সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

আড়াই লেনের আহির ভৈরব : দিলারা মেসবাহ


প্রকাশিত:
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০২:২২

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০৭:০৪

 

‘তালই আমার দধি খাইতে চাইছে আম্মাগো। পঞ্চাশডা ট্যাহা দেওন লাগবো গো-ও।’
আরজিখান পেশ করেই সর্বশরীর বাইন মাছের মতো কচলায় লালমোতি। অনুনয়ে কুমড়ো লতার মতো ঝুলে পড়ে অতঃপর।
মাসের শেষ ক’টা দিন বড় ভয়ে ভয়ে কাটান মিনু বেগম। আচানক এইসব বদহাওয়ার ঝাপটায় ভিমরি লাগার দশা হয় তার। চওড়া কপাল তার অনতিবিলম্বে খাঁজকাটা হয়ে যায়। বাড়তি কোনো খরচা সামাল দেয়া পাথর ফাটানোর চেয়েও কঠিন কর্ম হয়ে দাঁড়ায়।
ইউসুফ মৃধা মিনু বেগমের স্বামীরত শোনা যায় সৎ ধাঁচের চাকুরে। বামহাতের কারবার করার মতো দুঃসাহস, কৌশলাদি কিছুই তার আয়ত্তে নাই। মনের কানচিকোণায় ইচ্ছা কতটুকু তা অবশ্য ঠাহর করা যায় না। টেলিফোন ডিপার্টমেন্টের চাকরি তার। কানাঘুষা শোনা যায় ঐ ডিপার্টমেন্টের সিংহভাগ অধস্তন চাকুরে চোখের ইতিউতি ইশারায় জরদা পান চিবোতে চিবোতে কত কিছু ম্যানেজ করে ফেলেছে। গোড়ান, মেরাদিয়া, যাত্রাবাড়ি টিনশেড বানিয়ে টপাটপ ভাড়াটিয়া বসিয়ে দিচ্ছে।
এই তো গত শনিবার সকিনা বিবি এসেছিল বিকালের মিঠে রোদে ভেসে ভেসে। সর্ষেফুল রঙের শাড়ি-বøাউজে হলুদিয়া পাখির মতো সেজেগুজে। বুটিদার নকশায় চোখ আটকে যায়। মিহিন জমিন আর আঁচলে কল্কা ছাপ, কী মনকাড়া পেটা নকশি! ভুরভুর করে সুগন্ধি জরদাপানের আকুল সুবাস। জমকালো হাসি-তামাশায় ভরা তবলা তবলা মুখখানা সকিনা বিবির। সাতসমুদ্র তের নদী উথালপাথাল গল্পগাথা তার। পাখির মতো কিচিরমিচির শেষ হয় না। দম নেয় না বিবিজান। সময় অল্প অথচ গুদামভরা বৈভবের হাজারো কাহিনি।...
