সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

অগোচর : ড. বেগম জাহান আরা


প্রকাশিত:
২৬ অক্টোবর ২০১৯ ০২:১৮

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ১৪:০১

 

আমেরিকা গিয়েছিলো শাহি চার সপ্তাহের জন্য। বহু দিনের পরিকল্পনা যে একমাস চুটিয়ে ঘুরে বেড়াবে। পরে নিজেই পরিবর্তন করলো পরিকল্পনা। আমেরিকার বেড়ানো একটু ছোটো করতে পারলে দুদিন লন্ডন আর চারদিন বার্লিনে থাকা যাবে। তাহলে মোটামুটি ট্রিপটা  ভালো হয়। পঞ্চাশ পেরোনোর পরে এখন যে কয়জন বন্ধু আছে, তার মধ্যে এরা এখনও জানে জিগরি দোস্ত।

অনেক ধানাই পানাই করে লস এঞ্জেলেসের  চাচা শাকুর সাহেবকে বলে শাহি, চাচা, এবার তোমার এখানে সাতদিন থাকা যাবে না। বলিস কি রে? হঠাৎ মতের পরিবর্তন কেন? হঠাৎ না চাচা। ভেবে দেখলাম, লন্ডনের রাজা আর বার্লিনের মিশুর সাথে এবার দেখা না করলে অন্যায় হয়ে যাবে।

-তোর চাচি, মানে খালা নিশ্চয় মাইন্ড করবে। খালাকে আমি ম্যানেজ করবো চাচা। তুমি শুধু মেনে নাও।
-কি আর বলবো বল? তোরা বড়ো হয়েছিস। তোদের কথা মেনে নিতেই হয় আমাদের।
-আজই বলবো খালাকে কথাটা।

