জ্বল ও সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান।
বাংলা সাহিত্যের আদিপর্ব অর্থাৎ চর্যাপদ থেকে আধুনিক কাব্য ও সঙ্গীত চিন্তার স্পষ্টতায়, ভাষার স্বচ্ছতায়, উপলব্ধির গূঢ়তায়, মরমি চেতনা এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
মহাকবি দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রূপক কাব্য। এ কাব্যের উপজীব্য:

মানবাত্মার পরমাত্মার সন্ধান

মানবাত্মার বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে স্বর্গলোকে পরিপূর্ণ আত্মিক উপলব্ধি ও মোক্ষলাভ। শেক্সপিয়ার তাঁর নাটকে জীবনের রহস্য অনুধাবন করতে চেয়েছেন। ম্যাকবেথ নাটকে জীবনের সব দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের শেষ অন্তিম মুহূর্তে নায়ক উচ্চারণ করছে জীবনের অসারতা সম্পর্কে:

“It is a tale told by an idiot, full of sound and fury signifying nothing”.

‘স্কাইলার্কের’ কবি শেলী যার কল্পনা উদ্দাম উধাও হয়ে অনন্তে ধাবমান। অমর শিল্পী বিটোফেনের সুর-সৃজনেও সেই একই তন্ময়তা। উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যের মহত্তম কবি মির্জা গালিবের কবিতা :

‘হম কঁহা হোতে, অগর হুসন না হো খুদবী’
আমরা কোথায় থাকতাম যদি রূপ আত্মদর্শী না হতো।

জার্মান সাহিত্যের প্রধানতম প্রাণপুরুষ গ্যেটে, রাশিয়ান কবি পুশকিন, উর্দু সাহিত্যের আল্লামা ইকবাল প্রমুখ দার্শনিক মনীষীরও জীবন সম্পর্কে প্রায় একই জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসাই Mysticism তথা অতীন্দ্রিয়বাদের মূল কথা। বলা যেতে পারে আধুনিক বাংলা কাব্যধারায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিহারীলাল মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন প্রমুখ এঁদের দ্বারাই প্রভাবিত।

‘মিষ্টিক’ শব্দটি এসেছে Mysticism থেকে। ‘সুবরহ’ যার অর্থ ‘চোখ বন্ধ করা’। Mysticism-এর বাংলা প্রতিশব্দ মরমিবাদ। তবে প্রচলিত ব্যবহার অতীন্দ্রিয়বাদ। অতীন্দ্রিয়বাদ এক গূঢ় তত্ত্ব যা স্রষ্টা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান এবং তার উপলব্ধি বোঝায়।

আধ্যাত্ম-বিজ্ঞানের সার কথা: 'আমি কে, আমি কেন?' সাধারণত আমরা মনে করি, আমরা অতিক্ষুদ্র, আমরা অতি সীমাবদ্ধ, আমরা জন্ম-মৃত্যুর অধীন; কিন্তু

:প্রকৃতপক্ষে আমরা বিরাটও বটে অসীমও বটে।'

ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র শিশু যেমন আতঙ্কে কেঁদে ওঠে, বুঝি তার সর্বনাশ হলো। তেমনি আমরাও দুঃখ দৈন্য ও মৃত্যু দেখে শঙ্কাবোধ করতে থাকি।অথচ

'আমি সগুণও বটে নির্গুণও বটে, সসীমও বটে অসীমও বটে।'

অতএব, এই ‘আমি’কে প্রত্যক্ষ করাই higher purpose of our existence.
বিশ্বের প্রায় সব ধর্মের সাধকেরা ‘আমি কে’ প্রশ্ন করে করে মূলে পৌঁছে দেখেছেন স্রষ্টাই সব ‘আমি’। তাঁরই আনন্দময় একটি সুন্দর প্রকাশ মাত্র। স্রষ্টা থেকে আমি পৃথক নই। তাঁর থেকে পৃথক কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। কিন্তু

তাঁকে দেখবার চোখ নেই বলেই আমাদের আত্মার অনন্ত বেদনা ও অবিরাম ক্রন্দন।

'আমি কে?' - এই প্রশ্ন করে যদি নিজেকে জানার চেষ্টা করি তবে দেখব, আমার যত দুঃখ-শোক, দৈন্য, অভাব-অতৃপ্তির মুখ্য কারণ একমাত্র আমিই। আমি-চেতনা যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ আমি ক্ষুদ্র, বস্তুসচেতন ও অতৃপ্ত। এই আমি চেতনা বা আমি-চিন্তা থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টাই হলো Mysticism -এর একমাত্র লক্ষ্য। সম্ভবত এ কারণে বলা হয়েছে,

‘মান আরাফা নাফসাহু, ফাকাদ্ আরাফা রাব্বাহু’
অর্থাৎ যে নিজেকে জানতে পারে, সে তার প্রভুকে চিনতে পারে।

মহামতি দার্শনিক সক্রেটিসও বলেছেন, ‘know thyself ‘। ভারতীয় ষড়-দর্শন তথা বেদান্তের চিন্তানায়ক স্বামী বিবেকানন্দের উক্তি:
"আত্মানং বিদ্ধি” অর্থাৎ নিজেকে জানো। মহামতি গৌতম বুদ্ধেরও প্রায় একই উচ্চারণ: ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’ অর্থাৎ প্রভুর স্মরণেই নির্বাণ। মূলতঃ ইন্দ্রিয়গত দৃষ্টি-শক্তির সীমা খুব বেশি দূরগামী নয়। মরমী সাধকেরা চোখ বন্ধ করে অন্তর্দৃষ্টি ও গভীর চিন্তা-তন্ময়তার দ্বারা সত্য ও সুন্দরকে উপলব্ধি করতে প্রয়াস পান। এই প্রয়াসে মনীষা ও ভাবাবেগের এক প্রকার সংমিশ্রণ ঘটে। এই মিশ্রণের বিচিত্র অনুভূতির প্রকাশ রূপক ও উপমা ছাড়া সম্ভব নয়। এই সহজতত্ত্বের সহজ উপলব্ধি একমাত্র বিশুদ্ধ প্রেমের দ্বারাই সম্ভব।

