মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাস্তবতা (শেষ পর্ব) : আহমেদ জহুর


প্রকাশিত:
১০ জানুয়ারী ২০২০ ১১:৫৩

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৩:৪১

 

যুদ্ধে অখণ্ড পাকিস্তানের দোহাই দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। এই গণহত্যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। লাখলাখ মানুষ ঘরবাড়ি, সহায় সম্পদ ফেলে আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী দেশে। বাঙালী বীর সেনানী, ছাত্র যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। এদিকে কিছু বীরযোদ্ধা দেশের সীমানার মধ্যে থেকে অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। কাদের বাহিনী এর উজ্জ্বল উদাহরণ।

ইতিমধ্যে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় বর্তমান মুজিবনগর একটি অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের সদস্যরা বিভিন্ন দেশে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সপক্ষে জনসমর্থন আদায় করতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লিপ্ত সকলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় এবং ভারতের সহায়তায় আমাদের বীর যোদ্ধার ৯ মাসের এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটায় বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পৃথিবীর পৃষ্ঠে আবির্ভূত হয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পতাকা নিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের কারণ ও ইতিহাস এভাবে দুএক কথায় বা লেখায় শেষ হবার নয়। এ বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শিরোনামে কয়েকটি পুস্তকখণ্ডে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

এ নিয়ে অনেক নাটক, চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও সাহিত্যকর্ম হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তা প্রাধান্য দেয়া হলেও কেন হয়েছে তা প্রায় অতলে স্থান পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের অভিপ্রায়ই এর জন্য দায়ী। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। তিনি যখন (১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন তখন এদেশের মানুষ তাকে বিপুল উৎসাহে বরণ করেন। কিন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের শাসক হয়ে যখন তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন, তখন জনমন থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন।

স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচিত সরকার বিভ্রান্ত হয়ে দেশে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করলে এবং গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হলে দেশে চরম হতাশা ও বিশৃংখলার সৃষ্টি হয় এবং জনমনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সেই ক্ষোভ প্রশমিত হয় স্বাধীনতার ঘোষক ও সেক্টর কামন্ডার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রবর্তনের ফলে। এ সময়ে সদ্য স্বাধীন জাতি নব পরিচয়ে জাগরিত হতে থাকে। কিন্তু দেশীয় ও বিদেশীয় ষড়যন্ত্রের ফলে এ জাগরণ স্থিমিত হয়ে যায় স্বল্প সময়ের ব্যবধানে।

এক সময় সংগ্রামপ্রবণ জাতি জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশে সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার প্লাটফর্ম তৈরি করে। কিন্তু অতিশয় পীড়াদায়ক হলেও সত্য যে, আমাদরে অদূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বচ্ছ ও কণ্টকবিহীন প্লাটফর্ম অর্জন করেও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক সুশাসনে আজো সফলতা অর্জন করতে পারেননি। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এসে তাই আমাদেরকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের দাপট এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে জাতিকে নানাভাবে বিভাজনের প্রচেষ্টা।
অথচ স্বাধীন দেশে ধর্ম বর্ণ গোত্রের বাছ বিচার এবং বিভক্ত জাতির হিংসা বিদ্বেষ আমাদের প্রত্যাশিত ছিল না।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশকে জাতীয় ঐক্যর ভিত্তিতে উন্নয়নের শিখরে নেওয়ার দায়িত্বতো রাজনীতিবিদদেরই এ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা সম্ভব হলে এই নলেজ ইকোনমির যুগে জ্ঞান বিজ্ঞানে আমাদের আরো অগ্রগতি সাধিত হতো। নতুন ও উদীয়মান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা এতটা পিছিয়ে পড়তাম না। সমাজে এতো বিভক্তি সৃষ্টি হতো না। ম্যানুফ্যাকচারিং কান্ট্রি না হয়ে আমরা ইনডেন্টিং কান্ট্রিতে পরিণত হতাম না। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও নন্দনচর্চার ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হতাম। নানা কারণ ও উদ্যোগে ভিক্ষুক জাতির গ্লানি কিছুটা দূর হলেও হিংসা বিদ্বেষ ও কলহপ্রবণ জাতির কলঙ্ক থেকে আজো আমরা রেহাই পাইনি। এর থেকে আমাদের পরিত্রাণ হওয়া খুবই জরুরী।

বস্তুত, ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে ব্যবসায়িক ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের ফলে দেশে বাহ্যিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও মৌলিক উন্নয়ন তথা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের উন্নয়নে কাক্সিক্ষত গতি সঞ্চারিত হতে পারেনি। আমরা এখনো মত্ত বিভিন্ন অতীত বিতর্কে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে এসব হীন বিতর্ক থেকে বেরিয়ে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে দেশকে দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও দুর্নীতিমুক্ত, করা একান্ত প্রয়োজন্ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কে সরকারে আছেন আর কে বিরোধী দলে আছেন, তা বিবেচ্য বিষয় নয়।

একটি স্বাধীন উদীয়মান জাতির জন্য কোন কাজটা আগে এবং কোনটা পরে করতে হবে সে ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে অবশ্যই সংলাপ ও ঐক্যমত্যের প্রয়োজন এবং এ ব্যাপারে মত পার্থক্যের কোন অবকাশ থাকতে পারে না। আমাদের ভুললে চলবে না যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য, যে রাষ্ট্রে মানুষ দারিদ্র্য, অশিক্ষা, শোষণ বঞ্ছনা, নির্যাতন নিপীড়ন ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশে শিক্ষার আলোকিত হয়ে একটি মর্যাদাশীল জীবনযাপনে সক্ষম হবে। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে এখনো আমাদের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। আর এই দুরূহ পথ পাড়ি দেওয়া তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা সকল মত পথ ও হিংসা বিদ্বেষ ভুলে সবাইকে নিয়ে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে সাথে নিয়ে আমাদের সকল নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি সুন্দর, বলিষ্ঠ ও মর্যাদাশীল জাতি গঠনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারবো।

এ কাজে ব্যর্থ হলে ধর্মীয়, ভাষাগত, রাষ্ট্রীয় ও জাতিগত যত পরিচয়ই থাকুক না কেন, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। মহান স্রষ্টা যেন একটি সুন্দর ও অর্থবহ জাতি গঠনে আমাদেরকে সকলকে একত্রিত করেন এবং আমাদের কুলুষিত মন মানসিকতাকে পবিত্র ও সঠিক পথে পরিচালনা করেন এটাই হোক আমাদের ৪৪তম বিজয় দিবসের ভাবনা ও প্রার্থনা।

 

আহমেদ জহুর
কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top