অথঃ ট্রামকথা : গৌতম সরকার
প্রকাশিত:
২৬ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:২০
আপডেট:
৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:২৩
কবি বলেছিলেন, 'কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে'। কলকাতা সত্যিই কল্লোলিনী হয়েছে, তিলোত্তমা তো বটেই। যেদিকে তাকাই শুধুই হাইরাইজ, রাস্তাঘাট, রাজপথ, শপিং মল, লক্ষ লক্ষ যানবাহন আর কোটি কোটি মানুষ। এ আধুনিক শহর কবির কল্পনার তিলোত্তমার সাথে মিলবে কিনা জানিনা, সে দায় আমরা নিইনি। সময়ের নিগূঢ় স্রোতে, সভ্যতার জয়ধ্বজা উঁচিয়ে পুরোনো সবকিছুকে 'টা টা বাই বাই' করতে করতে আমরা নতুন, আরও আধুনিকের আকর্ষণে ক্রমশ এগিয়ে চলেছি৷ চলার পথে ছুঁড়ে ফেলেছি গ্রামোফোন, পোস্ট-বক্স, হলুদ-কালো ট্যাক্সি; স্মৃতির সরণী বেয়ে খুঁজে ফিরি টানা রিকশা, দোতলা বাস, টেলিগ্রাম, গ্যাস বেলুন প্রভৃতি। এই ফুরিয়ে যাওয়ার তালিকায় সংযোজন দেড়শো বছরের ঐতিহ্যময় সাবেকি সৌধ 'কলকাতার ট্রাম'। কয়েকদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে ঘোষণা হয়েছে, কলকাতার ট্রাম এখন থেকে কেবল 'জয় রাইড' হয়েই টিকে থাকবে। শেষ কয়েকবছর শহরে যে আট কিলোমিটার পরিসরের তিনটি রুট টিকে ছিল সেগুলোও তুলে দেওয়া হল। পর্যটকদের জন্য খোলা রইল এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুরের 'আনন্দ সফর'।
প্রতিটি শহরের কিছু নিজস্বতা থাকে যেগুলি চিরন্তন। সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় বহিরঙ্গ, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, দোকান-বাজার, মানুষের যাপনপ্রণালী। শাখাপ্রশাখা, শিকড়বাকড় বেড়ে চলে, বাড়তে থাকে দিগ্বিদিক, কিন্তু বনস্পতির মূল শিকড় হৃদপিন্ড হয়ে প্রোথিত থেকে যায় মাটি-মায়ের গহীন গভীরে। কলকাতার ট্রামও হল সেইরকম এক অনুভব। মানুষের এই সেন্টিমেন্ট, ভালবাসা, গর্ব আর উপলব্ধির ট্রাম চলে গেলে শহরের হৃদপিন্ড থেকে রক্ত ঝরবে৷ তার খবর কে রাখে!
ভারতে প্রথম ট্রাম চালু হয় এই কল্লোলিনী কলকাতায়। দিনটি ছিল ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। স্বল্প খরচে যাতায়াতের সুবিধার জন্য লর্ড কার্জন শহরে ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু করেন। যাত্রাপথ ছিল আর্মেনিয়া ঘাট থেকে শিয়ালদহ স্টেশন। তারপর সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরাধীন ভারতে ট্রাম পরিষেবা ছড়িয়ে পড়ে দিল্লি, মুম্বাই, নাসিক, করাচির মত দেশের অন্যান্য শহরে। ট্রাম পরিষেবার বিবর্তন কালে ১৯০২ সালে ঘোড়ায় টানা ট্রাম বন্ধ হয়ে সাহেবপাড়ায় প্রথমবারের জন্য বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চলাচল শুরু হয় এবং যাত্রাপথের পরিসর বেড়ে ৪২ মাইলে বিস্তৃত হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও ব্রিটিশ কোম্পানির তত্ত্বাবধানে বেশ কিছুদিন ট্রাম চলেছে, ১৯৬৭ সালে আইন প্রণয়ন করে কলকাতার ট্রাম কোম্পানিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়।
কালের বিবর্তনে মানুষের জীবনের গতিশীলতা বেড়েছে। গতির সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েছে সময়ের মূল্য। দিনে দিনে মানুষ এই ধীরগতি পরিবহনের বিকল্পের সন্ধানে থেকেছে। বাস পরিষেবার ক্রমোন্নয়ন এবং সর্বোপরি শহরে মেট্রো সার্ভিস চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রামের বিদায় ঘণ্টা বাজা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমত পরিস্থিতিতে আমাদের বর্ণময় ঐতিহ্যকে বাঁচাতে সরকারকে যে ঐকান্তিক উদ্যোগ নিতে হত সেই প্রয়াস চোখে পড়েনা। সত্তরের দশকে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন হাওড়া ডিভিশনের ট্রাম তুলে দেন। বাম জমানায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ট্রাম পরিষেবা বাড়িয়ে জোকা পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। ১৯৯২ সালে পরিবহন মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তী ঘোষণা করেছিলেন, এ শহরে ট্রাম শিল্পের 'স্বাভাবিক মৃত্যু অনিবার্য '। সুভাষ চক্রবর্তী পরিবহন মন্ত্রিত্বের দায়িত্বে থাকাকালীন রব উঠেছিল, টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর জমি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে সেই চেষ্টার প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! আজ সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত দিয়েই শহরের ট্রামের কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতা হল।
মধ্যবিত্তের পকেট ও পরিবেশ দূষণের প্রশ্নে ট্রাম পরিবহনের কোনও বিকল্প নেই। কলকাতা বিশ্বের এক অন্যতম দূষিত শহর। ধোঁয়া আর ধুলোভরা শহরে পরিবেশ বান্ধব এই পরিবহন একটা কার্যকরী সমাধান হতে পারত। সরকারি তরফে খুব বিক্ষিপ্তভাবে কিছু চেষ্টা করা ছাড়া এই প্রাচীন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তেমন কোনও চেষ্টা কখনও হয়নি। দিনদিন যাত্রীসংখ্যা কমেছে, স্বাধীনতার বছরে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে সাত লক্ষ মানুষ ট্রামে যাতায়াত করত, ১৯৮০ সালে সেটি বেড়ে হয়েছিল নয় লক্ষ। তারপরই সব ক্ষেত্রের মত ট্রাম পরিবহনেও একানববইয়ের আর্থিক সংস্কার ও উদারীকরণের প্রভাব পড়তে শুরু করলো । ২০১৯ সালে যখন শহরে ট্রাম পরিবহন অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়েছে তখন দৈনিক মাত্র দশ হাজার মানুষ ট্রামকে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত। পরিবেশবিদদের মতে, যাত্রীদের চাহিদা মেটাতে ট্রামের পরিবর্তে কলকাতার রাস্তায় যখন আরও বেশ বাস, গাড়ি নামবে, শহর আরও বেশি দূষিত হবে, বাতাসের মান আরও কমবে, রাস্তাঘাটে যানজট বাড়বে। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, ট্রামবন্ধের সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে লাভজনক নাও হতে পারে। অন্যান্য যানের তুলনায় এই পরিবহনে জ্বালানি খরচ কম, রক্ষণাবেক্ষণ এবং অবচয় ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে স্বল্প। তাই তাঁদের মতে, দীর্ঘকালে ট্রাম চালানো লাভজনক হতে পারতো।