সকিনা এখন স্বামীর কলিগ রুস্তম প্রামাণিকের ঘরণী। এককালে কোনো ধূসর অতীতে ছিল মিনু বেগমের সই।
পোড়া বেগুনের মতো চিমসে মুখের মিনষের আটাইশ বছর ঘরসংসার করে তো কেবল হা-ভ তের নসিহতনামা শুনে আসছে। শুনে শুনে তার নরম লেবু ফুলের গন্ধমাখা অপূর্ব হৃদয়পটে ছোপ ছোপ কালি পড়েছেÑকালি পড়েছে ডাগর চোখের কোল জুড়ে। কোনোদিন বিহানবেলা ওঠে মানুষটা একগাল হেসে একটা ভাল কথা, সুখের কথা, মনজুড়ানি কথা কয় না।

খালি শোনাতে পারে মারফতি। জীবনযুদ্ধে জয়লাভের জন্য নব নব শিরস্ত্রাণে সাজার মারফতি। পোড়াকাঠ দেহ-মনটা বুঝি ততোধিক পোড়া। তিন খুপরির নোনাধরা দেওয়াল-সবুজ-শ্যাওলাময় কলপাড়, ঘুণেধরা দরজা, এই বাসাবাড়ির জীবন মিনু বেগমের।
মাসের সাতাশ তারিখের দিকে ঝির আবদার শুনে মাথায় প্রায় রক্ত চড়ে যায় তার।
‘কয় কী শয়তান্নি! গরিবের লালচ বড় বেহায়া। বড় বেশরম। দধি গেলার লালচ। রং-মক্কর কত! মাসের শেষ ক’টা দিন কত কেরাবেরা করেই না চলতে হয় তাকে।’
কপট রাগে ফেটে পড়ে মিনু বেগম।
‘লালবানু রে! তুই বড় খবিশ্-খচ্চর জানি কোনহানকার। কেন রে এমন অসময়ে আচমকা বায়না করিস।’
লালমোতি পান খাওয়া গুলঘষা কালচে ডালিমের বিচির মতো দাঁত কেলিয়ে হাসে, অঝোর ধারায় হাসে।
‘বালাই ষাট। আপনে না রাজরানী? হাত ঝাড়া দিলেও পাঁচশ’ হাজার ট্যাহা ঝইর‌্যা পড়ে। দেন গো আম্মা তালই আমার হাউশ করচে। অসুইখ্যা মানুষ। অর্ধাঙ্গ ব্যারাম। কাখন কী গতিক হয়। তালইর দিলডা বড় মুলায়েম আম্মাগো। আমারে বড়ই ছেনেহ করে। আমার বাপের চাইতেও হেয় আমার উপকার করছে। হের গুণ গাইতে গেলে দিন রাত হয়্যা যায় গো আম্মা।
প্যাচাল ধরলে আর ক্ষেমা নাই লালমোতির। ঠোঁটের পাশে ফেনা জমে ওঠে। খয়ের জরদার কালচে কষ।
ঠিকাবেটিটা কাজকামে সাফসুতরা। মেজাজ প্রায় বরফের মতো ঠান্ডা। যখন তখন বিনা নোটিশে কামে কামাই দেয় না, মোদ্দাকথা, চলনে বলনে ঐ ছিনালি ছিনালি রংঢং নাই। ঘরে জোয়ান ছেলে-সাবধানের মার নাই। বহুগুণে গুণান্বিত সে অস্বীকার করার জো নেই। বয়স তিরিশ ছাড়ায় নাই সম্ভব। আবার বুকের কাপড় মাথার কাপড়, সবসময় জায়গামতোই থাকে। একটা কিঞ্চিত অসুবিধা অবশ্য মিনু বেগমের হেফজ হয়ে গেছে। সে কথায় কথায় সুর ধরে। আপনমনে গীত রচনাও করে। উতালিপাথালি সুরের ইনুনিবিনুনি শোকে আর সুখে।
টাকাটা দিতে গিয়ে তবুও মিনু বেগমের ঝকঝকে কপাল পুকুরের ঘাটলার মতো থাক থাক খাঁজকাটা হয়ে যায়।