খাওয়ার টেবিলে সব বাংলাদেশের রান্না। ইলিশ মাছ, কই মাছ, গরুর মাংস, লাল শাক ভাজি, করলা ভাজি, মুগের ডাল, এই সব দেখে শাহির আনন্দ আর ধরে না। বরাবরই শাহি ভালো মন্দ খেতে পছন্দ করে। চাচা বলেন, গরুর মাংস আর ইলিশ মাছ একসাথে না খাওয়াই ভালো। আবার ডেসার্ট আছে।
-খাওয়ার সময় ডাক্তারি করোনা চাচা। মিনতি করে শাহি।
-তোর চাচার তো এই কাজ। খালা মুখ ভার করে বলে, খেতে শুরুই করলো না ছেলেটা।
-দেখছো না, একটু মুটিয়ে গেছে তোমার ছেলেটা। ডাক্তার শাকুর মিহি গলায় বলে।
-একটু কি চাচা? প্রায় ডবল হয়ে গেছি। শুনেছি, মা আর খালা নাকি আমাকে ঠুঁসে ঠুঁসে খাওয়াতো ছোটো বেলায়। উচ্ছল হাসি শাহির মুখে।
-থাক আর ওসব কথা বলতে হবে না। তুই তোর ইচ্ছে মতো খা দেখি। আমি উঠিয়ে দেবো সর্শে ইলিশ?
-না খালা, আমি নিজেই নেবো। তুমি বসে যাও প্লিজ।
চাচা খালা, মানে চাচির মনে কশট দিয়েই শাহি চলে আসে লন্ডনে। এই চাচি আসলে শাহির খালা। দুই ভাই ধুই বোনকে বিয়ে করে। কিন্তু খালা ডাকটা শাহি আর পারেনি ছাড়তে।
হিথরো এয়ারপোর্টে নিতে এলো রাজা আর লিসা। প্রায় দশ বছর পর দেখা। খুব খুশি হলো দুজনে শাহিকে দেখে। রাজা বলে, যাক এতোদিনে ম্যানলি হয়েছিস।
-মানেটা কি হলো? আগে কি ওম্যানলি ছিলাম?
-হা হা হা, মানে গায়ে গতরে একটু মাংস লেগেছে এতোদিনে, এটাই বলতে চেয়েছি।
-একটু কিরে? প্রায় তিন ডবল হয়ে গেছি।
-না না শাহি, যতো বলছো ততো না। তবে ইউ লুক ভেরি হ্যান্ডসাম এন্ড এলিগ্যান্ট, বলে লিসা। উচ্চকন্ঠে হাসে তিনজনেই।
আসলে বয়স একটা ফ্যাক্টর। রাজাও বেশ মোটা হয়েছে। লিসাও আর সেই তন্বি নেই। সারা রাস্তা ড্রাইভ করলো লিসা। লন্ডন শহর থেকে প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ। গ্রাম বলা যাবে না, কিন্তু উপশহর বলা যায়। চাকরিজীবিদের অনেকেই লন্ডন শহরের কেন্দ্র থেকে একটু দুরেই থাকতে চায়। নিরিবিলি তো বটেই, একটু সাশ্রয়ও হয়।
চমতকার বাগানওয়ালা বাড়ি। ফল ফুল সবই লাগিয়েছে রাজা। ও বললো, বাগানের সখ বেশি লিসার। খাটা খাটনিও সেই করে। আমি শুধু মাঝে মাঝে ঘুর ঘুর করি ওকে সঙ্গ দেয়ার জন্য।
-তোর খেলোয়াড় ছেলে কই? বাড়িতে নেই?
-লিসবনে খেলতে গিয়ে ইনজুরি হয়েছে হাঁটুতে। চিকিতসা নিচ্ছে হাসপাতালে।
-দিন কতো বদলে গেছে রাজা, আমাদের কালে খেলা যে একটা পেশা হতে পারে, সেটা কল্পনাই করা যেতো না।
-ঠিক বলেছিস শাহি।
-আমাদের মিশু কি ভালো ফুটবল খেলতো। তখন তো ন্যাশনাল টিমে খেলার তেমন ছেলে ছিলো না। ওকে ডেকেছিলো না? মনে আছে?
-মনে থাকবে না? তোলপাড় করে তুলেছিলেন চাচা, মানে মিশুর বাবা। আমাদের ডেকে ওকে বোঝাতে বললেন। সে এক সময় গেছে। পরিবারের তরফ থেকে পাহাড়ের মতো বাধা এসে সামনে দাঁড়ালে হয় না সে কাজ রে।
-লিসা বিদেশি মেয়ে। ওরা মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। আমি চাই নি যে, বাপি খেলার পেশা বেছে নিক। কিন্তু লিসা বলে, ওর জিবন ওকেই বুঝে নিতে দাও। এই বাইশ বছর বয়সে তিন তিন বার ইনজুরি হলো। ভালো লাগে বল?
মোটামুটি বাঙলাদেশি খাবার রান্না করেছিলো দুজনে মিলে। শাহি অবাক হলো রাজার রান্নার ন্যাক দেখে। প্রসংসা শুনে রাজা বলে, বিদেশে রান্নাটা এন্টারটেইনমেন্টের মতো। মাঝে মাঝে রান্না করতে বেশ ভালোই লাগে। লিসাও বেশ পছন্দ করে আমার রান্না।
-ও ঝাল খেতে শিখেছে?
-ঐটা হয় নি। ঝাল নিতেই পারে না। ফলে কাঁচামরিচ দিই আস্ত আস্ত।
-ভালো বুদ্ধি তো!

সারা রাত দুই বন্ধু গল্প করলো। বলতে গেলে সবই খাজুরে গল্প। আসলে খাজুরে গল্পই তো গল্প। কাজের কথা বলে কি রাত কাটানো যায়? সত্যিকার বন্ধুত্ব একটা ভারি আরামদায়ক সম্পর্ক। মনে হলো তারা ফিরে গেছে কিশোর বেলায়। ক্যাডেট স্কুলের জিবন আর দশটা স্কুলের চেয়ে অন্য রকম বরাবরই। দুই বন্ধু খেলা ধুলোয় ছিলো দারুন। সেজন্য স্যারেরা ভালোবাসতেন। সিনেমার মতো মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সব স্মৃতি।

দু দিন যেনো দু ঘন্টায় কেটে গেলো। এবার বার্লিনে মিশুর ওখানে যাওয়া। কাল রাতেও কথা হয়েছে। ওর বউ দিবাও কথা বললো। ইউনিভার্সিটির জিবনে দিবা ছিলো সকলের ‘ড্রিম গার্ল’। শাহি মনে মনে ভালোবাসতো দিবাকে। বেশ ভালো গান গাইতো। এক অনুষ্ঠানে দিবার সাথে মিশু হেঁড়ে গলায় গানের ধুয়া ধরেছিলো। সেই ক্রেডিটেই  কিনে ফেললো দিবার মন। যেনো ছোঁ মেরে কোনো গাংচিল সাগর থেকে মাছ তুলে নিলো।

তো যাক, ওরা ভালো আছে, সেটাই সবচেয়ে আনন্দের কথা। তবে দিবার কথা তার মনে পড়ে হঠাত হঠাত। কেমন নড়ে চড়ে ওঠে বুকের ভেতর। কেউ জানে না তার এই কষ্টের কথা। বলতে কি দিবাকে দেখার জন্যই শাহির বার্লিনে আসার প্রোগ্রাম। খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে দেখতে। কাউকে তো আর বলা যায় না সে কথা।ভাবের ঘরে চুরি করে থাকতে হয়।

খুব রাগ হয়েছিলো মিশুর ওপর। শাহি ওর থেকে ভালো গান করতে পারতো। কিন্তু দিবার কন্ঠ এতোই মিশটি, তার লজ্জা হয়েছিলো। বুক চিতিয়ে স্টেজে উঠে গেলো মিশু। অনেক দিন কষ্ট পেয়েছে শাহি। ষাটের দশকে প্রেম ছিলো পিউরিটান। বেশি কাছাকাছি যাওয়া যেতো না। দিবাকে ছাড়া জীবনটা কাটিয়ে দিলো তো। কখনও ওর খারাপ চায় নি।

আসলে মানুষ কোনোদিন কি মনের গোপনতমো কথা কাউকে বলতে পেরেছে? শাহির মনে হয়, পারেনি। ভাবের ঘরে চুরি করা যায়, কিন্তু ভাবের ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয়া যায় না। মানুশ এক আজব জিনিস! কতো সিক্রেট যে মনের অগোচরেও বাস করে, তার খবর মানুষ নিজেই কি জানে সব? কতোদিন পর দিবাকে দেখবে! ও কি জানতো যে, শাহিও তাকে মনে মনে চাইতো? যাক ওসব কথা।

ওদের সন্তানাদি হয় নি। অনেক ডাক্তার বদ্যি দেখিয়েছে। পরিক্ষা নিরিক্ষা করিয়েছে। অবশেশে জানা গেলো, কবিরেরই সমস্যা। শুক্রানু নির্গত হওয়ার সাথে সথে তা মরে যায়। কবির বলেছিলো, টিউব বেবি নিতে। তাতে দারুন আপত্তি দিবার। শুধু মাত্র নিজের ডিম দিয়ে অন্যার বাচ্চাকে লালন করতে পারবে না নিজের শরিরের মধ্যে। অনেক পরে একটা মেয়ে এডপ্ট করেছে কবির আর দিবা। তাকেই মানুষ করছে অতি যত্নে।
বার্লিন এয়ারপোর্টে কবিরদের সাথে একটা কালো নাদুশ নুদুশ মেয়েকে দেখে প্রথমে বুঝতে পারেনি যে, এই সেই মেয়ে, যাকে তারা এডপ্ট করেছে। তৃতীয়বিশ্বের মানুশ যতোই শিক্ষিত হোক, সংস্কার সাধারনত যায় না। প্রথমেই মনে হলো, জার্মানিতে থেকে একটা ফুটফুটে বাচ্চা এডপ্ট করতে পারলো না? দিবার পাশে ওকে ঠিক মানাচ্ছে না। নিজেকে নিজেই তিরস্কার করে শাহি, এসব কি ভাবছে সে? সুখের অবয়ব এক এক জনের কাছে এক এক রকম। ওরা ভালো থাকলে তার এতো সব ভাবার দরকের কি?
ইমিগ্রেশন থেকে বেরোতেই ওরা এগিয়ে এলো। মিশু জড়িয়ে ধরলো শাহিকে। দিবাও আলতো করে জড়িয়ে ধরলো আবেগে। মেয়েটা মায়ের গা ঘেঁশে দাঁড়ায়। দিবা বলে, ও মারিয়া। আমাদের একমাত্র মেয়ে।
ধিরে ধিরে ওরা পার্কিং লটের কাছে গেলো। ঝক ঝকে ‘বি এম ডব্লিউ’ গাড়িতে করে রওনা দিলো বাসায় পথে। মিশু বলে, কি রে, চুপ করে আছিস কেনো?
কিন্তু পালন করে এরাই।
-তুই তো আমেরিকা লন্ডন হয়ে এলি। ওসব দেশও তো পরিষ্কার শাহি।
-কথা ঠিক। তবে তামা আর কাঁসা মাজলে কি এক রকম চক চক করে?
হো হো করে হেসে ওঠে মিশু, ভালো তুলনা দিয়েছিস তো!

শাহির মনটা যে হারিয়ে গেছে কোথায়, কেউ জানলো না। দিবাও কি অতিতের কথা ভাবছে? একদার না বলা কিছু কথা মনে পড়ছে? ও কথা বলছে না কেনো? কিছু তো নিশ্চয় ভাবছে। মেয়েটা অনেক কথা বলছে দিবার সাথে। সব কথার জবাব দিচ্ছে না দিবা। মারিয়া জোরে বলে ওঠে, মা, আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?
পেছনে বসেছে মা আর মেয়ে। মনে হলো, আনমনা দিবা একটু বিরক্ত হলো, শুনছি তো মা। বুঝেছি, তোমার খিদে পেয়েছে। এই তো বাসায় গিয়ে খাবো সবাই। ও কে?
-না মাম্মি, আমি এই নতুন চাচুর বেবি কয়টা তাই জানতে চেয়েছি।
-তুমি জিজ্ঞাসা করো বাসায় নেমে।

স্পস্টই বোঝে শাহি, দিবা অন্যমনস্ক আছে। এই তো একটু আগে হাসিমুখে তাকে হাগ করলো। কি অতুলনিয় স্পর্শ! কি দরকার ছিলো মনটাকে বেতাল করে দেয়ার?

বিশ মিনিটেই বাসায় পৌঁছে গেলো। দোতলায় একটা তিন বেডরুমের এপার্টমেন্ট। একটু অবাক হয় শাহি। এতোদিন আছে এদেশে, বাগানওয়ালা খোলা মেলা বাড়ি থাকবে না? তবে বাসাটা বড়োই। একটা ঘরে লাইব্রেরি। এটা দিবার সখ। এখন তো একটা মেয়ে নিয়েছে। তার আগে সবই ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। পড়ার অভ্যাস ছিলো বলে বেঁচে গেছে দিবা।
আরাম দায়ক লিভিংরুম। সুন্দর করে সাজানো। বাহুল্য নেই কিন্তু আভিজাত্য আছে। ঘরে ঢুকতেই মন ভালো হয়ে যায়।
মিশু বলে, কি রে একেবারে খাবার টেইলে যাবি, না আগে চা কফি কিছু হবে?
-মনে হয় মারিয়ার খিদে পেয়েছে।
-তুই তোর কথা বল, এখনই খাবি কি না?
কিচেন থেকে দিবা বলে, আমি মারিয়াকে খেতে দিচ্ছি। মাত্র সাড়ে বারোটা বাজে। আমরা না হয় এখন এক কাপ চিনা চা খাই, কি বলো শাহি?
-উত্তম প্রস্তাব। খিদেটা একটু লাগুক ভালো করে। তাছাড়া চিনা চা তো যখন তখন খাওয়া যায় পানির মতো।
-আমরা খুব পছন্দ করে খাই। এখানে এক চিনা বন্ধু আছে, সে মাঝে মাঝেই কয়েক প্যাকেট চা নিয়ে আসে।
-আজকে খাওয়া হবে কি? শাহি পেটুকের মতো জানতে চায়, সেটা কিন্তু শুনি নি।
-কি খেতে চাস? কোন দেশি খাবার চাই বল?
-অবশ্যই বাঙলাদেশের খাওয়া। শাহি জোর দিয়ে বলে।
-এই যে দিবা, শাহিকে শুনিয়ে দাও আজ কি কি আছে খাবার।
-তুমি বলে দাও না মিশু। আমি একটু দুরে আছি না?
-তুমি এসে পড়ো আমাদের মাঝে ভাই? গেস্ট রেখে কোথায় কি করো?
-আসছি বাবা, এখনি আসছি। মারিয়ার খাবার গুছিয়ে দিয়ে আসি।
শাহি বলে, বেড়ানোর প্রোগ্রাম ঠিক করেছিস?
-তোকে ম্যাপ এনে দিচ্ছি, দেখে দেখে বল।
-কি আশ্চর্য! দায়িত্বটা ছিলো তোর। এখন আমার ঘাড়ে দিচ্ছিস কেনো?
-শোন, কাল আর পরশু তোরা টুওরিস্ট বাসে কিছু দেখে নে।
-মানেটা কি হলো? তুই ছুটি নিস নি?
-আমাদের বিগ বস আসছেন হেড অফিস থেকে, তাই ছুটি নিতে পারিনি ভাই।
-কেমন কথা হলো?
-আরে বাবা, তারপর তো উইকেন্ড। আমি সোম মঙ্গল দু দিন ছুটি নিয়েছি। তার মানে একটানা চার দিন আমরা ডানা মেলে উড়বো যেখানে খুশি। হা হা হা, ঠিক আছে?
দিবা এলো আসরে চা নিয়ে। বিদেশে তো এই এক জীবন। হুকুম শোনার কেউ নেই। সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়। চায়ের সাথে ছোটো ছোটো নোনতা বিস্কুট।
-এইবার বলো ভাই, আজকের মেনু কি কি? মিশুই জানতে চায়।
-তুমি তো জানো, বললে না কেনো? দিবা হাসে। মিষ্টি হাসিটা তেমনই আছে।
শাহি একবার মিশুর দিকে আর একবার দিবার দিকে তাকায়। বলে ঠিক আছে, একেবারে খাবার টেবিলে গিয়ে ও দেখবো।
-তুমি শুটকি খাও তো শাহি? দিবা জানতে চায়।
-ব্যাঙকে বলো, পানি ভালোবাসে কি না?

খাবার টেবিলের আয়োজন দেখে মন ভরে গেলো শাহির। বেগুন দিয়ে পাঙাস মাছ, তেলাপিয়া মাছের আস্ত ভাজা, চাঁন্দা মাছের শুটকি, করলা ভাজি, পেয়াজ মরিচ ভেজে লাল করে আলুর ভর্তা, মুরগির কশা কশা রান্না আর ভাজা মুগের ঘনো ডাল। সাথে টমেটো আর শশার সালাদ। ডেসার্টও আছে দেখা যায়।

শাহি প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেয় যে, মুরগি এবং পাঙাস মাছ খাবে না। বাকিগুলো চলবে। তা শুনে মিশু বললো, কোনো জোরাজুরি নেই। তোর যেটা ইচ্ছে খাবি।দারুন একটা খাওয়া দাওয়া হলো। রান্নার জবাব নেই। শাহি বলেই বসে, দিবা যে এতো ভালো রান্না করে তা কোনোদিন জানা হতো না এখানে না এলে। মিশু তড়িঘড়ি উঠে গেলো কিচেনে। বাসনগুলো সব ডিশ ওয়াশারে রাখার কাজটা সে করে। শাহি বললো, আমি কি করবো তাহলে?
-তুমি টেবিল মুছে ফেলো শাহি, দিবা হাসতে হাসতে বলে।
-ভাবছো আমি কোনো কাজ পারি না?
-নিশ্চয় পারো। আমি তো মনে করেছিলাম, বউ কাজ শেখায় নি।
-ঠিক আছে, রাতের রান্না এবং বাসন ডিশ ওয়াসারে দেয়ার দায়িত্ব আমার।

ঘড়ির কাঁটায় বাধা জিবন। সকালে মিশু চলে গেলো কাজে। বলে গেলো, বিকেলে এসে পার্কে যাবে। মারিয়াকে স্কুলে নিয়ে গেলো দিবা। মা মেয়ের জন্য একটা গাড়ি। দিবাই চালায় সেটা। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে কিছু সবজি আর ফল কিনে আনলো দিবা। আবার যাবে ওকে আনতে বারোটার সময়। মাঝখানের সময়টাতে সারা দিনের রান্না বান্না সেরে ফেলে।

দিবার লাইব্রেরি দেখতে চাইলো শাহি। দিবা ভারি খুশি তাতে। নিয়ে গেলো দেখাতে। দেশি বিদেশি বইয়ের বেশ ভালো সমাহার। শাহি বললো, আতিক রাহিমির বইও আছে দেখছি।
-পড়েছো তুমি?
-এইবার পড়লাম চাচার বাসায়। চাচাও খুব পড়ুয়া।
-খালেদ হোসাইনির বই পড়েছো?
-পড়েছি।
-তিনটেই?
-না শধু ‘কাইট রানার’। অসাধারন লেগেছে। অসাধারন সুন্দর ভাশা।
-দুটো জায়গায় আমি আমাদের দেশের একটা উপন্যাসের সাথে মিল পেয়েছি।
-কি নাম উপন্যাসের?
-অয়নাংশ।
-কোথায় কোথায় মিল পেলে?
-দেশের বর্ডার পার হওয়ার সময় যখন নায়কের বাবা এক মুঠি দেশের মাটি ভরে নেয় নস্যির কৌটোয়, আর নায়ক যখন ঘুড়িটা ধরার জন্য সামনে দৌড়োয়। অয়নাংশের নায়িকাও মুক্তি যুদ্ধের সময় দেশ থেকে ওপার বাঙলায় যাওয়ার সময় নদির ধার থেকে এক মুঠি বালি তুলে নিয়েছিলো। আর শেষে নায়িকা বলছে, আরো অনেক পথ বাকি। চলতে হবে তাকে সামনে।
-কি আশ্চর্য, কাঁদছো কেনো দিবা?
-অয়নাংশ পড়লে তুমিও কাঁদবে নায়িকার গলা ধরে।
-এবার দেশে গিয়ে অবশ্যই পড়বো বইটা। কথা দিলাম।
-তোমরা তো আবার মেয়েদের লেখা পড়ো না।
-উমম, কথাটা একেবারে বেঠিক না। তবে অয়নাংশ আমি পড়বো। কোথাকার খালিদ হোসাইনি আর কোথাকার এক লেখিকা? দুটো মানুশের দর্শন এক হলো কি করে, সেটাই ভাবছি আর অবাক হচ্ছি।
-অবাক হওয়ার কিছু নেই। কথাই আছে, গ্রেট মেন থিঙ্ক এলাইক। আর জানো তো, চার খন্ডের সাগা উপন্যাস এটাই প্রথম দেশে। এর প্রথম খন্ড অনুদিত হয়েছে ইংরেজি ভাশায়। করেছেন ডক্টর বেলা দত্ত গুপ্ত। অন্যদিকে প্রথম আর দিতিয় খন্ড মারাঠিতে অনুবাদ করেছেন পুনের ডক্টর অপর্না ঝা। ওখানেই প্রকাশিত হয়েছে দুই খন্ড একসাথে।।

-এতো খবর জানো কি করে?
-আমি চিনি লেখককে। আমার প্রিয় লেখক একজন। এদিকে এসো, দেখো ঐ লেখকের আরও কতো বই আমার সংগ্রহে আছে।নিজের পায়ের সাথে পা লেগে হোঁচট খায় দিবা। পড়েই যেতো যদি না শাহি ধরে ফেলতো।
নিজেকে ছাড়িয়ে না নিয়ে দিবা জড়িয়ে ধরে শাহিকে। বলে, মিশুকে গ্রহন করে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি আমি শাহি।-তুমি জানতে যে আমি----জানতাম। কতো যে মনে হয়েছে তোমার কথা।
-আমারও মনে পড়েছে তোমার কথা। কিন্তু দুজনের পথ দুদিকে চলে গিয়েছে। কিছু করার ছিলো না দিবা। আজ আর নাই বা মনে করলাম সেই সব দিনের কথা।
আস্তে করে দিবা ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। বলে, তুমি কি আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলে?
-কি বলছো দিবা? তোমার ভালো চেয়েছি সব সময়।
-আমি মা হতে পারলাম না শাহি। নিশ্চয় কোনো পাপ ছিলো আমার।
-একবিংশ শতাব্দিতে এমন কথা শুনলে লোকে হাসবে ডিয়ার। তা ছাড়া তোমার তো কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা মিশুর।
-বয়স আরো কিছু কম থাকলে আমি তোমার কাছে একটা সন্তান চাইতাম শাহি।

কড়াত করে বাজ পড়লো বুঝি। আগুন ধরে যাওয়ার কথা পুরুষের রিপুতে। কিন্তু আজন্মের সংস্কার, বউয়ের প্রতি সততা, ধর্মবোধের ন্যায়পরতা সজল মেঘের মতো নেমে এলো শাহির ওপরে। ঢেকে দিলো আগুনের শিখা। একটু সামলে নিয়ে বলে, কি বলছো পাগলের মতো দিবা? মানে বুঝে বলছো তো?
-এরকম ঘটনা দেখেছি বলেই বলছি। খুব ঠান্ডা গলায় বলে দিবা।
কিছুক্ষন নিস্তব্ধ হয়ে থাকে দুজনেই।

শাহির মনে হলো, নির্ঘাত দিবার মানসিক সমস্যা হয়েছে। হঠাত করে এমন বেলাইনে কথা বলার মেয়ে সে নয়। দির্ঘ দিন মা না হতে পারার ব্যার্থতা, তাও আবার নিজের কারনে নয়, এই কশট চেপে রাখতে রাখতে কোথায় যেনো ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। মনের অগোচরেই লালন করেছে এমন কথা। নাহলে এই কথা কেউ বলতে পারে হুট করে? মায়া হলো ওর জন্য। আহা, বেচারা! মায়া হলো মিশুর জন্যও।
নিস্তব্ধতা ভাঙে শাহি। বলে চলো চা খাওয়া যাক।

পরদিন আবার লাইব্রেরি দেখতে গেলো তারা দুপুরে। আজ সম্পুর্ন সাভাবিক দিবা। কাল যে অমন একটা কথা বলেছিলো, সেটা যেনো ছিলো অন্য কেউ।
-এই যে শাহি, এখানে কিছু বই আছে দেখো। হাইনরিশ বোয়েল-এর বই যা তিনি নিজেই ইংরেজিতে লেখেছেন।
-নামটা অচেনা দিবা। জার্মান লেখক বুঝি?
-হ্যাঁ, অনেক আগে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। গুন্টার গ্রাসের অনেক আগে।
-গুন্টার গ্রাসের নাম জানি। তবে বই পড়িনি।
-পারলে ‘টিন ড্রাম’ নভেলটা পড়ো। অনেক বড়ো বই।
-সে কি কড়ি দিয়ে কিনলাম, দড়ি দিয়ে বাঁধলাম, কুলি দিয়ে আনলাম-এর মতো বড়ো?
হাসে দুজনেই।

আমরা কিন্তু খালিদ হোসাইনির কথা বলছিলাম কাল, তাই না? খালিদ হোসাইনি ইংরেজিতেই লেখেন। কিন্তু আতিক রাহিমি লেখেন ফরাসি ভাষায়। তবে আমি অনুবাদককে বিপুল ধন্যবাদ দিই। চমতকার অনুবাদ। মনে হবে, ইংরেজিতেইই লেখা বইটা। 

শেশ হলো হামসফর। পরিপুর্ন আনন্দ নিয়ে শেশ হতে পারতো ভ্রমনটা। কিন্তু তা হলো না। দিবার চিকিতসা দরকার, এই কথাটা মিশুকে বলতেও পারলোনা শাহি। অন্য দিকে এমন কিছু উন্মোচিত হলো, যা নাহলেই বোধ হয় ভালো হতো। সব সত্য সুন্দর নয়। শুভ নয়।

তবুও তার কোনো প্রিয় নারী দীর্ঘদিন ধরে ভালোবেসেছে, এমন কি তার সন্তান ধারন করতে চেয়েছে, এই অদ্ভুত একটা রিন রিনে অনুভব তাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো অনেক দিন। শাহি তো ভাবতেও পারে নি যে দিবা তাকে মনে মনে ভালোবাসতো। কথাটা কাউকে সে বলতেও পারবে না কোনোদিন। এই আনন্দ, এই ব্যাথা, এই সুখবোধ একান্তই তার একার। আজীবন এই সত্যকে রেখে দিতে হবে পরম যত্নে ঢেকে, সবার অগোচরে। নিজের মনও যেনো জানতে না পারে তার খবর যখন তখন।



ড. বেগম জাহান আরা
সাবেক প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সক্রিয় ভাষাবিজ্ঞানী এবং কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top