সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

প্রবন্ধ - আমাদের ভাষা এবং ভাষার জন্য আমরা : আফরোজা অদিতি


প্রকাশিত:
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১২:১২

আপডেট:
১৪ এপ্রিল ২০২০ ০১:১৮

 

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দোলার পরাজয় ঘটে এবং আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হয়। তবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মীরজাফর যে ষড়যন্ত্র করেছিল তা বেশিদিন রক্ষা পায়নি। ব্রিটিশ রাজশক্তি খুব দ্রুততার সঙ্গে কোম্পানি বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। এক কথায় বলা যায় তখন থেকেই ব্রিটিশ রাজশক্তি তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁদের রাজত্ব কায়েম করেছিল। দক্ষিণ এশিয়ার যে অঞ্চলটিতে এখন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান নামে তিনটি পৃথক রাষ্ট্র রয়েছে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল; সেসময় তার নাম ছিল বৃটিশ ভারত।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজশক্তি, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ঐক্যমতে দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়; ভাগ হওয়ার পূর্বে পাকিস্তানের দাবী ছিল বেঙ্গল ও আসাম এই দুটি প্রদেশই পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত থাকবে কিন্তু হলো উল্টো; বাংলাদেশ ও পাঞ্জাবকে বিভক্ত করে একটি অংশ ভারত ও অন্য অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এই বিভক্তিতেই যে অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয় তার নাম হয় পূর্বপাকিস্তান। অবশ্য ১৯৪৭ এর ৭ জুলাই বৃহত্তর সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং ৫৫,৫৭৮ ভোটের ব্যবধানে সিলেট পাকিস্তানে থাকার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় অথচ সেসময় গণভোটের রায় না মেনে সিলেটের তিন চতুর্থাংশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। এই তিন চতুর্থাংশের মধ্যে হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ,এবং শিলচর ভারতের অন্তর্ভূক্ত হয়। দেশ ভাগের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের সংখ্য বৃদ্ধি ও সাহিত্য-সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। এবং আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে গড়ে ওঠে বাঙালি জনপদ। এর প্রভাব শুধু পূর্বপাকিস্তানেই নয় এর প্রভাব পড়ে আসামের সমাজ ও রাজনীতিতে। আসামের শিলচরে বাংলাভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয় এবং নয়জন শহীদ হন। এই আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ এর পরে ১৯৬১ সালে এবং শহীদ হন নয়জন তরুণ-তরুণী।

যাহোক, ১৯৪৭ আগস্ট মাসে ‘এপারে আমি আর ওপারে তুমি’ করে সৃষ্টি হলো একটি দেশের দুটি অংশ পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তান চলছিল ব্রিটিশ সংবিধান অনুযায়ী; ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান অনুসারে বর্তমান বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্বপাকিস্তান। প্রায় হাজার কিলোমিটার অধিক দূরত্বে অবস্থিত এই দুটি প্রদেশের সাংস্কৃতিক, ভোগৌলিক পার্থক্য তো ছিলই ভাষাগত পার্থক্যও ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা উর্দু এবং পূর্বপাকিস্তান (পূর্ব বাংলা)-এর ভাষা ছিল বাংলা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যে মনিঅর্ডার ফর্ম, ডাকটিকেট ও মুদ্রা চালু করা হয় তাতে শুধু ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহর করা হয়। এগুলি থেকে বাংলা বাদ দেওয়ার ফলে পূর্বপাকিস্তানের জনসাধারণ ও শিক্ষিত মহলে উদ্বেগ ও ক্ষোভের জন্ম নেয়। ঠিক সেই সময় পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ঢাকাতে আসেন এবং তিনিই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রধান মুখপাত্র। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী ঢাকায় আসার কিছুদিন পূর্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজন সদস্য ফজলুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনাকালে শিক্ষামন্ত্রী বলেন এটি ভুলবশত হয়েছে এবং ভুলসংশোধনের আশ্বাস দেন।

এই সময় ভাষার প্রশ্নে বিভিন্ন জেলার ছাত্র ও যুব সমাজ সোচ্চার হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে বাংলা ভাষার আন্দোলন ছাত্র ও শিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও শিক্ষিত নারী এবং ছাত্রীরাও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে ভাষা সম্পর্কিত সরকারি নীতির সমালোচনা করেন। এবং তাঁরা মিটিং-মিছিলে যোগ দেন। এরপর পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে সংসদসদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু এবং ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। গণপরিষদে বাংলাভাষা বিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকার ছাত্রসমাজ ধর্মঘট পালন করে। এবং ভাষা আন্দোলনকে একটি সুষ্ঠু সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার জন্য ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সর্বদলীয় পরিষদ গঠিত হয়। আন্দোলন চলতে থাকে। সরকারি জুলুম চলতে থাকে। জুলুমের প্রতিবাদে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করার লক্ষ্যে দলমত নির্বিশেষে ছাত্র-ছাত্রীরা সভা ও ধর্মঘটে অংশ নেয়। অনেকে আহত হয়, অনেকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। আন্দেলন চলতে থাকে।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও পাকিস্তান মুসলিম লেিগর সভাপতি কায়েদে আজম মহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকা আসেন। তিনি ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরে পৌঁছান ১৯ মার্চ এবং ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন; তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “...পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু আর কোন ভাষা নয়...।”রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও বলেন, “উদুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।” এই কথার সঙ্গে সঙ্গে হলের ভেতরে ‘না-না-না’ শব্দে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আন্দোলন চলে সরকারি নির্যাতনও চলতে থাকে। ওদিকে ১৯৪৮ সালে যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছিল তা নিষ্ক্রিয় হওয়ার ফলে ১৯৪৯ সাল থেকে প্রতি বছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উদ্যাপিত হলেও ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে অন্য কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রভাষা দিবস উদ্যাপিত হয় এবং ‘বিশাববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ নামে নতুন একটি কমিটি গঠিত হয়।

