সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

সম্পর্কের বুনন : ড. বেগম জাহান আরা (১ম পর্ব)


প্রকাশিত:
২৭ মার্চ ২০২০ ০৬:০৭

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:২২

 

কখনও আপন হয় না যে বাড়ি, সেটাই পরের বাড়ি। হতে  পারে তা বাবার বাড়ি বা স্বামীর বাড়ি। হতে পারে তা ছেলে বা মেয়ের বাড়ি। হতে পারে ভাই বোন বা নাতি নাতনি অথবা পৌত্র পৌত্রীর বাড়ি। কিংবা আত্মিয় সজন বা বন্ধুর বাড়ি। আর যে বাড়ি আপন হয় না, সেখান সবটাতেই বেআরাম। হেসে খেলে শুয়ে বসে খেয়ে নেয়ে স্বস্তি লাগে না।

বয়সি মানুষ আসগারি। নব্বইয়ের কাছাকাছি এসে বাস্তবতা বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে, কারও  বাড়ি বেড়াতে যাওয়া ঠিক আছে। গতিকে কারও বাড়ি দুএকদিন থাকা চলে কোনো রকমে। ধান্দায় পড়ে দু চারদিন পরিচিত স্বজনের বাসায় থাকাও অসম্ভব নয় একেবারে। কিন্তু আশ্রিত হয়ে থাকার মতো এলে বা দীর্ঘ দিনের জন্য থাকতে গেলে সম্পর্কের বুননটাই যায় বদলে। তার নিজের জন্য নয় কথাগুলো। বোনটাকে নিয়ে ভাবছে সে। নাতির জন্য মেয়ের বাসায় থাকতে হচ্ছে তাকে এখন।

ছোটো বোন আখতারি আসলেই জনম দুখি। স্বামী মারা গেছে সেই উনসত্তরের গন আন্দোলনে, পাকিস্তানের কালে। মিছিল টিছিলে না গিয়েই বেমক্কা গুলি খেয়ে। ডাক্তার স্বামীর পুকুর ওয়ালা একটা পাকা বাড়ি ছিলো। ছিলো পুকুর ধারে ফলের বাগান। চার মেয়ে, পুকুর বাগান আর সেই বাড়ি রেখে  হাশিম চলে গেলো। জীবন আঁধার হয়ে গিয়েছিলো তার। অনেক কষ্টে একা একাই তাদের মানুষ করেছে আখতারি।

আর কাকে বলবে? বোনকেই বলেছিলো আখতারি কিছু কিছু কথা। সন্তানের সব কথা বলাও যায় না। যা শুনেছে, তার ভিত্তিতেই আসগারি দিশেহারা হয়ে যায়। তা ছাড়া তার মেয়ে নেই বলেই বুঝি বুঝতে পারেনা অনেক কিছু। পেটের মেয়ে কি করে মাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে? সম্ভব কি করে?

মনটা খারাপ আখতারিরও। আবুধাবিতে বসে বসে পুরনো কথা মনে আসে তার। কপালের ফেরে সে আজ নাতি সবুজের জন্য আবুধাবিতে থাকছে। এমন ভাবে  নিজের বাড়ি ছেড়ে থাকেনি কখনও সে। নিজের বাড়ি পুকুর ফলের বাগানের  মায়া তো আছেই। যাকে দেখা শোনার জন্য রেখে এসেছে, সে কি তার মতো করে দেখভাল করবে? অন্যদিকে নাতি সবুজের অসুস্থতা ফেলে যেতেও পারছে না। বয়স হয়েছে। শরীর ভালো থাকে না তার আজকাল। ভালো লাগে না কিছুই।

ছোটো মেয়ে সালমার সাথে নাতিকে নিয়ে তার অদৃশ্য একটা ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে। ঘটনাটা বলার মতো না হলেও কষ্টদায়ক।‘মাদার জেলাসি’ টার্মটা জানে আখতারি। এমএ, বিএ পাশ না করলেও  কলেজে দুই বছর তো  পড়েছে। জীবনের পাঠশালা থেকেও জেনেছে কিছু। কিছুই বলতে পারছে না মেয়েকে। না সান্ত্বনা, না বকা, কোনোটাই না।

সবুজের মুখের দিকে চেয়ে আবার ভুলে যেতে চায় মনের জটিলতা কুটিলতা। ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে চায় পরিস্থিতি। তবু ছন্দ পতন হচ্ছে বার বার। কবে যে মুখোমুখি হয়ে যায় মেয়ের সাথে, সেই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে আখতারি। এক একবার মনেহয়, এর চেয়ে মরনই ভালো ছিলো। মরন হতেও পারতো অনেক আগে ।

মুক্তি যুদ্ধে তাদের সবারই মরে যাওয়ার কথা থাকলেও বেঁচে গেলো ঝুম

বৃষ্টির কারনে। একাত্তরে বর্ষাও হয়েছিলো জবর। মাঠে ঘাটে বাজারে গ্রামে ফসলের খেতে থৈ থৈ পানি আর পানি। পানিকে বড়ো ভয় ছিলো

পাকিস্তানি সৈন্যদের। প্রতিদিন রাজাকারের আক্রমনের কথা শুনলেও দ্বীপের মতো গ্রামের ভেতর আসেনি তারা শেষ পর্যন্ত। বেঁচে আছে বলেই তো জীবনের লম্বা রাস্তা পার হতে হচ্ছে। লম্বা জীবনের এই তো পুরস্কার।

দেশ স্বাধীনের পর বছর দুই মেয়ের বিয়ে দেয় আখতারি। বড়ো মেয়ে বকুলের বড়ো সংসার। সে ভালোই আছে। মেজো মেয়ে পারুলের সংসারে রুগ্ন শাশুড়ি  আর এক দেওর। সন্তানাদি হয় না বলে শিক্ষিত জামাইটা আবার বিয়ে করেছে। কষ্ট পায় আখতারি। কিন্তু মেয়েকে কাছে আনার সামর্থ নেই। আসতেও চায়না মেয়ে।

ছিয়াত্তরে  দুই মেয়েই নিজেদের পছন্দে বিয়ে করলো। ছোটো মেয়ে সালমা চাইলো, মা তার সাথে থাকুক। জামাই ডাক্তার। মেয়ে নার্স। সেজো মেয়ে রেশমা বিয়ে করে চলে গেলো আমেরিকা। সাধারন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা জীবনে এর চেয়ে বেশি  কি আশা করতে পারে? সবাইকে জীবনের বৃত্তে বসিয়ে দিতে পেরেছে,  এতেই আখতারি মহান আল্লাহ-র দরবারে শুকুর গুজারি করে হাজার লাখ বার।

বড়ো বোন আসগারির সাথে আখতারির খুব মিল মহব্বত। দুলাভাই হরিয়ান চিনির মিলে ম্যানেজার। দুই ছেলেই আমেরিকায় স্থায়ী বাস নিয়েছে। পরিযায়ী পাখির মতো আসে যায় দুই পক্ষই। পৌত্র পৌত্রিরা বড়ো হচ্ছে সেখানেই। সেও চায়, ছোটো বোন একা না থেকে তার কাছে এসে থাকুক। আখতারি পছন্দ করে না। একাই থাকতে চায় সে। বোনের বাসার স্বাদ তার ভালো লাগেনি। বলতেও পারেনা সেই কথা কাউকে। এতো যে প্রিয় বোন তাকেও না। জীবনটা এমন কেনো?

স্বামীর বাড়ি তার কাছে সবচেয়ে আপন। ভালো মানুষটা তাকে অধিকার দিয়েছে। সম্মান দিয়েছে। নিখাঁদ ভালোবাসা দিয়েছে। সম্পদ রেখে গেছে। বলে গেছে, নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। বার বার বলতো, আমার অভাবে তোমার যেনো কষ্ট না হয়, তার ব্যাবস্থা করেই রেখেছি। কেনো বলতো কথাটা, সে জানে না। কিন্তু ঘটলো তো তাই।

দিন কেটে গেছে  বহু। দেশে রাজা রানি এলো গেলো, আখতারি নিজের বাড়িতেই আছে। বাড়ি বাগান পুকুর পায়রা খরগোশ নিয়ে সে দিব্যি আছে। মাঝে মাঝে একদিন বা দুদিনের জন্য যায় মেয়ের বাড়ি। বছরে একবার হয়তো বোনের বাড়ি। থাকেনা কোথাও। বাড়ি ছেড়ে কোথাও থাকতে ভালো লাগে না তার। অথচ প্রায় দশমাস হলো স্বামীর ঘর বাড়ি পুকুর পায়রা সব মানুষের হিল্লায় রেখে সে আবুধাবিতে আছে। অসম্ভব মনে হয়।

মেয়েদের সংসার ও বড়ো হয়েছে। ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। নাতি নাতনি হয়েছে তাদের ঘরে। ছোটো খাটো আপদ বিপদ ছাড়া পুরো পরিবারটা ভালোই ছিলো। সেজোটা ছাড়া সবাই দেশেই আছে। দেখা সাক্ষাত হতো। আসা যাওয়া লেনা দেনা দাওয়াত খাওয়া সবই হতো।

হঠাত সালমার স্বামী আবুধাবিতে চাকরি নিয়ে চলে গেলো। একবছর পর গেলো মেয়েও। এই প্রথম খুব একা লাগলো আখতারির। একটাই ছেলে সালমার। তার আবার শরির ভালো থাকে না। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে কোমরে ব্যাথা পায়। সেই ব্যাথা আর যায় না। অনেক চিকিতসা করেছে বাবা। সেতো নিজেও ডাক্তার। আবুধাবিতে চাকরি নেয়ার একটাই উদ্দেশ্য, ছেলেটার উন্নত চিকিতসা  করা। মন খারাপ হলেও আখতারি বুঝেছে বিষয়টা। নাতিটা সুস্থ হয়ে উঠুক, এটাই বড়ো কথা।

এই নাতিটা আবার আখতারির খুব ন্যাওটা। নানুবাড়ির লাগোয়া ছিলো স্কুলটা। বাড়ি যাওয়ার পথে প্রায় নানুর সাথে দেখা করে যেতো সবুজ। বাড়িতে বলে এলে নানুর বাড়ি ভাত খেয়ে বাসায় ফিরতো। উতসব অনুষ্ঠানে নানুকে আসতেই হবে তাদের বাড়ি। বাড়িতে ভালো মন্দ রান্না হলে তার কিছু পাঠাতেই হবে নানুর বাসায়। অসুস্থ হলে নানুকে চাই তার। স্বাভাবিক ভাবেই সবুজের সাথে আখতারি সম্পর্ক হয়ে ওঠে নিবিড়। হাত পা ঝাড়া আখতারির নতুন মায়ার বন্ধন। হরিন শাবকের প্রতি অরন্যচারী সাধকের মায়ার বন্ধনের মতো।

বিষয়টা আনন্দের। কিন্তু নানুর সাথে সবুজের এই  প্রানের সম্পর্কটা ভালো লাগতো না সালমার। সে বলেই ফেলতো, মায়ের চেয়ে নানুর প্রতি সবুজের টান বেশি। এটা কেমন কথা!  পেটে ধরেছে, লালন করেছে, সারাদিন যত্ন আত্তি করছে, তবু মন ভরে না? কতোবার মনে মনে ভেবেছে, সবুজের সাথে তার মায়ার সম্পর্কটা শিথিল করবে। মেয়ের এই রকম অসুয়াসুচক কথা শুনতে ভালো লাগে না তার।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর বিধাতা করেন আর এক। সবুজের ক্রনিক ব্যাথার কারনে স্কুলে এক বছর পড়াই বাদ দিতে হলো। সেই সময় মেয়ের বাসায় যাওয়া আসা বেড়ে গেলো সবুজের কারনেই। সম্পর্ক শিথিল করার বদলে তা হলো আরও নিবিড়। কি বিচার আল্লাহ-র! মানুষ যেটা চায় না, সেটা দিয়েই তিনি মানুষকে আষ্টে  পৃষ্ঠে বেঁধে দেন।

 

ড. বেগম জাহান আরা
সাবেক প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সক্রিয় ভাষাবিজ্ঞানী এবং কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top