সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

মা দিবস ও সেমন্তির ছবি : রোকেয়া ইসলাম


প্রকাশিত:
২৭ এপ্রিল ২০২২ ০১:৩৮

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৪২

ছবিঃ রোকেয়া ইসলাম

 

সেমন্তি সেলফোনের গ্যালারী থেকে ছবি বাছাই করছে, ওর পাশে বসে অনন্তও ছবি দেখছে ওদের মা শম্পা বেশকিছু নতুন ছবি তুলেছে কাল আজকে আপলোড দেবে বলে, সেটা নিয়েই পেরেশান।
কোনটা রেখে কোনটা দেবে? একটা ছবি দুজনেরই খুব সুন্দর হয়েছে, কিন্তু ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে ও ফুলের দিকে বেশি মনযোগ দিয়েছে। কে জানে কার চোখে এটা ধরা পড়বে আর কমেন্টে ডলা দেবে।
পলিন সেমন্তির বাবাই বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছে, পড়া শেষ করেই বাজারে ছুটবে, লিষ্টটা সকালেই রেখে গেছে শম্পা। মূল বাজার আগেই করা হয়েছে, আজ শুধু ডেকরেশনের জন্য অল্পকিছু আনতে হবে।
সেমন্তি তাকিয়ে অনন্তের দিকে, মনে হচ্ছে গভীর ভাবনায় তলিয়ে আছে ও।
সেমন্তি অনুমানেই ধরে ফেলে ওর ভাবনার নাটাই , সূতো ছাড়ছে আর পরিকল্পনার ঘুড়ি উড়ছে।
অনন্তের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই সেমন্তি করে ফেলবে কাজটা, ভাগ্যিস অনন্তের দিকে তাকিয়েছিল, নইলে এখনি হেরে যেত ঘরেই, বাইরে বন্ধুদের কাছে গোঁ হারা তো পরের বিষয়।
অনন্তের কাছে সবসময়ই রেয়ার কালেকশন থাকে, দিবসের গুরুত্বপূর্ণ ছবি রিজার্ভ থাকে, কাজিনরা অবাক হয়ে যায় এরে এই এ্যাঙ্গেলের ছবি তো ওদের কাছে নেই ওরা এই এ্যাঙ্গেলে ছবি তোলার কথা মনেও করেনি।
অনন্ত ছবি খুঁজছে খুঁজুক, সেমন্তি এবার যে ছবি পোস্ট করবে তা অনন্ত কেন সেমন্তির কোন বান্ধবীও সে ছবি পোস্ট করার কথা মনেও করতে পারবে না,
সেমন্তি দীর্ঘকাল ওদের চেনে বলেই মনে হচ্ছে পারবে না।
মামনির আলমারি খুলে এ্যালবাম বের করে নিয়ে নিজের ঘরের দরজা আঁটকে খুজতে থাকে। এ ছবি গ্যালারীতে থাকার কথা নয়, এ্যালবামেও পেলেও সাদাকালো যুগের ছবি বলে হলদেটে হয়ে যাবার সম্ভবনাই শতভাগ।
তন্নতন্ন করে খোঁজে। চেনাদের চেহারা কত অচেনা তারপরও মামনিকে জিজ্ঞেস করার জন্য দরজা খুলে বের হয় না, সাগরের তলদেশ থেকে একটা মুক্তোসমেত ঝিনুক খোঁজার মত করে খুঁজেও বিফল হয়,
মামনির এ্যালবামের গাট্টি নিয়ে বসেছিল, মায়ের বিয়ের আগে পরে মিলিয়ে অজশ্র ছবির ভেতর ঘাপটি মেরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি অনাদরে থাকলেও যে ছবিটা সেমন্তি খুঁজছে সেটার দূর থেকে ভেসে আসা গন্ধেরও ছোঁয়া নেই, বাবাইর কি আলাদা এ্যালবাম আছে? প্রশ্নটা মাথার মধ্যে বার দুয়েক চক্কর দিয়ে টুপ করে ডুব দেয়, না বাবাইর একান্ত কোন বস্তুু নেই, যা গোছানো আছে অমূল্য সম্পদ হয়ে।
সেমন্তি নিজের কাছেই জোরেশোরে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, এই ছবিটাই বা সেমন্তির হঠাৎ প্রয়োজন হলো কেন?
নিনুজান ঠিকই বলে আজকালকার ছেলেমেয়েদের চিন্তার সাথে তাল মেলানো বড় কঠিন।

সেমন্তি ওর বড় ফুপ্পিকে ফোন দেয় উনার কাছে থাকতে পারে, মামনি তো বলেই সবকিছু নাকি বড়ফুপ্পি দখল করেছে। কি কি দখল করেছে কলেজে পড়ুয়া সেমন্তির বুঝে না আসলেও মামনি যখন বলেছে তখন দখল তো করেছেই।
মামনি তো শুধু শুধু বলে না।
রিং বাজতেই থাকে জবাব নেই। বেশ কয়েকবারের চেষ্টা বিফলে যায়। মেঝফুপ্পিকে অনলাইনে খোঁজ করে পায় না। অবশ্য তার ওখনে এখন রাত।
সেমন্তির সব সমস্যা যার কাছে সমাধান হয় তাকে ফোন দেয়, ওর ছোট মামী, এই নারীটির এতো কানেকশন, মনে হয় তার দশটা চোখ পাঁচটা মাথা দশটা হাত ।
সেমন্তির সমস্যা তাকে আরো গভীর সমস্যায় ফেলে দিল, প্রথমত এই প্রথম তিনি সেমন্তির কোন কাজে লাগলো না, দ্বিতীয়ত বিষয়টার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না, কেন সেমন্তির এই ছবিটাই দরকার,

দরকারটা আয়েসী ভঙ্গীতে বলেই সেমন্তির মনে হলো ওর সিদ্ধান্তটা তাকে দেয়া মানে পাঁচমিনিটের মধ্যে উনি বাস্তবায়ন করবে সেমন্তির আইডিয়া,
নিজের বলে চালিয়ে দেবে, সবাই বাহবা দেবে লাইক কমেন্টের ঝড় বয়ে যাবে ছোটমামীর পোস্টে।
কাজের কাজ তো কিছু হলোই না, মাঝখান থেকে আইডিয়াটা পাচার করে দিল।
নিজের মাথার চুল মুঠি ভরে ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।
বাবাইকে জিজ্ঞেস করবে ভেবে বারান্দায় আসে।
টেবিলে অগোছালো পত্রিকা পরে আছে এঁটো কাপ তলানিতে পানি নিয়ে গ্লাস দাঁড়িয়ে আছে।
ফেসবুকে চোখ বুলাতে গিয়ে দেখে অনন্ত মা দিবসে চমৎকার সিরিজ ছবি পোস্ট করেছে। মায়ের প্রথম কোল থেকে গতকালের ছবি অবধি, কাল মায়ের জন্য কিনে এনেছে একজোড়া দুল আর চকলেট। মা ওকে আপত্য স্নেহে জড়িয়ে ধরে আছে।
গেটের কাছে রিকশা থামার শব্দে তাকাতেই দেখে নিনুজান নামছে।
আনন্দ চিৎকার করে ওঠে। অনন্ত নিচে গিয়ে নিনুজানের মালপত্র তুলে নিয়ে আসে।
মামনি নিনুজান জড়িয়ে ধরতেই সেমন্তির ক্যামেরা ক্লিক করে ওঠে।
পুরো বাড়িতে আনন্দের ঝিরিঝিরি ঝর্ণাধারার কলধ্বনি শোনা যায়।
ওর রুমের জানালার কাছে গিয়ে বসে, ফেসবুক ওপেন করতেই ঝুপ ঝুপ করে মা দিবসের পোস্ট চলে আসে, কত ভঙ্গিতে কত রুপে কত কথায়ই না মাকে ভালবাসা মায়ের ত্যাগ স্মরণ করে ছবি দিচ্ছে।
মায়ের প্রোফাইল বাবাইয়ের প্রোফাইল ঘেটে ঘেটে একাকার করে ফেলে, চাচ্চুদের প্রোফাইলও নেড়েচেড়ে লন্ডভন্ড করে, কোথায়ও সেমন্তির চাওয়ার কাছাকাছি কোন ছবি নেই
মেজফুপ্পির ফটোস্ এ পাওয়া গেল কন্যাদের সাথে মায়ের একাধিক ছবি, এখান থেকে একটাও নেয়া যাবে না।
