সিডনী শনিবার, ৪ঠা মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

সম্পর্কের বুনন : ড. বেগম জাহান আরা (শেষ পর্ব)


প্রকাশিত:
৩ এপ্রিল ২০২০ ০৮:১৫

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:১৩

 

নামাজ সেরে উঠে পড়ে আখতারি। সবুজের জন্য কিছু খাবার রান্না করতে হবে। মেয়ে জামাই দুজনেই কাজে যায়, আসে সন্ধেবেলায়। সবুজকে বাড়িতে রেখে যেতে হয় একা। খুব কষ্ট হতো নাতিটার। কোমরে অপারেশনের প্রতিক্রিয়ায় হাঁটতে অসুবিধে হয়েছে। থেরাপি নিতে হচ্ছে এখনও।একা হাঁটতে কষ্ট হয়। অবস্থা এখন একটু ভালো। তবু তার বাথরুমে যাওয়া আসার সময়
সাহায্য লাগে। ডাক্তার বলেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। সেটাই সান্ত্বনা আখতারির। পরমের দরবারে সেই তার প্রার্থনা দিনরাত। সালমা বাসায় না থাকলে সবুজকে দেখে শুনে রাখতে হয়। সমস্যা এটা নয়। এটা তো প্রয়োজন। কিন্তু সালমার উপস্তিতিতে সবুজ যখন নানুর কাছে নানা কিছু নিয়ে বায়না তোলে, তখন সালমা মনে মনে বিরক্ত হয়। বলেও, আমাকে বলতে পারিস না? সারাদিন নানু নানু করিস এতো বড়ো ছেলে? -তুমি তো সারাদিন বাসায় থাকো না মা। -এখন আছি, এখন বল। -বলেছি তো।
-কি বলেছিস? -বুটের হালুয়া খেতে চেয়েছিলাম। দিলে না তো। -এই সপ্তায় করে দেবো। -গতো সপ্তায় বলেছিলে, দাওনি করে।
-গতো সপ্তায় ডিমের হালুয়া খেয়েছিস না?

-তুমি দিলে না দেখে নানুই করেছিলো। -তো কি হলো? খেলি তো? -বুটের হালুয়া দিলে না বলেই তো ডিমের হালুয়া খেয়েছি।-বেশ করেছিস। এবার খঁই খাঁই বন্ধ কর।
আর চুপ করে থাকতে পারে না আখতারি। বলে, অসুস্থ ছেলেটাকে এমন করে বলিস না সালু। আমি তো বসেই থাকি, করে দেবো বুটের হালুয়া। -তোমার জন্যই সবুজ এমন হ্যাঙলা হয়েছে মা। খাওয়া নিয়ে এমন বায়নাক্কা করতো না আগে। -একটা সন্তান, একটু আল্লাদ আবদার করেই মা। -এতোকাল করেনি তো! তাছাড়া, তুমি না থাকলে এতো বায়না শুনবে কে মা? তোমার না হয় কাজ নেই আমার তো আছে। বিরক্তি ঝরে পড়ে মেয়ের কন্ঠে।

কানে বাজে কথাগুলো আখতারির। ভালো লাগে না শুনতে। কিন্তু কি বলবে? উত্তর তো দেয়াই যায়। পেটের মেয়ের সাথে কথা কাটাকাটি ভালো দেখায় কি? জামাই শুনলেই বা কি বলবে? তাই মৃদু হেসে বলে, তাও তো ঠিক। তো কি আর করা, আমি যে কয়দিন আছি, নানুর হুকুম তামিল করে দেবো। -না মা, ওর একটু ডায়েটও করতে হবে। দেখছো না, মোটা হয়ে যাচ্ছে?