ভোর পাঁচটায় ৭৫ আড়াই লেনের মানুষজন যখন আঠালো ঘুমের গভীর কোলে শিথান দিযে মুখ ব্যাদান করে দম ফেলে তখন মিনু বেগম চড়ুইভাতি করার মতো খুপরি রসুইঘরে ঢোকে, গ্যাসের নীল আলো জ্বলে ওঠে সুতানলি সাপের মতো। সেই চুলা আর নেভে না বেলা দুইটা পর্যন্ত প্রায়। ধিরিঙ্গা লম্বা তার কোলমোছা ছেলে নবাব। গায়ে একমুঠো গোশতও নাই। এরই মধ্যে বাপের মতো দুই গাল বসে গেছে। ইতিউতি কী ব্যবসা করে মিনু বেগম সঠিক জানে না। জিজ্ঞেস করলে খরখরা গলায় বলে,
‘অত জাইন্যা করবাডা কী? বায়িং হাউস, বুঝলা কিছু? বুঝবা না বুঝবা না।

পাকঘর নিয়া আছ, তাই থাক। আমারে বুঝবার চেষ্টা কইরো না। বুঝবা না বুঝবা না এক্কেবারেই বুঝবা না। মেলা খাটনি মেলা মসিবতের কাম।’
ছেলে মাসকাবারি হাজার বারোশ’ টাকা অতীব করুণার সঙ্গে ছুড়ে দিয়েই খালাস। মন ভাল থাকলে তার স্ফূর্তি উপচে পড়ে, ‘আঁখিওমে গুল্লি মারে...লাড়কি কামাল রে’ গাইতে থাকে। আবার পাশের টিনের ঘরের জানালা বরাবর গলা বাজায় ভিলেনের মতো, ‘সুন-সুনা কেয়া করু আগোমে খান্ডালা। ঘুমেঙ্গো-ফিরেঙ্গে নাচেঙ্গে...গায়েঙ্গে, অ্যাস করেঙ্গে ঔর কিয়া’?........
দুই মেয়ে মিনু বেগমের। গায়ের চম্পাকলি রঙের জন্যই শুধু শ্বশুরবাড়ি সামান্য কদর পেয়েছে। একসময় জামাইগুলা সাক্ষাৎ ভেড়া বনে গিয়েছিল। যা হোক, মায়ের মতোই মেয়েরা গায়ে গতরে খাটে বুদ্ধি খাটায় ধৈর্য ধরে ঘর-গেরস্থালি করছে। এতসবের মধ্যেও মাঝে মধ্যে দাম্পত্য যুদ্ধ লেগে যায়। ছোট মেয়ে যুদ্ধ লাগিয়ে মাস দুই মায়ের পিন্ডি চটকে সবে গেল। তবু মেয়ে দু’টির তরে হাজার কোটি শুকরিয়া খোদাতালার দরবারে।......
সংসারে এমনই হয়। সংসারের কালিঝুলি তেলকষটা ঘষতে ঘষতে শাকচচ্চরি বণ্টন করতে করতে এক্কেবারে কেমনতরো বেদিশা মানুষ হয়ে গেছে সে। এই মেয়ে জোছনারাতে বাতাবি লেবুর গন্ধে পাগলপরা হয়ে গান গাইত, ‘মোর ঘুম-ঘোরে এলে মনোহর/নমনম নমনম নমনম/....স্বপনে কি যে কয়ে গেলে’..........
সেই মিনারা কলমিলতার মতো কমনীয় মিনু ঠিকে ঝিয়ের অন্যায় আবদারে চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠতে চেয়েছিল। অদৃশ্যশক্তি তার কণ্ঠনালি চেপে ধরল। বাস্তবের মুখোমুখি নিরুপায় সর্পিণী ফণা নামিয়ে নিস্তেজ অথচ তিক্ত গলায় বলল।
‘এত্ত হাউশ রে তোর লালমোতি! কোনহানকার তালই সাব তার আবার লালচ। তাও বিক্রমপুরের চাকাচাকা মিঠা দই। দুর যা শয়তান্নি।’
লালমোতি এ সমস্ত নোনতা বকা বোঝে। চোখের পলকে একগাল হেসে আম্মা বলবেন, ‘নে, নে, ক্ষারের খ্যাতাডা খাইচা আয় জলদি, জলদি। আধঘণ্টা বাদেই পানি চইলা যাবেনে।’
