সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণ যেন বাঙালির মর্মছেঁড়া বেদনার মাস : মাহবুবুল আলম


প্রকাশিত:
১১ আগস্ট ২০২২ ০২:৩০

আপডেট:
১১ আগস্ট ২০২২ ০২:৩৬

ছবি : মাহবুবুল আলম


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্বের রাজনীতির ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন। এই দিন বাংলা ও বাঙালির কান্না ও বেদনার দিন। কেননা, এদিন মানুষের শোকের বিলাপ ও শ্রাবণের আকাশের কান্না মিলেমিশে একাকার হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শোকে ও বেদনার মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে। ইতিহাসের এই কলঙ্কময় দিনে মানবতার শত্রু ও প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকচক্রের হাতে বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, জাতির পিতা বিশ্বের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের কন্ঠস্বর, বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ, বাঙালির নিরন্তন প্রেরণার চিরন্তন উৎস, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একদল উশৃংখল বিপদগামী জুনিয়র সেনা সদস্যের হাতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর গোটা বিশ্বে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। হত্যাকারীদের প্রতি ছড়িয়ে পড়েছিল ঘৃণার বিষবাষ্প। পশ্চিম জার্মানির নেতা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, "বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।"

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ছিল পবিত্র জুম্মাবার। সেদিন সুবেহ সাদিকের সময় যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটবৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন শ্রাবণের আকাশে ঝরছিল অবিরাম বৃষ্টি, এ বৃষ্টি যেন ছিল প্রকৃতিরই বেদনাশ্রু। সে-দিন ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের আস্ফালনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল; এমন নৃশংস শোকাবহ ঘটনার আকস্মিকতায় মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। মানুষের মনের সে-শোকের আগুন আজও নেভেনি, কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্ত:সত্তা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অকুতোভয়। নৈতিকভাবে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। নীতিতে ছিলেন অটল। রাজনৈতিক আদর্শে অবিচল। তিনি ছিলেন হিমালয়ের মতো সমুন্নত। কোনো অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নোয়াননি, এমনকি, মৃত্যুকেও তিনি কখনো পরোয়া করেননি। ভয় পাননি জেল জুলুমকে। নিজের কথা, পরিবার পরিজনের কথা না ভেবে ভেবেছিলেন দেশের কথা। দেশের মানুষের কথা।

পুরো পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু দেশ জুড়ে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের কথা তুলে ধরেছেন। মানুষকে জাগ্রত করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উজ্জীবিত করেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে আবার জনসভায় যোগ দিতেন। আবার গ্রেপ্তার হতেন। কখনো দেখা যেত জেল থেকে বের হয়ে জেলগেটেই জনতার উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে মানুষের মনে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিতেন। এভাবেই ছয় দফার পথ ধরে বঙ্গবন্ধুর ডাজে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর আঘাতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল তখন হত্যা, ধর্ষণ লুটতরাজের প্রতিবাদে ঝলসে উঠল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসের প্রতিরোধ যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে এদেশ স্বাধীন করেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা।

পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় দোসররা মুক্তিযুদ্ধের এই পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি। ধ্বংসস্তূপ থেকে যখন বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে, বাংলার মানুষ যখন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে, তখনই স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত অপশক্তি বর্বর আঘাত হানে। ষড়যন্ত্রের নীল নকশার অংশ হিসেবে পঁচাত্তরের পনের আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে পরিবার ও স্বজনসহ। সেদিন ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িটি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের
তাজা রক্তে ভেসে গিয়েছিল।

১৯৭৫ সালে সেই ঘৃণ্য বর্বরোচিত হত্যাকান্ড শুধু কিছু বিপথগামী উচ্চাভিলাসী সেনা কর্মকর্তাদের আক্রমন ছিল না, এর পেছনে ছিল দেশি বিদেশি নানান ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়াই ছিল সেই চক্রান্তের অন্যতম অংশ। বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমতায় আনাই ছিল পনের আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য।

আগস্ট মাসে শুধু বাঙালির ভাগ্যাকাশেই নেমে আসে না দুর্যোগের ঘনঘটা, সমগ্র বাংলাদেশের মানচিত্রেই পড়ে শোকের গাঢ় ছায়া। বাঙালির সমস্ত হদয়ে পুঞ্জীভূত হয় সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বেদনার স্রোত। সবার অন্তরে জাগে শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রতীতি। জাগে প্রতিশোধের দুর্নিবার স্পৃহা। জাতির পিতাকে পরিবার ও স্বজনসহ হারানোর বেদনায় মথিত ভয়ঙ্কর শোকের মাস আগস্ট। আগস্টের এই দুঃসহ দিনে এক বুক বেদনা আর শোকের স্মৃতি ঘিরে রাখে প্রতিটি বাঙালিকে। আগস্টে বাঙালি শোকে মুহ্যমান হয়।

বাঙালি জাতি এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড কখনো মেনে নেয়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রুখে দাঁড়িয়েছে। হত্যাকাণ্ডের যে খলনায়কদের বিচার না করে পুরস্কৃত করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করেছে। জাতিকে করেছে কলঙ্কমুক্ত।

নরঘাতকেরা ভেবেছিল হত্যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মানুষের মন থেকে চিরতরে মুছে দিতে পারবে। তাদের জানাছিল না বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয়তাবাদী নেতাকে হত্যা করলেও তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। কেননা, তিনি বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি। কাজেই যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন তিনি অমর হয়ে থাকবেন। তিনি সমগ্র জাতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায়
ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ত প্রস্তুত করেছিলেন। তাই চিরঞ্জীব তিনি এ জাতির চেতনায়। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধানও প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শোষক আর শোষিতে বিভক্ত সেদিনের বিশ্ববাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন শোষিতের পক্ষে।

বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসিত হতে থাকে। তারা এ দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে নানা উদ্যোগ নেয়। শাসকদের রোষানলে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও যেন নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেছিল মোশতাক সরকার।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার সেই কুলাঙ্গার ঘাতকচক্র ও তাদের
দোসরা এখনো হত্যা ও ষড়যন্ত্রের পথে চলছে। বোমা ও গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে রক্তাক্ত করছে। পনের আগস্টের শোককে তাই শক্তিতে পরিণত করতে হবে সকল
দেশপ্রেমিক বাঙালিকে একতাবদ্ধ হয়ে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু অন্য সকল মৃত্যুর চেয়ে আলাদা, অন্যরকম, বড় বেদনার, বড় কষ্টের। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুবরণ করেননি। তাকে হত্যা করা হয়েছে রাতের অন্ধকারে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এবং তা করেছে কাপুরুষোচিতভাবে। তাই বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়
আর খুনি হন্তারক এবং তাদের দোসররা থাকবেন
ঘৃণা ও অভিশাপের নরকের সর্বনিম্ন স্তরে।

 

মাহবুবুল আলম
কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top