সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

অন্য রকম ভালবাসা : আফরোজা অদিতি


প্রকাশিত:
৩০ জানুয়ারী ২০২২ ০৩:৪৬

আপডেট:
৭ মে ২০২৪ ২০:০৪

 

আমি নিশি। নাদিমের সঙ্গে আমার ভাব ভালোবাসা। সে আমার অতীত বর্তমান ভবিষ্যত। এক কথায় সর্বস্ব। সে ছাড়া আমি অচল।
নিশি অর্থ রাত্রি। আমার জগতও রাত্রির মত অন্ধকার। আমার এই আঁধার জগতে নাদিমই একমাত্র আশার আলো। তবুও নাদিমকে মাঝেমধ্যেই কষ্ট দেই। কেন দেই তা জানি না। বুঝতে পারি না। ইচ্ছে করে দেই না। মনে মনে ভাবি কষ্ট দেব না, তবুও কষ্ট দেওয়া হয়ে যায়। মাঝেসাঝে ওর উল্টাপাল্টা কথার জন্য রাগও হয়। আমার মেজাজটা খুব বাজে যাকে বলে হট টেম্পার এক্কেবারে আগুন বরাবর। একটুতেই রেগে যাই। কিন্তু শুধু কি আমি? আর কারো হয় না? উল্টাপাল্টা কথা বললে কার না রাগ হয়? কিসে রাগ হয়? এই যেমন আমার রাগ হলে আমি বকবক করি, আবার কষ্ট হলে চুপ করে থাকি। অথচ চুপ করে থাকাটা ওর পছন্দ নয়, আবার রাগ করে বকবক করাটাও পছন্দ নয় ওর।

নিজে কিন্তু এক কথায় হাজার কথা খরচ করে। ওর কথার সারবস্তু খুঁজে বের করা বড় মুস্কিলের ব্যাপার। সেকথা আবার সাহেবকে বলা যাবে না। বললেই মুখটা বাংলার পাঁচ। চোখে আনবে প্রশান্ত মহাসাগর। পুরুষ মানুষ যে এমন কাঁদে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না কেউ! ওর কান্না দেখলে অবশ্য আবার বুকটা চৌদ্দ হাত ফুলে ওঠে। ভালোবাসার মধ্যে যদি ঠোঁটে পুষ্পের হাসি আর চোখে প্রশান্ত মহাসাগর না থাকলো তবে আবার ভালোবাসা হয় নাকি। ভালোবাসার অপর নাম দুঃখ,কষ্ট আর আনন্দ, সুখ।
ভাব এবং ভালোবাসা অর্থহীন প্রলাপের সুবর্ণ ফসল। তবুও মাঝে মাঝে কথা শুনতে ভালো লাগে না। আমারও কথা বলতে ভালো লাগে না। অনুযোগ করে কথা না বলার জন্যে। ওর ধারণা ওর ওপর যখন রাগ হয় তখনই কথা বলি না, চুপ করে থাকি। অথচ তা নয়। আমার ভেতরে কী হয় তা বুঝতে পারি না। মাঝেমধ্যে আমার কিছুই ভালো লাগে না। সংসার, গল্প, মানুষ, কথা কিছুই না! মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে গান শুনি, নাটক দেখি কিন্তু মন স্পর্শ করে না। অনেক দিন আগে একজন বলেছিল আমি নাকি একদিন মনুষ্য সমাজের ভেতর বাস করেও তাদের মধ্যে থাকবো না। মাঝে মাঝে আমারও মনে হয় সত্যি হাস্যকরভাবে সমাজ বহির্ভূত অসামাজিক মানুষ হয়ে যাচ্ছি আমি। নাদিম একজন কথাবিদ। কথা বলে মানুষকে মোহগ্রস্ত করে রাখার ক্ষমতা অপরিসীম। একদিন আমিও প্রাণ খুলে শুনতাম ওর কথা। কিন্তু ইদানিং প্রায়ই কথা বলে না সে। বলে না, নাকি আমার কষ্ট আর সেই কষ্টে ওর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। ও কথা বলে না। নাটক লিখত, নাটক লেখে না, কবিতা, প্রবন্ধ লিখতো তাও বন্ধ। নাটক করতো তাও বন্ধ করেছে। আমার সুখ নাকি হারিয়ে গেছে তাই ওর সবকিছু হারিয়ে গেছে। আমি ছাড়া তাঁর সব কিছুই না কি অচল।