১৯৫১ সালে অক্টোবরে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিণ্ডিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দীন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে পূর্বপাকিস্তানে আসেন এবং পল্টন ময়দানের জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ্-এর বক্তৃতার অংশবিশেষ উল্লেখ করে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একটি হবে এবং তা হবে উর্দু।’ এই বক্তৃতার পরই ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ দেওয়ালে পোস্টারিং করে এবং ধর্মঘট আহ্বান করে। ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমাবেত হয়ে জনসভা করে। উক্ত জনসভায় নাজিমুদ্দিন-এর সঙ্গে ১৯৪৮ সালে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তার বাস্তবায়নের দাবী জানায়। এবং এই ৩০ জানুয়ারি সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়। সভা শেষে প্রায় এক মাইল দীর্ঘ একটি মিছিল বের করে এবং “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “আরবী হরফে বাংলা চলবে না” “নাজিমুদ্দিন গদী ছাড়ো” ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে শহরের প্রধান প্রধান রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এরপর ৩১ জানুয়ারি ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। এবং
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’কে এই কমিটির অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা এবং ৪ ফেব্রুয়ারি যে ধর্মঘটের আহ্বানের প্রতিও সমর্থন করে।

৪ ফেব্রুয়ারির সভাতে ২১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে রাষ্টভাষা বাংলার দাবীতে সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কারণ ২০ ফেব্রুয়ারি পরিষদের পবর্তী অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ঘোষিত হয়েছিল। সভা শেষে মিছিল বের হওয়ার বিষয়ে মতভেদ দেখা দিলেও পরবর্তীতে প্রায় পাঁচহাজার ছাত্রছাত্রীর একটি বিশাল মিছিল বের হয়। স্লোগানে স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকাতে ৩০ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ১৪৪ ধারা জারি করার ফলে শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তর্ক-বিতর্কের পর ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করা হয়। দশজন করে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে এবং পুলিশ ও ছাত্রদের মধ্যে ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ির এক পর্যায়ে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং গুলিবর্ষণ করে। রফিকুর রহমান নামে এক ছাত্রের মাথায় গুলি লাগে। আবুল বরকতের উরুতে গুলি লাগে প্রচুর রক্তক্ষরণে মারা যান। ২১ ফেব্রুয়ারিতে আহতদের মধ্যে ১ জন মারা যান, বাঁকি ছাত্ররা চিকিৎসার পর ছাড়া পেয়ে যান।

২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়; একটি বিরাট মিছিল হাইকোর্টের দিক থেকে আসতে দেখা যায়। সেই মিছিল ছিল সেক্রেটারিয়েট এবং এজিবি অফিসের কর্মচারীবৃন্দ নিয়ে গঠিত। গায়েবি জানাজাতে যে ছাত্ররা মারা যান তাঁদের মাতৃভাষা রক্ষার্থে শহীদ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির পরে দেশের মানুষ স্বতস্ফ’র্তভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়। ২২ ফেব্রুয়ারি মিছলে সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা বাধা দিলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় মিছিলে গুলি করা হয় এবং সেই গুলিবর্ষণে আট বছরের এক বালকসহ নিত হন পাঁচজন। গুলিবর্ষণের কথা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে গ্রাম থেকে মফস্বল থেকে দলে দলে জনতা এসে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেল ওয়ার্কশপের শ্রমিক ও রেল কর্মচারিরা ধর্মঘট পালন করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পাকিস্তান সংবিধান সভার কাছে সুপারিশ করে সরকারিভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়।

সরকাভিাবে মাত্র ৮ জনের কথা ঘোষিত হলেও নিহতের সংখ্যা আরো বেশি ছিল। ২৫ তারিখে যেখানে কত ও অন্য দুইজন ছাত্র নিহত হয়েছিল সেখানে মিনার নির্মান করে শহদিস্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এবং সেখানে সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে অর্থ জমা দেন। মেয়েরা তাদের গহনা পর্যন্ত জমা দেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঐ মিনার ভেঙে ফেলা হয়। ছাত্রছাত্রীদের গ্রেফতার করা হয়। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর সুফল মিলেছিল ১৯৫৪ সালে সালের ১৯ এপ্রিল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে; অনেক তাল-বাহানার পর পাকিস্তান সরকার একরকম বাধ্য হয়েই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছিল।

বাঙালি পেয়েছিল তাদের প্রিয় বাংলাভাষা। বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলা। বাংলায় কথা বলে, বাংলায় চিঠি লিখে যতোটা আনন্দ বাঙালি হিসেবে পাওয়া যায় ততোটা আনন্দ অন্য কোন ভাষাতে পেতে পারে না বাঙালি। বাংলাদেশ আমার দেশ। বাংলাতেই প্রথম মা ডেকেছি। বাংলার মা ডাকে যতো মিষ্টতা পাওয়া যায়, অন্য কোন ভাষার মা ডাকে মনে হয় অতোটা মিষ্টতা পাওয়া যায় না। বাংলা ভাষার জন্য যতটা রক্ত ঝরেছিল ততটা রক্ত আর কোন ভাষার জন্য ঝরেনি। বাঙালি বীর ভাষাসৈনিক তাদের বুকের রক্ত দিয়ে বাংলাকে রঙিন করে গেছে। যেমন বসন্ত রঙিন করে পলাশ-কৃষ্ণচূড়া, রঙিন করে প্রকৃতি তেমনি রক্তে-ব্যথায় রঙিন করেছিল ভাষাসৈনিকেরা। ওরা বাংলাকে বসন্তের রঙে রাঙিয়ে দিয়ে গেছেন নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে; ভাষাসৈনিক যেসব নারীরা ছিলেন তাঁদের সংসার-স্বজন ত্যাগের বিনিময়ে রাঙিয়ে আমাদের মুখে দিয়েছেন মাতৃভাষার বুলি, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা। তাই তো ‘আমি আমার আমিকে এই বাংলায় খুঁজে পাই’।

এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আমরা আনতে পেরেছি স্বাধীনতা। আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার আশা। সেই জন্যই তো ‘আমি একবার দেখি, বারবার দেখি এই বাংলার মুখ’। আমার স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার স্বাধীন বাংলা ভাষা। প্রথম বাংলাতেই কথা বলতে শিখেছে বাঙালি। তবুও আমরা পারিনি সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করতে। বাংলাভাষা প্রচলিত আইনে সর্বস্তরে বাংলাভাষা ব্যবহার না করলে শাস্তি ব্যবস্থা আছে তবুও হচ্ছে কী?

বর্তমানে বাংলাভাষা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিন্তু ইদানিং দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাঙালি সন্তানেরা ভালোভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে পারছে না। ভুল উচ্চারণে বিদেশি ঢঙে বিদেশি শব্দ ব্যবহারে বাংলা উচ্চারণ করছে। বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষা শিখবো না, পড়বো না তা নয়। শিখবো, পড়বো, বলবো, লিখবো কিন্তু বাংলায় অন্য ভাষার মিল দিবো না। আমরা ভুলবো না বাংলা। সন্তাদের বিদেশি ভাষা পড়তে দিতে হবে কিন্ত বাংলা ভুলতে দেওয়া যাবে না। আমরা নিজেরাও ভুলবো না আমার প্রিয় বাংলাকে; বাংলা সংস্কৃতির ভান্ডার অপরিসীম। গান কবিতা গল্প জেনে,পড়ে, গেয়ে, শুনে শেষ করা যায় না। আমাদের বাউলগান, ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, ঘেটুগান, লালনগীতি, লোকসংগীত সবই আমাদের প্রিয়। আমাদের অন্তরের অন্তরভূমি। আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমাদের প্রাণের কবি ডি.এল.রায়, অতুলপ্রসাদ, জীবনানন্দ দাস। আমাদের লোককাহিনীর তুলনা হয় না। এখন শুধু এগুলো সংগ্রহের প্রয়োজন। ব্যক্তিপর্যায়ে একাজ করা সম্ভব নয়। তাইতো কোন সংগঠন যদি এ কাজে উদ্যোগী হয় তাহলে বাংলা ভাষা প্রাণে বেঁচে থাকতে পারবে।

সরকারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠন অবশ্য তাদের প্রচারপত্র, স্যুভেনির, গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ নিয়ে সংকলন বের করে বাংলা ভাষাকে বিভিন্ন মহলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় সচেষ্ট। বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্র আরও বাড়ুক এই কামনা করি। আর প্রতিজ্ঞা করি আমরা ভুল উচ্চারণে বাংলা বলব না, বিদেশে শব্দ মিশ্রনে বাংলা বলবো না। আমরা ‘বাংলার হাতে হাত রেখে স্বপ্নে বাংলা দেখি’ - আমরা স্বপ্নেও বাংলা চাই।

 

আফরোজা অদিতি
কবি ও কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top