সিডনী রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

না ফেরার দেশে "কালপুরুষ"-"কালবেলার" অমর স্রষ্টা: সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১১ মে ২০২৩ ২১:৫১

আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:০০

ছবিঃ সমরেশ মজুমদার

 

কালবেলায় বিদায় কালপুরুষের। চিরঘুমের দেশে সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই, সোমবার বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হলেন, বাঙালির অতি প্রিয় এই সাহিত্যিক। সন্ধ্যা পৌনে ৬টা নাগাদ তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। একাধিক কালজয়ী উপন্যাসের লেখক সমরেশ মজুমদারের মৃত্যুতে বাংলায় শোকের ছায়া! দুই বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার আজ না ফেরার দেশে। বাঙালির কাছে আজ বড় দুঃখের দিন।

তার অনেক রচনাতেই উত্তরবঙ্গের কথা ঘুরে ফিরে আসে। তিনি বেশ কিছু সফল টিভি সিরিয়ালের কাহিনিকার। তার কোন ছদ্মনাম ছিল না। তিনি নিজ নামেই গ্রন্থ রচনা করতেন। জন্ম ১০ মার্চ ১৯৪২, গয়েরকাটা, জলপাইগুড়ি। মৃত্যু ৮ মে ২০২৩ (বয়স ৮১)। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, চিত্র নাট্যকার, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনীর লেখক ছিলেন। চরিত্র সৃষ্টিতে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় রেখে গেলেন। মাধবীলতা, অনিমেশকে বাঙালী চিরকালই মনে রাখবে। সমরেশ মজুমদারের বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭১ সালের উত্তাল সময়কে নিয়ে। নকশাল আন্দোলনের কথা আছে বিভিন্ন উপন্যাসে। এক বহুকৌণিক ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিমানুষ হিসাবে তিনি এক অমল ব্যক্তিত্ব। উল্লেখযোগ্য ও কালজয়ী রচনা উত্তরাধিকার, কালবেলা, সাতকাহন, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, কালপুরুষ। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার আনন্দ পুরস্কার (১৯৮২), সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৪)। দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন। উত্তরবঙ্গের পটভূমিকায় অসংখ্য উপন্যাস ও ছোট্ট গল্প লিখেছেন। উত্তরবঙ্গের নদী -মানুষ-চা বাগান আর অনাঘ্রাত নির্মল প্রকৃতি বারবার ফুটে উঠেছে বিভিন্ন লেখায়।


তাঁর শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গোয়েরকাটা চা বাগানে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল থেকে। তিনি কলকাতায় আসেন ১৯৬০ সালে। বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে তিনি আনন্দবাজার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেডএর সাথে যুক্ত ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারএর প্রতি তার প্রচণ্ড আসক্তি ছিলো। তাঁর প্রথম গল্প “অন্যমাত্রা” লেখাই হয়েছিলো মঞ্চনাটক হিসাবে, আর সেখান থেকেই তার লেখকজীবনের শুরু। তাঁর লেখা অন্যমাত্রা ছাপা হয়েছিলো দেশ পত্রিকায় ১৯৬৭ সালে। সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস “দৌড়” ছাপা হয়েছিলো দেশেই ১৯৭৫ সালে গৌচপ্রম ছদ্মনামে। তিনি শুধু তাঁর লেখনী গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি থেকে গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাস লেখনীতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয় ভিন্ন, রচনার গতি এবং গল্প বলার ভঙ্গি পাঠকদের আন্দলিত করে। চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার নিম্নবিত্ত মানুষেররা তাঁর কলমে উঠে আসেন রক্ত-মাংস নিয়ে। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার ট্রিলজি 'উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ' বাংলা সাহিত্য জগতে তাকে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী করেছে।
অনেক অসাধারণ লেখনীর শব্দের এই রূপকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইয়াইএমএস পুরস্কার জয় করেছেন। চিত্রনাট্য লেখক হিসাবে জয় করেছেন বিএফজেএ, দিশারী এবং চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির এওয়ার্ড। সমরেশ মজুমদার কলকাতা ও বাংলাদেশ এর সর্বকালের অন্যতম সেরা লেখক হিসাবে পাঠকমন জয় করেছেন।
সৃষ্টি সম্ভার: সত্যমেব জয়তে, আকাশ না পাতাল, তেরো পার্বন, সওয়ার, টাকাপয়সা, তীর্থযাত্রী, ভালবাসা থেকে যায়। নিকট কথা, ডানায় রোদের গন্ধ, জলছবির সিংহ, মেয়েরা যেমন হয়, একশো পঞ্চাশ (গল্প সংকলন), উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিনী, হৃদয় আছে যার, সর্বনাশের নেশায়, ছায়া পূর্বগামিনী, এখনও সময় আছে, স্বনামধন্য, কলিকাল, স্বপ্নের বাজার, কলকাতা, অনুরাগ, তিনসঙ্গী, ভিক্টোরিয়ার বাগান, সহজপুর কতদূর, অনি, সিনেমাওয়ালা ইত্যাদি বহু গ্রন্থের স্রষ্টা।

শেষকথা:

উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, সাতকাহন, বুনোহাঁস পার করে কলকাতায় নবকুমার... অবশেষে থেমে গেল কলম..কালবেলা। "কালপুরুষ" এর অমর স্রষ্টা সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার চলে গেলেন....
"উত্তরাধিকার" কেউ কি থাকলেন?

সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের সৃষ্টিও পুরনো হওয়ার নয়। তাঁর চিরজীবী, রচনা গুলি আজো আমাদের আশ্রয়ভূমি, এ এক আমাদের কাছে পরম প্রাপ্তি। একদিকে উত্তরবঙ্গের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ চা উপত্যকা। ভালোবাসার নদী তিস্তা। যুগের কলতান। ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তিনি কালকে পরাস্ত করেছেন নিজের প্রতিভায়। বহু যুগ পরেও আলোচিত হবে তাঁর জীবন, তাঁর সাধনা, তাঁর সৃষ্টিকর্ম। মৃত্যু তাঁকে ম্লান করতে পারবে না। তবু এক অসীম শূন্যতার বেদনা আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ও করবে। নতুন কোন সৃষ্টির অপেক্ষায় আমরা আর উন্মুখ হয়ে থাকব না। শুধু রূপালী পর্দায় নড়াচড়া করবে তাঁর ছায়া শরীর। গম্ভীর কন্ঠে আমরা শুনব বলা-কথা। না-বলা কথার প্রত্যাশা আর রইল না। নেই আর নেই, অসংখ্য নেই- এর স্রোতে তিনি আমাদের ভাসিয়ে চলে গেলেন। চিরদিনের মতো ঘুমের দেশে।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top