গতকাল নাদিমকে বললাম, অমন করে জীবনটাকে নষ্ট করা উচিৎ নয়। কি এমন হয়েছে যে জীবনের সম্ভবনাকে ধূলায় মিশিয়ে দিতে হবে। আর আমার এই অর্ধেক জীবন নিয়ে যদি সে জীবনে উন্নতি করতে পারে তাই বা সে করে না কেন? হ্যাঁ, তখন খুব রাগ করেছিলাম। আর করবোই বা না কেন? এই যে সময়গুলো জীবন থেকে চলে যাচ্ছে এই সময় আর কী ফেরত পাওয়া যাবে? নাকি কখনও ফেরত পাওয়া যায়! আর প্রিয় মানুষটাকে উন্নতির চরম শিখরে দেখার কার না ইচ্ছে হয়। এটা কি দোষের।

আমি নাদিমকে ভালবাসি। ওকে ফিরিয়ে দিয়ে সংসার করা হলো না। স্বামী সুখ বঞ্চিত হলাম। সেজন্যে আমার কোন অনুশোচনা নেই। প্রেম ভালোবাসা ঈশ্বরের দান। ভালবাসার সময় কেউ ভেবে চিন্তে মন দেওয়া নেওয়া করে না। নাদিমের কি দোষ? ওর
কোনো দোষ নেই। ওর তো প্রিয় সঙ্গ চাই। চাই নিশ্চিত একটা আশ্রয়। একটা প্রতীক্ষিত মানুষের আঁচলের ছোঁয়া, একটু মমতা, একটু ¯েœহ। যেমন আমার চাই একটা সবল বাহুবন্ধনে নিবিড় ¯েœহ মায়া। একটি বৃক্ষ যেখানে নির্ভয় আশ্রয়। দুঃখে সুখে জলে ভেজানো জন্যে একটা বিশাল-বিরাট হৃদয়। আমার সুহৃদ বন্ধু। অথচ নাদিম...................।

আমি এখন একা। আমার ভালো লাগে না যন্ত্রনা, মলিনতা। ভালো লাগে না এই আমার সময়, আমার সকাল, সন্ধ্যা, দুপুর, আমার অবসর আমার কর্ম। আমার এই নিঃসঙ্গতা আর ভালো লাগে না। ভালো লাগে না।
ভালো লাগে না । .............. ক্রিং ক্রিং ক্রিং...........
এই সময়ে কে আবার? টেলিফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। ভালো লাগছে না কথা বলতে এখন!

 

আমি নাদিম। একাকী নিঃসঙ্গ মানুষ। জীবন বৃন্তে ফুটে থাকা সুবর্ণ গোলাপ, আমি তার রূপে মুগ্ধ সৌরভে আকুল হয়েছিলাম। তবুও তাকে আমার বাগানের গাছেই রেখেছিলাম। ডাল থেকে ছিঁড়ে তুলিনি, যদি ঝরে যায়। বুকে রাখিনি যদি মিইয়ে যায়। শুধু ছুঁয়ে দেখেছি। মাঝে মধ্যে গন্ধ নিয়েছি। মাঝে মধ্যে দূর হতে দেখেছি আমার আজন্মের তৃষ্ণাকে। আমার সুখের সাগরকে। আমি ওর বুকের ভেতর ভালোবাসার সুখের নহর দিয়েছি। দুই তীরে সবুজ তরুলতা পুষ্পবীথি সৃজন করেছি। আমি ওকে আমার আকাশে শরতের হাসি করে রেখেছি, বসন্ত করিনি। বসন্ত তো ক্ষণকালের। ওকে দেখলে মন রঙিন হয় খুব কিন্তু কিছুটা পরেই ধুসর করে চলে যায় সে মহা ব্যস্ত হয়ে।

আমার আকাশের ধ্রুবতারা সে। ওকে লক্ষ্য করেই আমি ঘরের দরজা জানালা খুলে পথে নেমেছি আমার গন্তব্যে পৌঁছুব বলে। কিন্তু গন্তব্য কোথায়? গন্তব্য কি আমার বুকের ভালোবাসা ক্ষতবিক্ষত সুবর্ণ ফুলের কন্টক দংশনে! হে আমার ফুল্লকুসুম আমার ভালোবাসা আমি ডাকি কাছে আয়, আয় কাছে। আমি বড়ো একা, খুব একলা একা। আমি তোর কী করেছি। খুব কি ক্ষতি করেছি? কতোটা ক্ষতি, কতোটারে? বেশতো ক্ষতি যদি করেই থাকি কী করলে তোর ক্ষতি পূরণ হবে বল আমি তাই করবো। আমি বুক চিরে রক্ত দেব তোর পথের ধূলায়, তোর চলার পথে বিছিয়ে দেব আমার এই রূপহীন জীবনটা। তুই কাছে আয়। তুই এমন করলে আমার কিছু ভালো লাগে না, ভালো লাগে না রে! কিচ্ছু ভালো লাগে না; নাটক ভাল লাগে না। গান ভাল লাগে না। কথা না, গল্প না, কিছুই না। তুই কষ্টে থাকলে আমি পাথর হয়ে যাই। নিষ্কর্মা অক্ষম পথের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকি। তুই পথ না দেখালে যে পথ পাবো না খুঁজে, পথ পাবো না রে।

