সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

আন্না তড়খড়কে লেখা একটি না-খোলা চিঠি : অনিরুদ্ধ আলি আকতার


প্রকাশিত:
২৯ এপ্রিল ২০২২ ০৩:৩৪

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ০১:৫৪

ছবিঃ আন্না তড়খড়

 

প্রিয় নলিনী…….

একি শুনিলাম ! হায় ! মাথার যেন তীব্র এক বজ্রাঘাত হইল। তুমি নাই!
আমার নলিনী নাই!—এ আমি কেমন করিয়া বিশ্বাস করিব। না, এ কিছুতেই হইতে পারে
না। বরষাও তো সেই কখন থামিয়া গিয়াছে। কই এই চন্দ্রালোকিত রাত্রি, এই
জ্যোৎস্না স্নাত মৃদুমন্দ বাতাসতো সেকথা কহিতেছে না, দেউড়ির সেজবাতিরাওতো
সেভাবেই দীপ্যমান, ঐ তো বৈঠকখানায় সেতার বাজিতেছে আনন্দ রাগিনীতে; কই
কোথাওতো ব্যাথার গান প্রতিধ্বনিত হইতেছে না। সকলেই তো কহিতেছে আছে, আছে।
আমার নলিনী আছে।

এই তো সেই দিন, বোম্বাইয়ের সাগর তীরে তোমার-আমার প্রথম দেখা হইল।
অনন্ত সাগরপাড়ে দাঁড়াইয়া সেই প্রথম আলাপেই বোধ হয় কোন্ এক অন্তহীন
মায়াজাল বিছাইলে তুমি। মায়াবি টানে তোমাদের গৃহে গিয়া উঠিয়াছিলেম।
মেজদাদাই লইয়া গিয়াছিলেন। তোমার জিম্মায় আমাকে বন্ধক রাখিয়া দাদা
কহিলেন—এইটেকে একেবারে খাঁসা বিলাতি জেন্টেলম্যান্ বানাই দিলেই তবে তোমার
ছুটি। মনে পড়ে ? আমাকে বিলাতি করিয়া তুলিতে তোমার কতই না কসরত। কত কী না
করিয়াছিলে সেই দুই মাস ! কতই না আদব-কায়দা, কথার ঢঙ হাত ধরিয়া,মুখমুখি
বসিয়া তোতার বুলির মতো শিখাইয়াছিলে। এই নবীন বিদ্যার্থীকে আপন করিয়া আরো
কত কীই না শিখাইবার মতলব কষিয়াছিলে কে জানে ! কী যে মাথা-মুণ্ড
শিখিয়াছিলাম জানি নে। শুধু এইটুকু মনে পড়ে, চোখে চোখ রাখিয়া কোনো এক
দূরারোগ্য ঘোরের মধ্যে টানিয়া লইয়া গিয়া তুমি পরম দানি হইয়া উঠিয়াছিলে।
তোমার সে দান আমি কতখানি গ্রহণ করিতে পারিয়াছি জানিনে, শুধু এইটুকু
বুঝিয়াছি--তুমি যাহা দিয়াছ তাহা তোমারও চাইতে বড়ো। তোমার সে দানে আমি যে
রঙিন হইয়া উঠিতেছিলাম তাহা তুমি নিশ্চিত বুঝিয়াছিলে। আর বুঝিয়াছিলে
বলিয়াই বোধ হয়, শিখাইবার নানা ফাঁদ পাতিয়াছিলে। মনে আছে সে সকল দিনের কথা
? দুপুরে হঠাৎ তুমি আমার ঘরে প্রবেশ করিলে। সদ্য স্নাত ছিলে তুমি। বিলাতি
পোষাকে তোমাকে বেশ মানাইছিল। তখনও তোমার চুলের ফোটা ফোটা জল শিশির
বিন্দুর মতো চমকাইতেছিল। ধোপদুরস্ত পোষাকে নিজেকে বিলাইয়া দেবার ঢঙে
নিজেকে এলাইয়া দিলে আমার পড়বার টেবিলের সম্মুখে। নত হইলে। মনে হইল যেন
অলকাপুরী হইতে এক অপ্সরী আমার মনবিতানে পুষ্পাঞ্জলি দিতে নতমুখ। সুগন্ধে
ভরিয়া উঠিল ঘর। হঠাৎ সটান তোমার বুকের কাছে আমার হাতটা টানিয়া তামাসার
ঢঙে কহিলে—ওগো অনেক লেখাপড়া হইয়াছে। এখন এসো একপোস্ত টাগঅফ ওয়ার হইয়া
যাক। বিলাতে এসকল বেশ কাজের। আমি তোমার কথা শুনিয়া বেশ অবাই হইয়াছিলাম।
টাগ অফ ওয়ার ! দড়ি টানাটানি ! হাতে তোমার কোনো দড়ি নাই অথচ দড়ি টানাটানি
! এ কেমনতর শিক্ষা! ঠাকুরবাড়িতে আমি কুস্তি শিখিয়াছি বটে কিন্তু এমনতর
দড়িহীন দড়িটানাটানি খেলা তো কোন্ দূরস্থ, এমন আজব কথা কখনো শুনি নাই।
আমাকে অমন হতচকিত দেখিয়া মুচকি হাসিলে। তোমার আজানুলম্বিত দক্ষিণ হস্ত
বাড়াইয়া ভাঙা বাঙ্গালায় কহিলে—এই নাও ধরো, দেখি কতটা দুধো খাইয়াছে। আমি
তোমার কথা শুনিয়াই হো হো করে হাসিয়া উঠিলাম। তুমি পালোয়ানের মতো কব্জি
বাহির কারিয়া খপ্ করিয়া আমার দক্ষিণ হস্ত ধারণ করিয়া দিলে টান। ভীষণ এক
ঝাকি খাইয়া তোমার বক্ষের নিকটে আসিতেই, নিজেকে রক্ষা করিতে আমি যেই মাত্র
বল প্রয়োগ করিলাম, অমনি তুমি আমার হস্ত ছাড়িয়া দিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া
উঠিলে। আমি ততক্ষণে চিৎপাত হইয়া মেঝেতে গড়াগড়ি খাইতেছি। আমার অমন অসহায়
অবস্থা দেখিয়া তুমি ছুটিয়া আসিয়া জাপটে ধরিয়া তুলিতে। অনুভব করিলাম এক
পরম সুখ। বুঝিলাম, তোমার ঐ বক্ষমাঝেই আমার আজীবন নিরাপদ আশ্রয়।