বাংলা সাহিত্যের আদি যুগের নিদর্শন চর্যাপদ। হাজার বছরের পুরনো আলো-আঁধারি বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোঁহা। চর্যাপদে বৌদ্ধধর্মের গূঢ় সাধন প্রণালী ও মরমীদর্শন-তত্ত্ব নানা প্রকার রূপকের মাধ্যমে আভাসে ইঙ্গিতে ব্যক্ত হয়েছে। ধর্ম-নির্ভর আধ্যাত্মিক ও আত্মগত ভাবানুভূতিপ্রধান বিষয়বস্তু অবলম্বনে চর্যাপদগুলো রচিত। বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্ব-কথাই এতে বিধৃত। জন্ম-মৃত্যু, উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখের দোলা থেকে মুক্তি লাভের এবং সহজ অবস্থার রূপ ‘মহাসুখ-নিবাসে’ পৌঁছানোর ঠিকানার কথা এতে ব্যক্ত হয়েছে। পরমার্থ সত্য উপলব্ধির জন্য বাহ্য অর্থের অবগুণ্ঠনে তত্ত্ব-উপদেশ ও সাধনার ইঙ্গিত এতে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মহাসুখরূপ নির্বাণ লাভই চর্যার প্রধান তত্ত্ব। চর্যাপদের ভাষা শোনামাত্র একরকম অর্থ বোধ হয়, আবার গূঢ়ভাবে চিন্তা করলে রহস্যময় অন্য এক অর্থ প্রকাশ পায়। মূলতঃ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত কি কবিতা, কি গানে Mysticism -এর প্রভাব সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। চর্যাপদের আদি সিদ্ধাচার্য লুইপা বাংলা সাহিত্যের ‘আদি কবি’ বলে আখ্যায়িত। অন্য সিদ্ধাচার্য কানুপা বলছে, ‘ভরকইসে সহজ বোলবা জাই কাঅ বাক চিন জসুন সমাই।’ অর্থাৎ বলো কী করে সহজতত্ত্ব বলা যায়, কায়বাক্য-চিত্ত যাতে প্রবেশ করতে পারে না।
বাংলার আউল, বাউল, মারফতি ও মুর্শিদি গানের মধ্যে হেঁয়ালি কথায় চর্যাপদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব আজও স্পষ্টতর। চর্যাপদের গুঞ্জরী, বঙ্গাল, পটমঞ্জুরী, বরাড়ী, দেশাখ, ধানশী প্রভৃতি রাগ-রাগিণী, বাংলা সঙ্গীতের এই যে গানের ধারা, তা বৈষ্ণব ও শাক্ত পদাবলী থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল পর্যন্ত চলে আসছে।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম গৌরব বৈষ্ণব পদাবলী। পদাবলী সাহিত্য বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাষ্য। সতেরো শতকে বৈষ্ণব সমাজে এবং আঠারো শতকে বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘সহজিয়া’ ধর্মমতের সম্প্রসারণ ঘটে। বৌদ্ধ সহজিয়াদের মতো বৈষ্ণব ও বাউল সাধকরাও সাধনার এই পথ ধরে জীবনের স্বরূপ উপলব্ধিতে বিশ্বাসী। চতুর্দশ শতাব্দীর কবি বড়ু চণ্ডীদাসকে এই মতের উদ্ভাবক ও প্রচারক বলা হয়। ‘রামী’ নামে এক রজকিনীর সাহচর্যে তিনি এই তত্ত্ব-দর্শনের সন্ধান লাভ করেন। এই মতের অনুসারীরা নিজেদের ‘সহজ রসিক’ বা সহজ পথের পথিক মনে করেন। এখানে সহজ-পথ অর্থ প্রেম, যা মানুষের সহজাত ধর্ম। বৈষ্ণব সহজিয়াদের মূল আদর্শ রূপ-প্রেম-আনন্দ। পদাবলী শুধু কবিতাই নয়, গান হিসেবেও এগুলোর বিশেষ মর্যাদা আছে। রূপকাশ্রয়ে ভক্ত ও ভগবানের নিত্য বিরহ মিলনের যে লীলা বৈচিত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়, তাতেই স্বরূপের উপলব্ধি ঘটে। অর্থাৎ লৌকিক পথ ধরে বৈষ্ণব পদাবলী অলৌকিক রসস্বরূপ পরম পুরুষের অনুভূতি মানব হৃদয়ে সঞ্চার করে দেয়।
বৈষ্ণব পদাবলী স্পষ্টতই ভক্তির গান। মর্ত্য-বাসনা জর্জর আদিরসের সাথে ভক্তিরসের এ যে এক সহজ মিতালী। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দ দাস, জ্ঞানদাস প্রমুখের অতুলনীয় পদাবলীতে পৃথিবী ও স্বর্গ, ভক্তি ও ভালোবাসা এক হয়ে গেছে। ইন্দ্রিয়সর্বস্ব জগত থেকে যেন পরিণামে ইন্দ্রিয়াতীত জগতে উপনীত হওয়া।
বিদ্যাপতির ভাষায় :

‘হরি বিনে এ দিবস রজনী কেমন করে কাটবে!’

 

সৌম্য ঘোষ
চুঁচুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top