তোর মুখে হাসি না থাকলে অসময়ে আমার বাগান শুকিয়ে যাবে। বাগানের সুবর্ণ ফুলের পাপড়ি ঝরে যাবে পৃথিবীর ধূলায়, প্রকৃতির অভিশাপে সব সবুজ হবে হরিদ্রাভ। সব হলুদ হবে! তা হয় না। আমি কিছু চাই না। শুধু তোমাকে চাই, তোমাকে। আর এই সাধের জীবন শুধু তোমার জন্যে অথচ তুমি কষ্ট দিলে আমাকে। আমাকে ভেজালে চোখের লবন জলে। আমি কী কষ্টে ডুবে ডুবে সাগরজলে বিনষ্ট হবো? তুমি এমন করো না, এমন করো না। তুমি কি বুঝতে পারো, তোমার কতোটা আঘাতে, কতোটা ক্ষত সৃষ্টি হয় আমার হৃদয়ে। বড়ো ভয় হয় তুমি ছেড়ে যাবে আমাকে। চলে যাবে যদি, আমি তো বাধা দিতে পারবো না। কিন্তু তোমাকে না দেখে তো থাকতে পারি না। তোমাকে দুদন্ড দেখলেও আমার তৃষ্ণার শান্তি। সখিরে, আমার পায়ের তলায় সেই সর্ষে তাই আমি তোর কাছে পৌঁছুতে পারিনি, পারছি না। আজও আমি ঘুরপাক খাই, ঘুরে বেড়াই, ঘুরে ঘুরে যাই। তুই রাগ করেছিস। কষ্ট পেয়েছিস, কষ্ট দিয়েছিস। আমার বাগানে সুবর্ণ গোলাপ মিইয়ে গেছে, পাপড়ি ঝরে যাবে যে কোন দিন। সৌরভ বিলীন হলে আমি কি নিয়ে থাকবো নিশি বল? যে তুমি না থাকলে অন্ধকার ঘিরে থাকে আমাকে; যে তুমি দিনের সূর্য, রাতের চন্দ্র সেই তোমাকে ছাড়া কী নিয়ে থাকবো বলো? আমি কী করবো ? তুমি একটা কিছু বল। আমার যে কিছু ভালো লাগে না। ভালো লাগে না, ভালো লাগে না।

এখন তোমার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। কথা বলতে ইচ্ছে করছে, বসতে ইচ্ছা করছে পাশে আর ঐ মুখে একটা হাতের আঙুল আলতো ছোঁয়াতে। এখন বড্ড ইচ্ছে করছে একটা ফোন করতে।

‘হ্যালো কে?’
‘ আমি!’
‘কেমন আছো নিশি। কথা বলছো না কেন? কথা বল? ফোন রেখো না। আমার খুব খারাপ লাগছে নিশি।’
‘নাদিম আমার বুকের ভেতর শূন্য...’
‘আমি শূন্যতা ভরে দেব গানে,গল্পে, কথায়, আনন্দে, হাসিতে, সোহাগে।’
‘আমার দু’চোখে জল।’
‘জল শুষে নেব আমার দু’ঠোটে, আমার হাতে উল্টো পিঠে সমস্ত জলের সৌরভ নেব আমি।’
‘আমার সৃষ্টিতে ধূসরতা শুধুই হেমন্ত, বসন্ত নেই, নেই শরৎ।’
‘আমার বসন্ত চাই না। তবুও যদি চাও বসন্ত দেবো, দেবো কোকিলে কুহু তান, ফাগুনের ঝির ঝির হাওয়া। খঞ্জন পক্ষীর নৃত্য দেবো তোমার উঠোনে।’
‘আমার জীবন বৃক্ষ আজ সবুজহীন।’
‘আমি বুকের রক্ত দেবো ঐ বৃক্ষের গোড়ায়। আমার জীবনের বিনিময়ে পুষ্পের হাসি দেবো। ঐ বৃক্ষে দেবো শরতের নির্ভেজাল সতেজ শিউলী। সব-স-ব দেবো নিশি স........ব। শুধু আমাকে আসতে দাও, বসতে দাও কাছে, একটু কাছে।’

নিশি কথা বলে না। ওর ছায়া ছায়া দুচোখ ভরেছে চোখের জলে, নাদিম তা দেখতে পায় না। শুধু বলেই চলে ‘‘একটুু কেবল বসতে দিও কাছে............’’

 

আফরোজা অদিতি
কবি ও কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top