সরকারি মতে ট্রাম দীর্ঘদিন ধরে রুগ্ন শিল্পে পরিনত হয়েছিল। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সেন্টিমেন্ট সবকিছুর কথা মাথায় রেখেও কোথাও একটা থামতে হয়। দিনের পর দিন আর্থিক ভর্তুকি দিয়ে ঐতিহ্যকেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। রাজ্যের পরিবহন মন্ত্রকের তথ্য জানাচ্ছে, ১৯৯১-৯২ সালে ট্রাম কোম্পানির আয়ের পরিমাণ ছিল ১০.৫ কোটি টাকা, অন্যদিকে বাৎসরিক ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৫.২৫ কোটি টাকায়। এই ঘাটতি মেটাতে কোম্পানিকে যে ঋণ নিতে হয়েছিল সেই ঋণের জন্য সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছিল বছরে ২ কোটি টাকা। পরের বছর ১৯৯২-৯৩ আর্থিক বর্ষে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৬.৭৫ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পরবর্তী বছরগুলিতে ক্রমশ বেড়ে চলছিল। যদিও ট্রামের এই দৈন্যদশা একদিনে হয়নি। আটের দশক থেকে কলকাতার ভূতল পরিবহণে ট্রাম যে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল সেটা দেখার পরও সরকার নিজের নীরব ভূমিকার কথা অস্বীকার করতে পারেনা। এই শিল্পকে বাঁচানোর পরিবর্তে এমন কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হয়েছিল যেগুলো পরোক্ষে এই শিল্পের ধবংসকে ত্বরান্বিত করেছে। সেটা ১৯৯২ সালে হঠাৎ করে ট্রামের কর্মীদের নিয়ে বাস চালানোর চেষ্টাই হোক, বা ১৯৯৪ সালে হাওড়া ব্রিজ থেকে ট্রামের লাইন তুলে দেওয়া যায় হোক না কেন। অন্যদিকে দিনদিন এই পরিবহন যাত্রীদেরও ভরসা হারাচ্ছিল। অবশেষে সরকার, জনগণ, যাত্রী সবার উপেক্ষা আর অযত্নের সম্মিলিত ফল হল একদা ভালোবাসার ট্রামের অকাল মৃত্যু। আমাদের সরকার যখন বলছে ট্রাম চালানো আর্থিকভাবে লাভজনক নয়, তখন লিসবন, বার্লিন, ডারলিন, ডুসেলডর্ফ প্রভৃতি বিশ্বের অন্যান্য শহরে এই পরিষেবা পুনরুদ্ধার ও আধুনিকীকরণের চেষ্টা হচ্ছে, দুবাই, তাইওয়াননের মত দেশে নতুন করে ট্রাম চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে।
আমেরিকা, জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ অন্যান্য যানের ব্যবহার কমিয়ে যখন অপেক্ষাকৃত দূষণমুক্ত কমখরচের ট্রাম পরিবহন বৃদ্ধির কথা ভাবছে তখন আমরা স্রেফ গতিহীনতা ও মিথ্যে যানযটের অছিলায় এতদিনের ঐতিহ্যকে 'গোল্ডেন হ্যান্ডশেক' দিয়ে বিদায় দিলাম! ট্রাম তো শুধু কলকাতাবাসীর কাছে যাত্রামাধ্যম ছিলনা, ট্রাম অচ্ছেদ্যভাবে আমাদের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ভালোবাসা, আবেগ আর উপলব্ধিতে মিলেমিশে ছিল। ব্যস্ত সময়ের গতিময়তা ট্রামকে পরিবারের প্রবীণ সদস্যের মত পরিত্যাগ করেছে। একদা শহরের ভালোবাসার ট্রামের কথা এরপর 'ট্রামকথা' হয়ে স্মৃতির ইতিহাসে রয়ে যাবে। দুই ট্রাম লাইনের মাঝে মাথা রেখে শুয়ে কবি বিড়বিড় করে বলবেন,
"কী এক ইশারা যেন মনে রেখে
একা একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি;
অনেক দেখেছি আমি ট্রাম বাস
যত ঠিক চলে; তারপর পথ ছেড়ে
শান্ত হয়ে চলে যায়
তাহাদের ঘুমের জগতে।"
সমাপ্ত
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: