সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষাগুরু : কাজী খাদিজা আক্তার


প্রকাশিত:
১৩ জুলাই ২০২২ ০২:১৬

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১২:১৫

 ছবিঃ কাজী খাদিজা আক্তার

 

হেনরি এডামস বলেছিলেন, "একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলে, কেউ বলতে পারেনা তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়।" আমাদের জীবনে শিক্ষাগুরুদের প্রভাব কি বলে শেষ করা যায়? সেই কবে মাবাবা হাতেখড়ি দিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন মানুষের মত মানুষ হবার জন্য। তারপরতো গুরুশিষ্যের সম্পর্ক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে আপনার আমার জীবনকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিলো।

শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি প্রায় দশবছর। প্রতিবছর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রথম ক্লাসটি থাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চেষ্টা করি সেই ক্লাসটিতে অন্যান্য বিষয়গুলোর সাথে সাথে নৈতিকতা, ছাত্র - শিক্ষক সম্পর্ক এবং কলেজ নিয়মগুলো শিক্ষার্থীদের সুন্দর, সহজ,সাবলীল ভাষায় বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।প্রতিবছরই কিছুনা কিছু বেপরোয়া শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আমাদের জানান দেয় সময়টা সামনে ভালো যাবেনা।আর সেই ভাবনাটাকে সত্যি করার জন্য প্রতি বছরই এর সংখ্যা নগন্য হলেও অংকটা কিন্তু বেড়ে যায়।আমি অবাক হই আশাহত হই।কিছুই কি করার নেই? কে ধরবে এই বেপরোয়াদের লাগাম?শিক্ষক হিসেবে কিছুটাতো দায় থেকেই যায়।
পাঠের বাইরেও ক্লাসে নির্ধারিত সময় থেকে পাঁচদশ মিনিট সময় শুধু ওদের সাথে কথা বলি নীতিনৈতিকতা আর মেনার্স নিয়ে। মাঝে মাঝে ভাবি আমরা আমাদের শিক্ষকদের যে শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় পেতাম সেই ভয়,শ্রদ্ধা কি এখনকার ছাত্রদের মধ্যে আছে? তারা কি তাদের পরিবারের বড়দের সাথে একি আচরণ করে? পরিবার তাদের সঠিক শিক্ষা কতটুকু দিতে পারছেন? ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে একজন শিক্ষক যতটুকু ভাবার সুযোগ পায় অন্য কোনো পেশার মানুষ তা পায়না।একজন শিক্ষক তার ভবিষ্যত প্রজন্মকে খুব কাছ থেকে বড় হতে দেখে, সফল আর বিনষ্ট হতেও দেখে।জাতি গড়ার এই কারিগর তার নিজ চেষ্টা এবং মেধা দিয়ে কেবল সফলদের গল্প তৈরি করতে চায়। এমন একজন সফল মানুষকি আছেন যার জীবনে একজন শিক্ষক বা গুরুর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই? আমার মনে হয় এই অংকটি শূন্যই হবে।