চিটবিট করে ওঠে সবুজ, মোটেও না। হালুয়া খেয়ে কেউ মোটা হয় না। নানু তুমি কালই বুটের হালুয়া বানিয়ে দেবে।

-না, এই সপ্তায় কোনো হালুয়া নেই। সালমা বলে। -নানু বানাবে। তোমার অসুবিধে কি? আখতারি ভালোমানুষি করে বলে, থাক সালু, আমি কালই হালুয়া বানিয়ে দেবো। -না ,দেবে না মা। আমি বলছি, দেবে না। কেমন হুকুমের মতো শোনালো সালমার কথা।

মনটা খারাপ হয়ে যায় আখতারির। হয়েছে কি মেয়েটার? দাদু নানুরা নাতি নাতনিদের একটু বেশি আদর করেই থাকে। কিছু আল্লাদীপনার প্রশ্রয়ও দেয়। এতে ছেলেমেয়েদের খুশি হওয়ারই কথা। বিদ্যুত ঝলকের মতো একটা কথা মনে পড়ে তার। সবুজই একদিন বলেছিলো, নানুবাড়ির কাছের স্কুলটা বদলে দিতে চায় তার মা। আরও বলেছিলো, মায়ের চেয়ে নানুকে বেশি ভালোবাসে বোকা ছেলেরা। আর বোকা ছেলেরা লেখাপড়ার চেয়ে খেলা বেশি ভালোবাসে।
তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছে আখতারি। ভেবেছে, সবুজের খেলা কমাতে চেয়ে এইসব বলেছে সালমা। খেলা অন্ত প্রান ছেলেটার। খেলতে গিয়েই তো এই কান্ড বাধিয়েছে।

কিন্তু বিষয়টা তো হালকা নয়। দুরে দুরে থাকার সময় সম্পর্কের টানাপোড়েন এতোটা বোঝা যায় না। এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে নানুর প্রতি সবুজের বেশি টান সালমার পছন্দ নয়। ব্যাপারটা শুধু জটিল নয়, বেশ কষ্টদায়ক তার জন্য।

ভালোবাসার আবার মাপামাপি আছে না কি? ছোটোদেরকে মায়া মমতা ভালোবাসা দেয়ার মাপক কিছু আছে বলেতো তার জানা নেই। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি আল্লাদ আবদার করে যে যতোটা পারে আদায় করে নেয় বড়োদের কাছ থেকে। এটার একটা মজা আছে। একান্নবর্তী পরিবারে এসব নিয়ে হাসি তামাসাও হয়। একই প্রজন্মের ছেলে মেয়ের মধ্যে হিংসে হিংসিও হয়। কিন্তু নানু নাতিনের মধ্যে টানের কম বেশি নিয়ে মা মেয়ের মধ্যে কালো ছায়া পড়ে, এমনটা কখনও দেখেনি বা শোনেওনি আখতারি।

আসগারির সাথে কথা হয় প্রায় প্রায়। সে জানতে চায়, কবে দেশে ফিরবে আখতারি? কবে নাগাদ উমরা করতে যাবে? সবুজ কেমন আছে? কি কি রান্না করেছে আজ? এই সব কথার উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না আখতারির। তার ইচ্ছে হয় এখনই চলে যেতে। কিন্তু সবুজের কথা ভেবে মন শান্ত রাখে। এমন টগবগে ছেলেটা কেমন বসে বসে থাকে, কষ্টে বুক ফেটে যায় তার। নামাজে বসলে দুই চোখের পানিতে বুক ভেসে যায়। সম্পর্কে ভাটার টান ধরলে সহজে জোয়ার আসে না। মা আর মেয়ের মধ্যে কোথায় যেনো বালিকনা খচ খচ করতে থাকে। আখতারি গুটিয়ে নিতে থাকে নিজেকে। আগে নিজের বুদ্ধিতে রান্না বান্না করতো।এখন সালমাকে জিগ্যেস করে নেয়। স্বাধীন ভাবে কিছু করতে সংকোচ হয় তার। ভালো লাগেনা আর মেয়ের বাড়ি থাকতে। মনেহয়, নিরেট পরের বাড়ি। আরাম নেই মনে।

সবুজ জিদ ধিরেছে গরুর মাংস খাবে না। সে চিকেন সাসলিক খাবে। অগত্যা আখতারি অভেনে করে দেয় সাসলিক। খুব মজা করে খায় সবুজ। দুটো শিক রেখে দেয় মা বাবার জন্য।