ক্ষার সেদ্ধর সুগন্ধে বাসাবাড়িটা মউমউ করছে। বৃষ্টি-কাদায় থিকথিকে একফালি উঠানটুকুর ভ্যাপসা গন্ধ ঢেকে দিয়েছে।
আচবাল রসবাতের আছর হয়েছে মিনু বেগমের ছোটখাটো সুডৌল শরীরটার অন্ধিসন্ধিতে। দিনমান এত ছোটাছুটি-খাটনি তাও রসবাত! সপ্তাহে অন্তত পাঁচটি দিন সে নিয়ম করে হাঁটতে যায় খুব ভোরে নয়তো সন্ধ্যাকালে। কাঁটাখুড়ে, লজ্জাবতী, চোরকাঁটা মাড়িয়ে মাড়িয়ে। সর্বদা ভয়, দেহ-ঘড়িটা যেন বিগড়ে না যায়।

উবু হয়ে টবের বাগানের খানিক পরিচর্যা করে মিনু। সময় পেলেই খুরপিটা হাতে নিয়ে মনোযোগী কৃষিবিদের মতো মাটি আলগা করে দেয় সে। আজ কাদা মাটি থেকে কেঁচো বেরুচ্ছে। কেঁচো গাছের উপকারী বন্ধু জানে মিনু বেগম প্রাকৃতিক লাঙল। তাই ঘেন্না করলেও ফেলে দেয় না। ভাঙা বালতিতে চাপাতি, ডিমের খোসা গুঁড়ো দিয়ে পুঁইশাক, গন্ধরাজ লেবুর কলম সাজিয়েছিল। বড় বাড়ন্ত হয়েছে গাছগুলো। পুঁইয়ের ঘন সবুজ ভারি-ভারি পাতায় ছেয়ে গেছে টিনের চালা। লেবুর ছোট ছোট কড়া এসেছে ঝুমঝুমা। তোলাপানিতে গোসল সেরে যোহরের নামাজে দাঁড়ায় সে।
এতক্ষণে ক্ষিধে চনমনিয়ে জানান দেয়, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। মোলায়েম কলমিশাক দিয়ে নলা পাকায় মিনু বেগম। বড় স্বাদ। ছেলে স্বামীর জন্যে ডাঁটা দিয়ে মাগুর মাছ, কাঁঠালের বিচি, লতি দিয়ে ইলিশ মাছের লেজা মাথার চচ্চড়ি। মাসকালাইয়ের ডাল। চিতলমাছের পেটি থলি ভরে আনতে পারলে মিনু বেগমের রসারসা ঝোল করতে বিন্দু মাত্র কষ্ট নাই।
বিকেলের রোদ মিইয়ে যাচ্ছে। লালমোতি টর্নেডোর গতিতে কলপাড়ে হ্যান্ডেলভাঙা কড়াই তোবড়ানো ডেকচি ছাই ডলে ফর্সা করে তোলে। অভ্যস্ত ক্ষিপ্রতায় এঁটো বাসনকোষন মেজে আয়না করে তোলে।
আধমিনিট ইন্টারভ্যাল। আঙুল চালিয়ে দেয় দাঁতের গোড়ায়। তার গুল-ঘষার তরিকা। কড়া জর্দা, সাদাপাতা, এক চিলতে পান চিবোতে চিবোতে যেন বা সে গহীন সুখের দুনিয়ায় ডুবে যেতে থাকে। দরজার কানচি থেকে ঝাড়– বের করে ঘরদোর ঝাড়– মারে আর গুনগুন করে,
‘চুমকি চলেছে একা পথে। দুষ কী আমার সাথি হতে।...দুষ কী আমার সা-থি-ই-হতে’.....
মিনু বেগম ঝামটা দিয়ে ওঠেন, ‘এইসব কী গান।’
‘আম্মাগো বায়স্কোপের গীত।’
‘শয়তান্নি কোন্হানকার।’
নোনতা বকা মিনু বেগমের।
জিভ কাটে লালমোতি। কষ্টি পাথরের মতো জিভ তার। খয়ের, জর্দা, গুলের পলাস্তরা।
‘আম্মাগো! পান না খাইলে দিন কাটে না। গীত না গাইলে গলা খুসখুসায়।
কী করুম?’...
‘তোর তালইরে দধি খাওয়াইছিস?’
মিনু বেগম ভাসাভাসা গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘হ-হ- আম্মা গো! বিক্রমপুর‌্যা দধি! শরবতীর বাপে টিকাটুলীর মসজিদ ছাইড়া বড় মিষ্টির দোকানথন কিনছে। পেঁয়াজি রঙের গাড়া দুদের। মইষের দুদই নাকি! তালই খাইছে চাইট্যাপুইট্যা। অনেক দুয়া দিছে আপনেরে আমারেও।’
‘তোর কেমন তালইরে? কই? এতদিন তো তার কথা কইস নাই?’
লালমোতি ঝাড়– পর্ব শেষ করে দরজার কানচিকোণায় ঝাড়– লুকিয়ে রাখতে রাখতে বলেÑ
‘ঐ তো আম্মা, আমার সতালো ভাইয়ের শ্বশুর। কিন্তুক বড় আপনার লোক। গত বছর বানভাসির সুময় দ্যাশ থেকা আসছে। আর যায় নাই। ভাইয়েও তার শ্বশুরের মেলা যতœআত্তি করে আম্মা।’
মিনু বেগম নোনতা বকে, ‘ওরে আল্লাতাল্লা! সোদর ভাইয়ের শ্বশুর না। তাই এমন আদিখলাপনা।
ইল্লতি ইল্লতি সতালো ভাই তার শ্বশুর-তালই সাব!’.....
লালমোতি চাল ঝাড়তে ঝাড়তে মাথা দোলায়-মিটমিট করে হাসে।
সন্ধ্যার অবসরে আবার মনটা কেমন হু-হু করে ওঠে মিনু বেগমের। একলা ঘরে পুরনো কথা মনে পড়ে তার। হুতাশন জটিল ক্রন্দনে বুকের ভিতর ধস নামে।
মিনু বেগমের আব্বাজান কোনোদিন তার বাসাবাড়িত দুটো দিন একসাথে থাকে নি। মা তো যমুনা ভেঙে কোনোদিন মেয়ের সংসার দেখে নি। কাঠখোট্টা লোকটা কোনোদিন শ্বশুরের সঙ্গে আদবসহবতের সঙ্গে বাক্যলাপ করে নি।
কেমন খরখরে গলায় লাটসাহেবের মতো কথা বলত। কিছু কী ভুলতে পেরেছে মিনু বেগম!
একবার বাপের জন্যে নিজের পুঞ্জি ভেঙে রুই মাছের টক ঝাল করেছিল। পোলাও রেঁধেছিল। ওমা! পরদনি অকস্মা আর কথা কয় না। মুখ অমাবস্যা বানায়া রাখে। কথায় কথায় গজরগজর। সবই বোঝে সে।
আব্বাজান মুসল্লি মোত্তাকী মানুষ। টিকাটুলী লিল্লাহ বোর্ডিং-এ এতিম ভর্তি করতে এসেছিলেন। জামাতার ভাবগতিক ভালো না ঠেকায় সেই গেলেন আর কোনোদিন আড়াই লেনের এ বাসাবাড়িত পা দেন নাই। একবার কিছুদিন ছোট মেয়ে চিনু বেগমের কায়েতটুলীর বাসায় কাটিয়ে গেছেন। চিনুর স্বামীটা মাশাল্লাহ্ দিলখোলা ব্যবসায়ী মানুষ। শ্বশুরকে উঠতে বসতে সালাম দিত। বাজার থেকে দমাদম পাবদা, বাইন মাছ আনতো। শবরী কলা আরও কত ফলফলারি! আদবের সাথে বলত, ‘খান আব্বাজান! আপনার জন্যে সওদা করছি। একটু মুখে দেন। আপনের জন্যে তো কিছুই করতে পারি না। থাকেন যমুনার ওপাড়। বড় দূর। সেতুন কথা শুনছি। হয়ে গেলে বড় ভাল হতো। আপনাদের খোঁজখবর নিতে পারতাম।’

সেই সেতু হয়েছে। কত খুশির বার্তা। কিন্তু সেই ফেরেশতার মতো মানুষটা তো আর নাই দুনিয়ায়। মিনু বেগমের বুকের ভিতর হুলস্থূল করে দীর্ঘশ্বাস উথলায়।
একবার লালমোতির সতালো ভাইয়ের অচেনা মুখটা কল্পনা করার চেষ্টা করে। কী দিলওয়ালা মানুষ! গরিব হলে হয় কী!