জীবনে খুব কিছু না হতে পারি কিন্তু আমার জীবনে আমার প্রত্যেক শিক্ষক বা শিক্ষাগুরুর কথা আমি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি।সেক্ষেত্রে আমার মাবাবা হচ্ছেন আমার প্রথম শিক্ষক। হাতের লিখায় সাহায্য করেছিলেন সখিপুর আদর্শ শিশু কাননের সালাম স্যার। স্যারের কি চমৎকার হাতের লিখা ছিলো। অংক নিয়ে ভীষণ বকা খেতাম লালমোহন স্যারের কাছে।তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর থানার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।সকল বিষয়ের চমৎকার নোট দিতেন জামালগঞ্জ থানার আজাদ স্যার।স্যার খুব ভালো ছবি আঁকতেন।পেন্সিল দিয়ে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ , আমার আব্বার পুলিশের ইউনিফর্ম পরা এবং সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের পোট্রের্ট করে আমাদের ভাইবোনদের উপহার দিয়েছিলেন। কি চমৎকার স্মৃতিময় ছিলো আমাদের গুরুশিষ্যের সম্পর্ক। সালাম স্যার এই সেদিনও ফোন করে আব্বার কাছে আমাদের সবার খোঁজখবর নিলেন।কি অদ্ভুত ভালোবাসা।ভালোলাগতো অঞ্জলি ম্যাডামকে। ভীষণ ভালোবাসতেন আমাকে। রঞ্জিত স্যার গতবছর এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।যেখানেই দেখা হতো স্যার বিরাট একটা হাসি দিতেন, সবার খোঁজ খবর নিতেন। আর বলতেন খাদিজা তুমি যেকি অংকে ভয় পাইতা,বলেই হাসি।মডেল স্কুলের বিজয় স্যার,তিনি আমার মায়েরও স্যার ছিলেন।আর এই কথা তিনি আমাকে সুযোগ পেলেই বলতেন।আর বাসায় আম্মাও বিজয় স্যারের কথা উঠলেই বলতেন," বিজয় স্যার যখন আমাদের স্কুলে ছিলেন, তখন টিংটিঙা লম্বা ছিলেন,আর বড় বড় দুইটা চোখ,একবারে ফর্সা।" আমি আম্মাকে বলতাম আম্মা এককথা কতোবার বলো? এখন বুঝি শিক্ষকদের কথা কিংবা স্মৃতিচারণ করতে খুবই মধুর লাগে।তারপর কলেজ জীবন।নূর স্যারের ইংরেজি ক্লাস ছিলো চমৎকার। ক্লাস ভর্তি স্টুডেন্ট থাকতো।" জিম এন্ড ডেলা "পড়ানোর সময় স্যার যেকি আনন্দ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে পড়াতেন,ইস্ কি প্রাণবন্ত ছিলো ক্লাসগুলো।বাংলার হারুন স্যার অসাধারণ। আমার সৌভাগ্য আমি তাঁর ক্লাস পেয়েছিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে চবির ইংরেজি বিভাগের প্রত্যেক স্যারই চমৎকার ক্লাস নিতেন। বিশেষ করে মুহিত উল আলম,সরোয়ার মোর্শের,মাঈনুল স্যার, মাসুদুর রহমান স্যারের ক্লাস আমার ভীষণ ভালো লাগতো।জেরিন ম্যাডামের ক্লাস পারতে মিস করতাম না।জেরিন ম্যাডামের "নেটিভ সান", মুহিত উল আলম স্যারের" ড. ফস্টাস" আর মাসুদুর রহমান স্যারের "ম্যাকাভিটি ক্যাট" নিয়ে ক্লাসগুলো এখনও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট। খুব ভয় পেতাম নুরী ম্যাডামকে।সুকান্ত স্যার ভালো গান পারতেন,সেজন্য জনপ্রিয়তাও ছিলো। দুর্দানা ম্যামের খুব কম ক্লাসই আমাদের ব্যাচ পেয়েছিলো।ম্যাম তখন শিক্ষক জীবনে মাত্র প্রবেশ করেছেন।আজমেরী ম্যাডাম যখন ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হলেন আমরা ২০০১-২০০২ ব্যাচ তখন বিদায় নিলাম।

আমাদের শিক্ষা গুরুদের আমরা ভয় পেতাম, শ্রদ্ধা করতাম। গুরুশিষ্যের মধ্যে যে দূরত্বটা প্রয়োজন সেটা আমরা বজায় রেখেই শিক্ষকের প্রিয় ছাত্র হওয়ার চেষ্টা করতাম।কারণ আমি মনে করি, দূরত্বই শ্রদ্ধা বর্ধনে সহায়তা করে।পৃথিবী বদলায়নি।বদলেছে সময়,সংস্কৃতি,ভালোবাসার ধরণ।শ্রদ্ধা শব্দটি যেকোনো সম্পর্কের জন্য অত্যাবশকীয়।জন ব্রাইট বলেছিলেন, " প্রাচীনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকার অর্থ নিজের অস্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা।" আমাদের সমাজে শ্রদ্ধাবোধের খুব অভাব।বিনয়ী নয় ঔদ্ধত্যের ছড়াছড়ি। তাই প্রশ্ন থেকে যায়,প্রাচীন মাস্টার মশাইরা যে সম্মান পেতেন আমাদের আধুনিক টিচাররা কি সেই সম্মান বা শ্রদ্ধা পান?

কেবল পরীক্ষার খাতায় "এইম ইন লাইফে" টিচার বা শিক্ষক হওয়ার চমৎকার রচনা লিখার ছাত্ররা কি কখনও মন থেকে শিক্ষক হতে চেয়েছে? যেখানে অন্যান্য দেশে সর্বোচ্চ পেশার শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মান এবং সম্মানী আর অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় সেখানে আমাদের দেশের শিক্ষকদের কথা লিখতে গেলে তাদের জীবন খরচের অংকটা কেবল দুর্বলই মনে হয়। আর ইতিহাসে হত্যার এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ছাত্রের হাতে শিক্ষকের লাঞ্ছনা এবং হত্যার মতো কুৎসিত ইতিহাস। যে সময় ইতিহাস হয়ে গেলো তা কেবল সতর্ক করে দেয় সময়টা সামনে ভালো যাবেনা।কারণ শিক্ষক যদি জাতি গঠনের কারিগর হয় আর জাতির মেরুদণ্ড যদি শিক্ষা হয় তাহলে, প্রকৃত শিক্ষা এবং শিক্ষাগুরুর অভাবে একদিন মেরুদণ্ড বিহীন জাতি পৃথিবীর কাছে মাথা নত করে মাটির সাথে মিশে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হবে।

 

কাজী খাদিজা আক্তার 
প্রভাষক (ইংরেজি)  
সরাইল সরকারি কলেজ

   

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top