ঘটনাকে বড়ো করে তুললো সালমা। তার কথা হলো, গরুর মাঙস রান্না থাকার পরও সাসলিক খেতে হবে কেনো? আখতারিকে কিছু বলতে পারছে না। বকাবকি করছে সবুজকে। -নানুকে কষ্ট দিয়েছিস কেনো সবুজ? -একটুও কষ্ট হয় নি নানুর। তড় বড় করে বলে সবুজ। -নানু চলে গেলে এমন নবাবি পাবি কোথায়? -নানু যাবে কেনো? -চিরকাল থাকবে এখানে তোর জন্য? -তাহলে আমিও যাবো নানুর সাথে। -তুই তো নিমক হারাম, বাপ মা ছেড়ে যেতে চাস নানুর বাড়ি। আখতারি পাশের ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছে মা ছেলের কথা। মনে হচ্ছে, এখানে আর থাকা ঠিক হবে না। মান সম্মান নিয়ে চলে যেতে হবে।

-মাত্র দুটো শিক রেখেছিস কার জন্য? সালমার উচ্চকন্ঠ শোনা যায়। -তোমার আর বাবার জন্য। -তুই খেয়েছিস কয়টা?
-চারটা। -বেশি করে করতে বলিসনি কেনো? তোর বাবাও সাসলিক খেতে ভালোবাসে, জানিস না? -বলেছিলাম। নানু বলেছে, তুমি যদি রাগ করো। গরুর মাংস অনেক আছে রান্না করা। -আমি রাগ করবো ভাবলে তো সাসলিকই করতো না তোর নানু। আর করেছেই যদি, তো জামাইয়ের জন্য কয়েকটা রাখতে হবে না? অসন্তোশ নয় শুধু, কেমন একটা দাপটের ভাব গলার স্বরে।

আর শোনা যায় না। কানে হাত দেয় আখতারি। মেয়ের এই রুপ সে দেখেনি আগে। অসুস্থ ছেলেকে ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়ালেও ভালো লাগে না তার? জামাই পছন্দ করে সাসলিক, সেটা জানা কথা। তা বললেই হয়, একদিন বেশি করে সবার জন্য সাসলিক করা যাবে। ছেলেটার খাওয়া নিয়ে উলটো পালটা কথা বলার দরকার কি? ভালো লাগে না আখতারির।
সত্যি দেশে যাওয়ার জন্য মনে মনে উতলা হয় সে। তিক্ততা আরও বেশি হোক, তা সে চায় না। এই ঠান্ডা যুদ্ধ এমন জিনিশ, যেটা নিয়ে কথাই বলা যায় না। সবই তো বায়বিয়। অনুমান নির্ভর। একদিন বলেই ফেলে আখতারি, সবুজতো বেশ ভালো হয়ে উঠেছে, এবার দেশে যেতে চাই সালমা। -হঠাত দেশে কেনো মা? -অনেক দিন তো হয়ে গেলো। -তো কি হলো? তোমার ঘর নেই সংসার নেই, কি করবে দেশে? -ঘর সংসার নেই মানে কি সালমা? -মানে এই আমাদের মতো ঝামেলা নেই আর কি।

-আমারও ঝামেলা আছে রে মা। ঘর বাড়ি পুকুর পাখি বাগান এসব দেখে রাখতে হবে না? গতোবার আশ্বিন মাসে পুকুরে পোনা ছাড়া হয়নি। এবার না ছাড়লে বড়ো মাছ হবে কি ভাবে? -মাছ বিক্রি করে আর কয় পয়সা পাও মা? -যাই পাই, সেটা আমার নিজের আয়। -আমি দিয়ে দেবো সেই পরিমান টাকা। তুমি এখানেই থাকো আমাদের সাথে। খারাপ লাগে কথাটা আখতারির। টাকার বিনিময়ে মেয়ে তাকে নিজের কাছে রাখতে চাইছে! তার নাকি ঘর বাড়ি সংসার নেই। কি করে বলতে পারলো কথাটা? স্বামীর বাড়ি সহায় সম্পদ সব ফেলে এখানে এসেছে মানে তার সংসার নেই?

আত্মত্যাগের ফল এইটা? যেচে উপকার করতে এলে বুঝি এমনি হয়? কি ভুলটাই করেছে সে! কেমন একটা কর্কশ অসম্মানের ছায়া গায়ের ওপর পড়লো। সেটা প্রকাশ না করে বলে, না রে বাড়ির জন্য মন কেমন করে। বিদেশ ভালো লাগছে না আর। বাড়ি যেতে চাই। -আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে? বিশেশ করে সবুজকে ছেড়ে? -কষ্ট হবে খুব। চোখ ছলছল করে ওঠে আখতারির। -ওকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে যা বানিয়েছো না? ওতো আমাদের কথাই শুনতে চায় না এখন। সারাক্ষন শুধু নানুর গল্প। পৃথিবীতে নানু ছাড়া ওর যেনো আর কেউ নেই। ওই বা থাকবে কেমন করে?
এই সব যে রাগের কথা, তার প্রতি সবুজের টানের দিকে ইঙ্গিত, তা বোঝে আখতারি। সন্তানের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মায়ের এই কাঙালপনা যে এতো করুন এবং কদাকার, তা আগে কোনদিন জানেনি সে। ছেলেকে নিয়ে তার এতো ভয় কেনো?
একবার ভাবে কিছু বলবে না। আবার ভাবে, কিছু একটা বলা দরকার। বেশি গুমোট ভালো না। মুখে হাসি টেনে বলে, এই তো এবার যাবো। আবার কবে দেখা হবে কে জানে? আমিই বা কদিন বাঁচবো? তোমরা সুখি হও এই দোয়া করি।
রাতে সবুজ রায়তা খেতে চাইলো নানুর বানানো নানরুটির সাথে। সালমা বলে, আমি বানিয়ে দিচ্ছি। ফ্রিজে দই খুঁজে পেলো না। ফিরে এসে বলে, মা দই যে নেই, আমাকে বলবেনা? এখন রায়তা বানাই কি দিয়ে? -মনে হয় আমার ফ্রিজে আছে।
-আবার ওই ওশুধের ফ্রিজের মধ্যে খাবার রেখেছো মা? -সেদিন জায়গা ছিলোনা তাই রেখেছিলাম। খোলা হয়নি গ্লাসটা।
হন হন করে গিয়ে সালমা মায়ের ঘরের ছোটো ফ্রিজ থেকে দই নিয়ে আসে। বলে, প্লিজ মা, আর কোনোদিন এই কাজটা করো না।
রায়তা বানানো হলো। রাতে আখতারি কিছুই খেলো না। শুয়ে শুয়েই শুনলো, সবুজ বলছে, ভালো হয়নি রায়তা। বেশি টক লাগছে।
-চিনি দিয়ে সরবত করে খা না। সালমা বলে। -খাবো না রায়তা। তোমরাই খাও। -ঠিক আছে, খেতে হবেনা কিছু। উঠে যা।
ঘুম হলো না সারারাত ভালো করে আখতারির। তবু সকাল হয়। মেয়ের সামনা সামনি পড়তেও হয়। কি রান্না হবে জানতে চাইলো মেয়ের কাছে। -যা হয় কিছু করে নিও মা। -ভেবেছিলাম মাছ রান্না করবো। তো সবুজ বলছে, দুম্বার মাংস রান্না করতে। -তাহলে আমাকে আর কেনো জিগ্যাসা করেছো? -তবু তোমার কাছে জানা দরকার। -এখন তো সবুজ আর তুমি যা করতে চাও, তাই হবে।
-কি বলিস এসব সালমা? তোর সংসার, তোর মতেই চলবে। আমি কদিন? -তুমি তো যাবে চলে, সবুজকে মাটি করে দিয়ে যাবে। -ছি, এসব বলতে নেই রে। এখন স্কুল নেই তাই এটা ওটা খেতে চায়। স্কুল শুরু হলে পড়ার চাপে আবার অন্য রকম হয়ে যাবে।

হঠাত সবুজ এসে পড়ে কথার মধ্যে। বলে, আমাকে হোস্টেলে দিয়ে দাও এবার। বাসায় থাকতে চাই না। -তাই দেবো। তোর বায়নাক্কা আমি মেটাতে পারবো না। আমি তো তোর নানু নই। -নানুকে ভালোবাসলে তোমার সমস্যা কোথায় মা?
-আমার আবার সমস্যা কি? বেয়াদবের মতো কথা বলিস। -আমি বুঝি মা, কিছু তো বড়ো হয়েছি। -কি বুঝিস তুই, বল? পাকা পাকা কথাও শিখে ফেলেছিস এরই মধ্যে? আখতারি ঘরে চলে আসে। খোঁচাগুলো স্পস্ট এবঙ বেদনাদায়ক। মনে মনে ভাবে, আর নয়। নির্ঘাত নয়। নেই কথায় মন কশাকশি, চাপা অসন্তোশ, মা মেয়ের চোখে পানি, খুব খারাপ লাগছে তার। অথচ বলার মতো কোনো কথাও নেই। বুকের ভেতর তবু তোলপাড় করে। হচ্ছে কি এসব, তাও বুঝতে পারে না। এমন জটিল অবস্থা তার জীবনে হয়নি আর।
কাছাকাছি থাকার কারনে সবুজ নানুর একটু ন্যাওটা হয়েছে, তা সত্যি। কিন্তু সেটা খুবই স্বাভাবিক। সালমা এটা নিতে পারছে না কেনো, তাও জানে না আখতারি। তার নানুও তাকে খুব ভালোবাসতো। কই, তার মাকে সেটা নিয়ে অসন্তুষ্ট মনে হয়নি কোনোদিন। মা বরঙ খুশিই হতো। জামাইটা মাটির মানুশ। নইলে অনেক আগেই চলে যেতো আখতারি। আজই সে ঢাকা যাওয়ার কথা বলবে। ফিরতি টিকিট আছেই, শুধু তারিখ নিশ্চিত করা। সবুজের জন্য কষ্ট হবে। সালমার জন্যও হবে। সারাদিন কাজ করে সবুজের যত্ন আত্তি নেয়া পরিশ্রমের ব্যাপার হবে খুব। তা হোক, শান্তি তো পাবে মনে। নষ্ট হবে সবুজের শান্তি। একা একা থাকা এবং কেনা খাবার খাওয়া তার ভালো লাগে না।

তবু দিন কাটবে, যেমন কেটে যাচ্ছিলো। চোখ ফেটে পানি আসে তার। হায়রে, এই তবে ‘মাদার লাসি’? বলার কিছু নেই অথচ রাগ। এপ্রেশিয়েট করতে পারেনা, নিন্দাও করতে পারে না। সম্পর্কের মায়া অস্বীকার করতে পারে না। মেনে নিতেও পারেনা প্রসন্ন মনে। নাতির প্রতি নানুর অপত্য স্নেহকে খারাপ বলতে পারে না, সইতেও পারে না। আখতারির নাতিঅন্ত প্রানকে পরম পাওয়া মনে করা উচিত, বদলে অধিকারের টানাটানি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কি একটা জটিলতা! মেয়েটা এমন কেনো হয়েছে? ছোটোবেলা উলের সোয়েটার বুনতে শিখেছিলো। ডিজাইন শিখতে গিয়ে একটা ঘর যদি পড়ে যেতো, তাহলে নিজে নিজে ঠিক করতে পারতো না আর। বুননটাই বাতিল হতো।

আবার মায়ের সাহায্য নিয়ে ঠিক করতে হতো সবটুকু খুলে। মনে হয় মানুষের সপর্কের বুননেও মাঝে মাঝে ঘর পড়ে যায়। নষ্ট হয়ে যায় বুনন। কিন্তু সেটা খুলে আবার ঠিক করার বুদ্ধি তার নেই। হতবুদ্ধি নারী সে এখন। যাওয়ার দিন আখতারির পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গিয়ে উচ্ছসিত হয়ে কেঁদে ফেলে সালমা। মাথায় হাত রাখে সে। কথা আসেনা মুখে।অসম্মানের সুতোয় সেলাই করা দুই ঠোঁট। কান্নার ঢেউ বন্ধ করে দিয়েছে কন্ঠ। দুচোখে উপচে ওঠা পানি। তাকানোও হলো না সালমার দিকে। বুকের গহীনে শুধু একটাই আশীর্বানী, ভালো থাকো তোমরা সবাই। অভিমানে সবুজ এয়ারপোর্টেই এলো না। সবটুকু মন সবুজের কাছে জমা দিয়ে শুন্য হৃদয়ে ইমিগ্রেশন এলাকায় ঢুকে পড়ে আখতারি।

 

বেগম জাহান আরা
সাবেক প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সক্রিয় ভাষাবিজ্ঞানী এবং কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top