তোমার মনে পড়ে নলিনী, সেই নতুন দস্তানা খোলার কাণ্ডটা ? তুমিই তো
আমাকে কহিয়াছিলে, যদি কোনো পুরুষ কোনো ঘুমন্ত যুবতির হস্ত হইতে তাহারই
অজান্তে দস্তানা খুলিয়া আনিতে পারে, তাহা হইলে তাহাকে চুম্বনের অধিকার
জন্মায়। সে কথা শুনিয়াই তো আমি অমন কাণ্ড ঘটাইছিলাম। আমার মতো একটা
সপ্তদশ বর্ষীয় যুবকের পক্ষে তোমার হস্ত হইতে দস্তানা চুরি তো কোন্ ছার,
তোমার ঠোঁট হইতে রঙ চুরি করাও যে অসাধ্য নহে তাহা তুমি বুঝিয়াই তোমার সেই
অভিসন্ধির জালে জড়াইয়া আমাকে তুমি পরাস্ত করিতে চাহিলে। সেই দিন তোমার
খোলা দস্তানা চুরি আমি করি নাই, চুরি করিয়াছিলাম তোমার মন। আর সেই চুরির
শাস্তি হিসেবে আমি যে আজীবন তোমার দাস হইয়া থাকিবো, তাহা বুঝিয়াই তুমি
আমার সকল আবদার মাথায় করিয়া রাখিতে। সেই দুই মাসের কথা আমি দুই জনমেও
বলিয়া শেষ করিতে পারিব না। আজ সেই সকল স্মৃতিই আমার মনটাকে মোচড়াইয়া কী
এক দুঃসহ যন্ত্রণায় ডুবাইয়া দিতেছে।

মনে পড়ে। আমি বিলাত গিয়াছিলাম, আর তুমি গিয়াছিলে লিটলডেলের ঘরে নব
বধূ হইয়া। ফিরিয়া আসিয়া আমি মানকে পত্র লিখিয়া জানিলাম, তুমি লিটলডেলকে
ভালোবাসিয়াই বিবাহ করিয়াছ। প্রথমে আমি বিশ্বাসই করি নাই। কিন্তু যখন
দেখিলাম দিন চলিয়া যায় আমার নলিনীর আর কোনো সাড়া নাই! তখনই বুঝিলাম আমার
নলিনী আর নলিনী নাই, আন্না তড়খড় হইয়া অন্যের হৃদয় সাম্রাজ্যের রানি
হইয়াছে। তখন মনকে বুঝাইলাম এই বলিয়া যে, তুমি যেথায় সুখে থাকো, সেই তো
আমার সুখ। তোমার সুখের ঘরে আমার হাহাকার ধ্বনি যেন না পৌঁছায়। নিজেকে
প্রবোধ দিয়াছি এই বলিয়া যে, তোমাকে হারাইয়া আমি তোমাকে চিরদিনের করিয়া
পাইয়াছি। আমার ক্ষনিকা, মায়ার খেলা, ভগ্নহৃদয়ে আমি তোমাকে কতনা রূপে-রসে
নিজের হাতে সাজাইতেছি প্রতিনিয়ত। মন চাইলেই তোমাকে আমি বুকে করিয়া রাখি,
তোমার গায়ের গন্ধ মাখি প্রাণ ভরিয়া। কে বলিয়াছে তুমি নাই ?

কিন্তু আজ এ কী খবর শুনিলাম ! কোন্ এক দূরারোগ্য ব্যাধি তোমাকে ইহজগৎ
হইতে নাকি ছিনাইয়া লইয়া গিয়াছে অনন্তলোকে। বিশ্বাস করো, আমার কাছে থাকিলে
তোমাকে আমি এইভাবে পালাইতে দিতেম না। আমার সর্বস্বর বিনিময়ে তোমাকে আমি
বুক দিয়া আগলাইয়া রাখিতাম। যমরাজকেও ফিরাইয়া দিতাম এই বলিয়া যে, ও আমার
একান্ত আপনার ধন, ওকে ছোঁয়ার অধিকার কাহারো নাই।

চোখের পাতা ভারি হইয়া আসিতেছে। চোখের জল বাগ মানিতেছে না। মনটা বরফের
মতো শীতল হইয়া যাইতেছে। আকাশ জুড়িয়া কালো মেঘের ঘনঘটা দেখাদিয়াছে।
টাপুর-টুপুর বৃষ্টি নামিয়াছে। এমনো বরষায় আমি একেলা এই ঠাকুরবাড়ির খোলা
ছাদে দাঁড়াইয়া পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাইয়া জমাট কালো মেঘের রাজ্যে তোমাকে
পাগলের মতো খুঁজিয়া বেড়াইতেছি। নলিনী ! বৃষ্টি আমার চোখের জল মুছাইয়া
দিতেছে। ওফ্! মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা! দেখা দাও নলিনী। ঐ অনন্ত কালো ভেদ
করিয়া জ্যোৎস্না হইয়া একবার আমারে স্পর্শ করো। কাছে আসিয়া আমার মরু-বক্ষে
কান পাতিয়া একটি বার শোনো আমার হৃদয়বারতা—

খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা—
খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা।
কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগান্তরে
গোধূলিবেলায় পান্থ জনশূণ্য এ মোর প্রান্তরে
লয়ে তার ভীরু দীপশিখা।
দিগন্তের কোন্ পারে চলে গেল আমার ক্ষণিকা।

ভেবেছিনু গেছি ভুলে; ভেবেছিনু পদচিহ্নগুলি
পদে পদে মুছে নিল সর্বনাশী অবিশ্বাসী ধুলি।
আজ দেখি সেদিনের সেই ক্ষীণ পদধ্বনি তার
আমার গানের ছন্দ গোপনে করেছে অধিকার;
দেখি তারি অদৃশ্য অঙ্গুলি
স্বপ্নে অশ্রুসরোবরে ক্ষণে ক্ষণে দেয় ঢেউ তুলি।
………………………………………………………….
হে আত্মবিস্মৃত, যদি দ্রুত তুমি না যেতে চমকি,
বারেক ফিরায়ে মুখ পথমাঝে দাঁড়াতে থমকি,
তা হলে পড়িত ধরা রোমাঞ্চিত নিঃশব্দ নিশায়
দুজনের জীবনের ছিল যা চরম অভিপ্রায়।
তা হলে পরমলগ্নে, সখী,
সে ক্ষণকালের দীপে চিরকাল উঠিত আলোকি।
……………………………………………………………………

খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা।
খুজিব তারার মাঝে চঞ্চলের মালার মণিকা।
খুঁজিব সেথায় আমি যেথা হতে আসে ক্ষণতরে
আশ্বিনে গোধূলি-আলো, যেথা হতে নামে পৃথ্বী পরে
শ্রাবণের সায়াহ্নযূথিকা,
যেথা হতে পরে ঝড় বিদ্যুতের ক্ষণদীপ্ত টিকা।
(ক্ষণিকা)

অনন্ত আঁধার ঘুচিয়ে এসো। আলো হয়ে এসো নলিনী আমার। চোখের জল মুছাইয়া দিয়া
একটি বার কহো, তুমি তোমার রবিকে এখনো জাপটাইয়া ভালোবাসো।

ইতি তোমার প্রণয়চাতক
রবি


অনিরুদ্ধ আলি আকতার
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top