দুপুরে মা মেয়ে মিলে খাবারের টেবিল সাজায়।
মা বিশেষ আইটেম করেছে তার মায়ের জন্য সেমন্তি করেছে ওর মায়ের জন্য।
খাবার সাজিয়ে দুদিক থেকে ছবি তোলে বাসার সবাই।
আজ ওরা নতুন পোশাক পড়েছে। মা মেয়ে একই রকমের পোশাক পরেছে।
শম্পা বিশেষ দিবসগুলো বিশেষভাবে পালিত করে এছাড়া ওদের জন্মদিন বিবাহ বার্ষিকী তো আছেই। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশ সফরে আসে তখনও ওদের বাসায় ভেজ আইটেম হয়। অন্যদেশের বিশেষ প্রতিনিধি এলেও ইউটিউব ঘেটে সেদেশের বিশেষ খাবার তৈরি করে শম্পা,
আমন্ত্রিত অতিথি নির্বাচনেও মায়ের বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পায়
অনন্তের জন্মদিনে অনন্তের বন্ধুরা যোগ হয় সেমন্তির জন্মদিনে সেমন্তির বন্ধুরা যোগ হয়।
তাছাড়া অতিথি আগের তালিকা অনুযায়ী।
নিনুজান আগেরদিনই চলে আসে, আন্টি আংকেল কাজিন সব এক তরফেরই। জমজমাট আয়োজন।
ওদের কোন অনুষ্ঠানে দিদান বাড়ির কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। মামনি বলে" রাবনের গুষ্টি "
যারা ওদের বাসার এসব আয়োজনে এসে সারাক্ষণ শুধু খুঁত ধরবে আর বাবাইয়ের টাকা দেখে চোখ টাটাবে। বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে আনন্দ করছে এটা বাবাইর বাড়ির মানুষজনের অন্তর জ্বলুনি
আর এতো লোকজনকে আমন্ত্রণ জানালে অনেক কাজ বেড়ে যাবে তাই মামনি কখনো তাদের জানায় না।
নিনুজান দুদিন আগেই চলে আসে মামনির হাতে হাতে সব সামলায়। দুপুরের পর থেকে বাকি সবাই এসে বাড়িতে উৎসব শুরু করে দেয়।
আজকের আয়োজনটা শুধু মা কেন্দ্রীক, তাই বড় আন্টি তার দুই ছেলে ছোট মামী তার পুচকে নিয়ে আর মামনির বান্ধবী এসেছে তার দুই মেয়ে নিয়ে।
ওদের বাসা মোটামুটি উৎসবের আনন্দে ঝলমল করছে।
মায়ের মৌ মৌ গন্ধের মাতোয়ারা আয়োজনেও সেমন্তির ভেতরটায় সুক্ষ্ম পিন ফুটে আছে। যা এতো বছরেও হয়নি।
ও আজ একটা ছবি খুঁজে যা মামনি অনন্ত বাবাই কারো কাছেই নেই। এতেকাল যা জেনে এসেছে সবকিছুর ভেতর এতো ফাঁক!
একটা ছবির ভেতর এতো অদৃশ্য ছবি সূই হয়ে খোঁচাচ্ছ ওকে।
বাবাই বারান্দায় কথা বলছে আন্টি আর ছোটমামীর সাথে।
আসছে ছুটিতে ওরা দল বেঁধে কোথায় ঘুরতে যাবে আর পরিকল্পনা চুড়ান্ত করছে। বড়আন্টি নিখুঁত প্ল্যান দিতে জানে, কোথায় যেতে কত খরচ কত কম খরচে নিরাপদ ও আরামদায়কভাবে থাকা যাবে সব উনার নখদর্পণে।
বাবাই কথায় কথায় হাসছে খুব।
ছোট চাচ্চুর সাথে সেদিন কি কর্কশ ব্যাবহারটাই না করলো।সেদিনও মনে হচ্ছিল বাবাই ঠিক।
আজ ওর চিন্তার শক্ত লোহায় একটু চিঁড় ধরলো।
আজ সেমন্তি কোন ছবি পোস্ট করেনি, কারো পোস্ট ভাল করে দেখেও নি, কোন লাইক কমেন্টও করেনি।
বাবাইর ছোট পোস্টে চোখ আঁটকে যায় " বিশ্বের সকল মা ভাল থাকুক, আমার মায়ের ঋণ থাকুক আজীবন অপরিশোধ্য "
একমাত্র মায়ের পদতল শান্তির পৃথিবী।
কোন ছবি নেই শুধু একটা গোলাপ পড়ে আছে।
মেহমানরা সবাই চলে গেছে,
বারান্দায় বসে এককাপ কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে বাবাই, মা ফোনে কথা বলতে বলতে বাবাইর কাছে যায়, ফোনকলটা বাবাইর।
বাবাই কানে ফোনটা ধরেই চিৎকার করতে থাকে
তোদের কেনদিন আক্কেল হবে না, তোরা তো বেশি বুঝিস, আগে জানালি না কেন আমাকে।
যতসব বেযাদপ।
মামনির কাছ থেকে শুনতে পায় দিদানকে লাইভ সাপোর্টে নিয়েছে।
ড্রইং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসেছে বাবাই অনন্ত বাবাইর পাশ ঘেষে বসেছে, মামনি সিঙ্গেল সোফায় অন্য সোফায় সেমন্তি।
নাজুবুবু কাজটা ঠিক হয়নি, একবারও কি জানাতে পারতো না আমাদের। কবে অসুখ হলো কবে ঢাকা নিয়ে গেল কিছুই জানালো না আমাদের। আমরা কি এতোই ফ্যালনা হলাম, আমাদের মানুষ বলে গণ্যও করলো না।
না মামনি আমরা ফ্যালনা নই আমরা তাদের সাথে যে ব্যাবহার করি সেটা তাদের ফ্যালনা ভেবেই করি ।আমরাই তাদের মানুষ বলে গণ্য করি না।
আজ সারাদিন আমি বাবাই সাথে দিদানের একটা ছবি খুঁজে পাই নি। শুধু দিদান কেন ফুপ্পি চাচ্চু কারো সাথে ছবি নেই আমাদের।
প্রথমে শুরু করেছিলাম দিদানের মায়ের ছবি খোঁজা, সেটা না পেয়ে সহজ পথ ধরলাম দিদানের সাথে বাবাইর ছবি, সেটাও পেলাম না।
ছবি দিয়ে কি প্রমাণ হয় বল
অনেক কিছুই প্রমাণ হয় মামনি। ছোট চাচ্চুর বাসাটা তো পাশের গলিতে দিদান তো ঐ বাড়িতেই থাকে গত একটা বছরে কি দেখা হয়েছ দিদানের সাথে।
আপুনি এখন এসব বলছো কেন
বলছি আজই সময, আজ না মা দিবস পালন করছে আমাদের বাসার সবাই। বাবাই মা নিয়ে তার পত্রিকায় আর্টিকেল লিখেছে,
অথচ নিজের মায়ের খবর না নিয়ে বিশ্বের মায়ের৷ মঙ্গল কামনা করছে।
আপুনি মামনি বাবাই তো আমাদের জন্য সব করে
ঠিক একেবারে ঠিক তোর বৌ তোকে এটাই বোঝাবে তুইও তাই বুঝবি। তবে আমি কখনও আমার সন্তানকে শেকড় কাটা করব না।
সকলের বিস্ফোরিত দৃষ্টির অগ্নি পেরেক পাড়ি দিয়ে
সেমন্তি বারান্দায় দাঁড়াতে এম্বুলেন্সের আওয়াজে জেগে ওঠে সমস্ত পাড়া ....

 

রোকেয়া ইসলাম
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top