মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাস্তবতা (১ম পর্ব) : আহমেদ জহুর
প্রকাশিত:
৩ জানুয়ারী ২০২০ ১১:৪২
আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৩:৪২

মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা মুক্তি সংগ্রাম যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, ১৯৭১ সালে ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। যা বাংলাদেশীদের জন্য ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠ অর্জন। তাই গর্বভরে আমরা তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা বর্ণনা করে থাকি। আমরা নব প্রজন্মকে শোনায় লাখো লাখো মানুষের প্রাণ ও সম্ভ্রমহানির কথা। কিন্তু কেন আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে হয়েছিল তার যথার্থ কারণ নবীন প্রজন্মের অনেকেরই অজানা। বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধ যে পাক শাসকদের অন্যায় অত্যাচার ও শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটা সোচ্চার ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ ছিল তা সবাইকে স্বীকার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবারই চেতনা। এ ক্ষেত্রে অন্যায়ের ধরন ও ব্যাপকতা কেমন ছিল এবং ধীরে ধীরে কিভাবে তা পুঞ্জিভূত হয়েছিল, সেটা তরুণ প্রজন্মের জানা খুবই দরকার।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এই বাংলাদেশেরই জনগণ পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। ১৮৯৭ সালে ভারতে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হবার কয়েক বছর পরে মুসলিম লীগের পতন ঘটেছিল এই ঢাকাতেই। বাংলাদেশের বরিশালের কৃতি সন্তান শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, যা পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল দিক নির্দেশক ছিল। চল্লিশের দশকে আমাদের এই ভূখণ্ডে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তার বোন মিসেস ফাতেমা জিন্নাহ তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের তথা এই বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে সার্বিক সহায়তা ও সমর্থন পেয়েছিলেন। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যে জনসাধারণ এক সময় পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম করেছিলেন, তারাই কেন আবার পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে জীবনবাজি রাখলেন? এ প্রশ্নের সদুত্তর তরুণ প্রজন্মকে জানতে হবে। বিষয়টি সংক্ষেপে বলতে গেলেও কিছু ঘটনা সহজেই সামনে এসে পড়ে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারত (ইন্ডিয়া) ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটে। আমরা ছিলাম তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আমাদের দাবী ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা হোক বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হোক উর্দু। তবে উভয় অঞ্চলের মধ্যে সংযোগের স্বার্থে ব্যবহৃত হবে ইংরেজি। আমরা তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের এই যুক্তিসংগত দাবী মানা হল না। ফলে ১৯৪৮ সালেই শুরু হল ভাষার জন্য আন্দোলন। ১৯৫২ সালে সংঘটিত চূড়ান্ত আন্দোলনে শহীদ হলেন সালাম, বরকত, রফিকসহ অনেকে। শেষ পর্যন্ত আমাদের ন্যায্য দাবীর কাছে পাকিস্তান সরকার মাথা নোয়াতে বাধ্য হলো। কিন্তু ইতিমধ্যে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ ও বিরক্তির সঞ্চার হলো পাকিস্তান শাসকদের ওপর।
ক্ষোভের আরেকটি কারণ ছিল এই যে, তৎকালিন পাকিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রার একটি সিংহভাগ অর্জিত হতো আমাদের সোনালী আঁশ পাট রফতানির মাধ্যমে। তখনকার সময়ে প্রায় দুইশো কোটি টাকা রোজগার হতো পাট বিক্রয়ের মাধ্যমে। কিন্তু অর্জিত অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে তেমন ব্যয় করা হতো না। ক্ষোভের আরো কারণ হলো যে, কেন্দ্রীয় সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীতে আমাদের অংশগ্রহণ জনসংখ্যার বিচারে নগণ্যই ছিল। অথচ আমরাই ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই ই বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। ষাটের দশকেই দাবি উত্থাপিত হলো ৬ দফার, যা ছিল মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই আমাদের জন্য স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। কিন্তু এই দাবির প্রতি পাকিস্তান সরকার কোনরকম সহানুভূতি না দেখিয়ে শুরু করলো নির্যাতন নিপীড়ন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পরে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন, তিনি এই আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেৃত্ব দেন। ষাটের দশকের শেষার্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হলো এবং ১৯৬৯ সালে কারামুক্তির পর তিনি অধিকতর জনপ্রিয়তা পেলেন। দাবী উঠল গণতন্ত্র ও নির্বাচনের। তৎকালিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেষ পর্যন্ত নির্বাচন দিলেন। নির্বাচনের কিছুদিন আগে তথা ১৯৭০ সালের ১০ নভেম্বর এদেশে ঘটে এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সাইক্লোনে প্রায় ১০ লাখ লোকের প্রাণহানী ঘটলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সেই সময়ে চীন সফরে গেলেন। অথচ সাইক্লোনে বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তানকে একবার দেখতেও আসলেন না। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের মনে নতুন করে ক্ষোভের সৃষ্টি হলো।
১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন দিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং শেখ মুজিব পাকিস্তানের শাসক ও মিলিটারী চক্র নানাভাবে প্রত্যাখ্যান করে। এতে প্ররোচনা যোগায় জুলফিকার আলী ভুট্টো। পরের বছর ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে এদেশের জনগণকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। শুরু হয় এক সর্বাত্মক স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ সময়ে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব ও তার সহকর্মীদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে এবং রাতের আধারে তারা পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও সৈন্য মজুত করতে থাকেন। ২৫ মার্চের াতে সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে এদেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর। এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ জনগণ ইপিআর বর্তমানে বিজিবি ও সামরিক বাহিনীর বীর বাঙালী সন্তানেরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতির নিদারুন ক্রান্তিলগ্নে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা দিশেহারা মানুষের মাঝে নতুন করে সাহস ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। শুরু হয় বলিষ্ঠ মুক্তি সংগ্রাম।
আহমেদ জহুর
কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
বিষয়: আহমেদ জহুর বিশেষ নিবন্ধ নিবন্ধ
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: