সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

আঁধারের মাঝে আলো জ্বেলে যিনি অবসরে গেলেন : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
১৩ জুলাই ২০২২ ০২:০৪

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ২০:১৯

ছবিঃ তাহমিনা খাতুন

 

একটা মানুষ তার জীবনে আসলে কী চায়? অন্যের ভয়, আনুগত্য, না ভালোবাসা?
আমরা ভালোবাসার কথা বলি কিন্তু আশা করি ভয়।

আনুগত্য এবং ভয়ের প্রত্যাশায় মানুষ তার চারিদিকে এক দেয়াল তুলে রাখে। জেকে অন্যের কাছে ভীতিপ্রদ তৈরি করে রাখার জন্য সে দেয়াল ভেদ করে কাছাকাছি পৌঁছাতে দিতে চায় না তার অধঃন্যাস্তদের।
স্যার শব্দের এক ভয় এবং নিষেধের দেয়াল আন্তরিকতা আর ভালোবাসার কাছাকাছি আসতে দেয় না কর্মচারী আর কর্মকর্তাদের।
প্রথা ভেঙ্গে, নিযম ভেঙ্গে, আনুগত্য আর ভয়ের দেয়াল উপেক্ষা করে শুধুই ভালোবাসার প্রত্যাশায় কেউ কেউ একটা জীবন নিরলস কাজ করে যায় জীবনের ব্যক্তিগত সব কান্না লুকিয়ে।
প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক জনাব তাহমিনা খাতুন। গত ১০ ই জুন তাঁর সফল কর্ম জীবন শেষ করে অবসরে গেলেন। সফলতার সাথে সাথে উত্তরসূরীদের জন্য রেখে গেলেন তার আদর্শ আর দীর্ঘ পথ চলার সততা।
স্যার নয়। স্যার শব্দের কঠিন, কঠোর দেয়াল নয়। নয় ভয়ের দূরত্ব। আপা শব্দের ভালোবাসা, আন্তরিকতা আর ছুঁয়ে থাকার আপনজন তাহমিনা আপা। স্নিগ্ধ, প্রানবন্ত হাসি, সুমিষ্ট কথামালা আর আন্তরিকতা দিয়ে জয় করে নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ শিক্ষকের হৃদয়।

অসম্মান, অপমান আর তিরস্কারের যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজে সৃষ্টি হয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষকদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের দিন দিন দূরত্ব বেড়েই চলেছে।
বিশ্বাস, সম্মান আর ভালোবাসার যে সেতু বন্ধনটা একসময় ছিল তা যেন আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
এখন পারস্পরিক অবিশ্বাস আর অশ্রদ্ধাই তৈরি হচ্ছে দিন দিন।
চাকুরি জীবনের শেষ প্রান্তে প্রায়। একটা সময় ছিল বিদ্যালয়ে নতুন কর্মকর্তা এসে বলতেন, "আপনার সম্পর্কে পূর্বের কর্মকর্তার কাছে আগেই অনেক কথা শুনেছি। আপনাকে না দেখলেও আপনার কাজের সাথে অনেক আগে থেকেই আমি পরিচিত।"
বর্তমানে অনেক কর্মকর্তা আসেন। বিরক্ত নিয়ে তাকান। ভাবেন বয়ষ্ক মানুষ। এরা কেন যে এখনো চাকুরীতে আছে?
দীর্ঘ পথ শেষে আমার যোগ্যতা কমে আর কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ে। ফলে সৃষ্টি হয় দূরত্ব।
তাহমিনা আপার সাথে পরিচয় জয়দেবপুর পিটিআইতে। অল্প কিছুদিনের জন্য তাঁকে পেয়েছিলাম শিক্ষক হিসাবে। সদা হাস্যমুখে থাকা, আন্তরিক একজন মানুষ।
কিছু মানুষ থাকে প্রথম দেখায়ই কোন কারণ ছাড়া আপন হয়ে যায়। তিনি তেমন একজন মানুষ। সহকর্মী, শিক্ষার্থী, বন্ধু- বান্ধব প্রত্যেকেরই প্রিয় মুখ তিনি।
জয়দেবপুর পিটিআই এর সহকারী সুপার থেকে তাঁকে প্রমোশন দিয়ে অধিদপ্তরে বদলি করা হয়েছিল। দুঃখ করে বলেছিলেন, তোমাদের শিক্ষক হয়ে তোমাদের সান্নিধ্যে থাকাই আমার বেশি পছন্দের ছিল।
আপার বিদায় অনুষ্ঠানে সেদিন হেলাল হাফিজের " ফেরিওয়ালা " কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলাম। যাবার সময় বলেছিলেন, একদম পারফেক্ট কবিতা কী করে খুঁজে পেলি? চমৎকার আবৃত্তি করেছিস।
তারপর কেটে গেছে অনেক অনেক বছর। হঠাৎ হঠাৎ পিটিআই এর স্মৃতি চারণে অনেক মুখের মাঝে মনে পড়ত সেই হাসিমুখ।
ফেসবুকের কল্যাণে আবার খুঁজে পেলাম আপাকে। ততদিনে মেধা, শ্রম আর দক্ষতায় তিনি পৌঁছে গেছেন অনেক উপরে। পদ, পদবীর পরিবর্তন হয়েছে।
জেনেছি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনর একাকিত্বের কথা। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে ততদিনে দুটো সন্তানকে মানুষ করেছেন, যোগ্য করে তুলেছেন ধৈর্য আর শ্রমের বিনিময়ে। এক ছেলে আর এক মেয়ের মা তিনি।
ছেলে ডাক্তার আর মেয়ে প্রকৌশলী। সফল মা তিনি এতোদিনে।
সততা আর নিরলস শ্রম তাঁকে এনে দিয়েছে সাফল্য। চাকুরীকালীন শুদ্ধাচার পুরষ্কার সেই সততারই ফসল।
সততা রক্ষা করে নিয়ম নীতি আর আদর্শের পথে চলতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। হেরে যাননি। অবিচল থেকেছেন দায়িত্ব আর কর্তব্যে।
তাহমিনা আপার আন্তরিকতায় তাঁর চারপাশের মানুষ যেমন মুগ্ধ ছিল তেমনি তাঁকে ঘিরে যারা ছিল তারা প্রত্যেকেই তাকে ভরিয়ে রেখেছেন ভালোবাসায়। তাঁর নির্দেশমত কাজ করেছেন সবাই ভালোবেসে, স্বইচ্ছায়।
ভালোবাসা যতোটা মানুষ দেয়, ফিরে পায় তার শতগুণ।
যে সব কর্মকর্তারা নিজেকে বিশাল কিছু মনে করে অন্যদের অসম্মানের মাঝে তৃপ্তি খুঁজে পান তাহমিনা আপার জীবন তাদের চিন্তাধারাকে বদলে দেবার জন্য অনুসরণযোগ্য।
নতুনদের কাছে তাঁর কর্ম, তাঁর ভালোবাসায় সিক্ত পথ শিক্ষণীয়।
সততা, আদর্শ শব্দগুলো শুনতে সহজ মনে হলেও বর্তমান সময়ে এই শব্দগুলো ধারণ করা সহজ নয়।
এই জুন মাসেই শেষ হলো চাকুরী জীবনের পথ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই পথে রয়ে গেছে তাঁর শ্রম আর সাফল্যের গল্প।
উত্তরসূরীদের জন্য বপন করেছেন নিরহংকার, স্বপ্নময় বৃক্ষের বীজ। ভালোবাসা আর শ্রমে সবার মিলিত প্রচেষ্টায় যেখানে সৃষ্টি হয় সুন্দরের, স্বপ্নের।
প্রতি নিয়ত মানুষের অসম্মানের কাহিনী, স্যার সম্বোধন শোনার আকুতি থেকে নির্যাতন, দম্ভ আর অহংকারের সংবাদের মাঝে আলাদা বৈশিষ্টের অধিকারী অনন্য একজন তাহমিনা খাতুনের কর্মময় জীবন আমাদের এখনো স্বপ্ন দেখায়। আমাদের ভালোবাসার কাছে নত করে। আমাদের স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে প্রেরণা যোগায়।
ব্যক্তিগত কান্না লুকিয়ে হাসতে শিখায়। কাজকে ধ্যানে, উপাসনায় রূপান্তর করে। কর্মময় জীবনের প্রতিটি সম্পর্ককে সম্মান আর ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখতে শিখায়।
প্রিয় এই মানুষটির আগামী জীবন সুন্দর হোক। সুস্বাস্থ্য আর সাফল্য তাঁকে ঘিরে থাকুক। চির অম্লান থাকুক তাঁর হাসি।তাঁর জীবন হোক আগামী প্রজন্মের আদর্শ এই প্রত্যাশাই রইল।

 

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top