সকালে ইনিয়ে বিনিয়ে লালমোতির দধির গল্পটা স্বামীকে শোনাল মিনু বেগম। তারপর জামাইবাড়িতে একবছর ধরে আতুড় নুলা শ্বশুরের অবস্থানের ব্যাপারটা। যেন কানে কোনো কাহিনিই পৌঁছায় নাই। নির্বিকার চায়ে টোস্ট ডুবিয়ে সুরুৎ সুরুৎ চুমুক চড়ায়। শেষ করে সশব্দ একটা ঢেকুর তুলে কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
‘পান দাও একটা দেহি। একটু এলাচি দিয়ো তো।’
কালো মুখটায় বসন্তের গর্তগুলো যেন কিলবিলিয়ে উঠল। দড়িদড়ি রগভাসা হাত দুটোকে মনে হলো ঘুণেধরা দুটো কাঠের তক্তা। শরীরটা পোড়াকাষ্ঠ-মনটাও ততোধিক। এসব আউলা চিন্তা মাথা থেকে সরাতে চাইলেও মনের ভিতরমহলে ভাঙা রেকর্ডের মতো ক্রমাগত বাজতে থাকে। বয়ঃসন্ধিক্ষণে যেমন বাজত, ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর/নমনম নমনম নম’/...এই সেই মনোহর? নম নম নম না ছম ছম?....
কান্না আসে পোড়াচোখের পাতা ঠেলে। নরম তুলতুলা ছিল তার অপার হৃদয়। সেই অন্তরে আজ শুধু ছাইভস্মের ঢিবি।
এখনই ঝড়ের ঝাপটার মতো আসবে লালমোতি। দু’জনে মিলে রুটির কাঁই করবে। একজন ঠাসবে, একজন গড়বে তারপর হুজুরদের নাশতার মিনিটখানেক আগে টোপা টোপা করে সেঁকবে। আর সব বাসি কাজগুলোর গোছমিছিল করবে মোতি ক্ষিপ্রহাতে।
ইউসুফ মৃধা কোনোরকমে ফজরের নামাজ আদায় করে, কেমন পুতুল পুতুল ভাব। প্রাণের মধ্যে ভক্তিভাবটি নেই। বাপের মতো মুসল্লি মোত্তাকি হলে নূরানি জ্যোতি থাকত।....
আড়াইলেনের সিরামিকের নতুন বাড়িটা থেকে ভেসে আসছে কিশোরীর কণ্ঠ পরিচর্যা, ‘যাদুর পেনসিল/আহা যাদুর পেনসিল/আমার থাকত যদি এমন একটা যাদুর পেনসিল’/...ভোরের পাখিগুলো ভয় পেয়ে যেন ডানা ঝাপটায়!
‘আম্মাগো আম্মা! আমাগো তালই সাব আর নাইগো আম্মা!’
কলপাড়ে প্রায় আছড়ে পড়ে লালমোতি।
‘কখন? কী হয়ছিল তালই সাবের?’
তসবির দানায় শেষবারের মতো হুয়াল হাইউল কাইয়ুম পড়ে চুমা দিয়ে আলনার শিঙে ঝুলিয়ে ত্রস্ত দৃষ্টি ফেরাল মিনু বেগম।
‘নতুন দধির খোড়া ভইরা ভিক্ষা করছেন তালই আমার। তারপর কী হইছে? বুমি কইরা ভাসাইয়া দিছে ঠেলা গাড়িখান। তারপর মুখে ফেনা তুইল্যা ইন্তিকাল করছেন। ভাই আমার মুখে তুইল্যা তুইল্যা খাওয়াইত। গা গোছুল দিত। বালবাচ্চা নিয়ে অহন ভায়ের কেমনে দিন কাটবো? আম্মা গো আম্মা!’.... আমরা সব হারাইছি গো আম্মা! সারা দিন বুড়ানুলা মানুষটা ভিক্ষা করত টিকাটুলী মসজিদের সামনে, ঐখানে ইন্তিকাল করছেন গো।’
দম ধরে লালমোতি পানের ছিবড়াগুলান মুখ থেকে বের করে উঠানময় ছুড়ে মারে। তারা সবাই তালুই সাবের যত্ন আত্তি করত। ভায়ে হাতে তুইল্যা খাওয়াইত। গামছা ভিজাইয়া গতর মুইছা দিত। দরকার হলে বিছানা ধুইত। ভাবীজানের তো চিরকাল্যা সুতিকা ব্যারাম।
ঠেলাগাড়িটা কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে মোতির সতালো ভাই। লাল নিশান ওড়ে পতপত। শ্বশুরের মাথায় লম্বা জট। বড় সুন্দর করে ঝুলিয়ে দিত বুকের ওপর। হাতে একটা লাঠির ডগায় ঝুমঝুমি। পাগলা ফকির বড় গরম ফকির। কারো দিকে নজর দিলে তার আত্মা কাঁপত। বড় গরম তার নজর। কিছু নজরানা না দিলে মঙ্গল হয় না বান্দার। আল্লার ওয়াস্তে আস্ত নোট দশ টাকা পাঁচ টাকা পড়ত। খুচরা পয়সাও পড়ত। খোড়া ভরে উঠত চোখের পলকে। নুলা হাতটা দুলিয়ে দুলিয়ে ভিক্ষা করত তালই। কত গীত গাইত। সর্বদা একটা গীত গাইত বিশেষত ভিক্ষার সময়।
‘ও মোমিন মুসলমান বাই বেরাদর/লুলারে দিলে ভিক উজালা হইবে গর’।...
জীর্ণ ফতুয়ার পকেটে লালসালুর রুমাল। ডাÐির সাথে বাঁধা ছাতির চাঁদোয়া। জামাতার কত খেয়াল! দিনভর যা কামাইত সবই প্রায় ভাইয়ের হাতে তুলে দিত। মাঝে মধ্যে তার বিড়ি, ভালা সিগারেট খাবার খায়েশ হলে জামাতা কখনো গোস্বা হতো না। যে মানুষটা এত করে তার এইটুকুন আবদার। গত রোজার ঈদে ভালো আয় হয়েছিল। লালমোতির একটা টাঙ্গাইল ময়ূরকণ্ঠী রং জবর সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছিল তালই সাব।
লালমোতি প্রতিদিন সন্ধ্যায় তালইর চাঁদিতে কদুর তেল চাপড়াইয়া বসায়া দিত। আরামে তার চোখ বুঁজে আসত-কত দোয়া দিত! রাতভর ফোঁপাইয়া ঘুমাইত। দুই একদিন না দিলে সারা রাত কাঁইকুই করত বিছানা কাঁথা বিনাশ করত। তাই ভাই তারে যাইতে অনুনয় বিনয় করত।
‘এমুন তালই আর কী হবে ভবে আমার।’
সুর ধরে বিলাপ করে লালমোতি।
‘এমুন তালই আর কী হবে এ জনমে আমার?’
ডুকরে ওঠে সে। রোগা শরীরটা কাঁপতে থাকে। যেন সে মূর্ছা যায়।
‘অত কাঁদলে মুর্দার জানের আজাব হয়। দোয়া করো।’
মিনু বেগম ভাসাভাসা গলায় বলে।
‘বড় কপাইল্যা তালই আমার। দাফনের টাহা উঠছে বহুত আম্মা গো।
ভাইয়ে ট্রাক ভাড়া করছে। কাল বিয়ানে রওনা দিব। আমারে সাতদিনের ছুটি দেন আম্মা গো।’
মিনু বেগম যেন শুনেও শোনে না। কী কয় বেটি। সাতদিনের ছুটি। এও কী সম্ভব কথা? সংসারে এত কাজ রসবাতের শরীরে সামাল দিবে কেমনে?
‘লালমোতি রে! তুই বড়ই কাতর হইছিস? ঠান্ডা হ। তোর যাওয়ার কোনুই কাম নাই। শোন আমার কতা।’....
মুখে যারপর নাই দরদ ঢেলে কথা বলে মিনু বেগম।
‘অনেক ভ্যাজাল আছে আম্মা গো আম্মা! এক ছড়া রূপার চেইন দিছিল তালই আমার, তা রইছে ভাবীর কাছে। মুর্দার লগে না গেলে হেই ছড়া হাতছাড়া। আর হেগরে একটু খাওনদাওনের ব্যবস্থা করতে হয় না, কী কন আম্মা! আর ভবিষ্যতে শিবপুরে তালইয়ের বিটায় কব্বর ঘিইর‌্যা মাজার দিব ভাইয়ে। যদি ব্যবসা জমে তো ভালো। তালই আমার বড় কামেল গো। স্বপনে ওষুধ পাইছিল। বাজা মাইনষের পোলাপান হওনের জড়িবুটি। ভাইরে শিকায়া গেছে। শরবতির বাপের আশা আছে, হেয়ও হেই কবরেজি, ফকিরি তরিকা ধরব। ভাইয়ের মন জুগায়া চলা লাগবে আম্মাগো। আপনে বুজেন না। ভাইয়ের হাঁপানির টান-শরবতির বাপের কাশের ব্যারাম। হেরা তো রিকশা বাইতে পারে না। ঢাকা শহরে বাত দিব কেডা আম্মা গো! আপনে চিন্তা কইরেন না। এক হপ্তার মাতায় আইয়া পড়–ম।’
মিনু বেগমের মাথা চক্কর দেয়। ক্রমাগত চক্কর। আচানক লালমোতি ফুঁপিয়ে ওঠে‒
‘এমুন তালই আর কী হবে ভবে এইজনমে। আমার দয়ার তালই।’.....
ইউসুফ মৃধা বেরিয়ে আসে।
‘কিসের আহাজারি? কী হইছে তোমার?’
‘আব্বাজান গো! আমার দয়ার তালই আর নাই এ দুনিয়ায়। আল্লায় তারে তুইল্যা নিছে।’
মিনু বেগম ভেবেছিল সাহেবকে দেখে লালমোতি শরম পাবে। কিন্তু না, তার ঘোমটাও যথাস্থানে নাই। ইউসুফ মৃধা আচানক একেবারে আচানক গেয়ে ওঠে,
‘কে পারে মক্কর উল্লার মক্কর বুঝিতে। আহাদ আহম্মদ নাম হয় জগতে।’....
মিনু বেগমের মাথা চক্কর দেয়। স্বামী তার খুপরি ঘরে অদৃশ্য হয়ে যায়।...তার স্বামীর মুখে সুর! হোক তা শোকের।
নবাবের গলা শোনা যায়। সে পেপসোডেন্ট দিয়ে দাঁত মাজছে সাতসকালে,
ক্রমাগত সুর ঝরছে,

‘জনম সমঝা করো......জনম সমঝা করো’।

 

দিলারা মেসবাহ
কবি ও কথাসাহিত্যিক
উপদেষ্টা, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top