অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসীদের বাবা-মা’দের জন্য নতুন প্যারেন্টস ভিসা


প্রকাশিত:
২৭ মার্চ ২০১৯ ১৪:০৯

আপডেট:
১৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:২৩

অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসীদের বাবা-মা’দের জন্য নতুন প্যারেন্টস ভিসা

বিদেশের মাটিতে জীবনযাত্রায় অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, নিরাপদ জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য থাকে। তারপরও প্রতিটি প্রবাসীর বুকে যেন এক টুকরো শুণ্যস্থান থেকে যায়। প্রতিটি উৎসবে উপলক্ষে, কখনো অবসরে তাদের মনে প্রচন্ড হাহাকার জাগে আপনজনদেরকে একটু কাছে পাওয়ার জন্য। স্মৃতিতে ভেসে আসে পুরনো সময়ের কথা, যখন প্রতিদিন ঘরে ফিরে মা-বাবার সাথে দেখা হতো। তখনকার না বুঝতে পারা সময়টুকুকে অনেক মূল্যবান মনে হয়।



তাই প্রত্যেক অভিবাসী-প্রবাসীর মনেই ইচ্ছা থাকে, যদি বাবা-মাকে এদেশে বেড়াতে আনা যায়! অনেকেই তাদের পিতামাতাকে নিয়ে আসেন, নিজেদের সাথে রাখেন। ঘুরিয়ে দেখান ছবির মতো সাজানো দেশটিকে। সন্তানের সাফল্য দেখে, সুন্দর জীবন দেখে তৃপ্ততায় ভরে উঠে বাবা-মায়ের মনও। নাতি-নাতনীরা যেমন তাদের দাদা-দাদী, নানা-নানীকে কাছে পায়, তাদের চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়ে উঠেন এইসব মানুষেরা তাদের অনুজ বংশধরদের সাথে সময় কাটিয়ে।



যেসব বাংলাদেশী অস্ট্রেলিয়াতে অভিবাসী হিসেবে বাস করেন, এদেশের নাগরিক কিংবা স্থায়ী বাসিন্দা হলে তারা সাধারণত দুই উপায়ে তাদের পিতামাতাকে এদেশে বেড়াতে আনেন। সাধারণত তাদের বাবা-মা’র ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া আসেন, এসব ক্ষেত্রে এদেশে অবস্থানরত তাদের সন্তানরা স্পন্সর হন। ট্যুরিস্ট ভিসার মেয়াদ হলো তিন মাস, ছয় মাস কিংবা বারো মাস। তবে সাধারণত দেখা যায় তা তিন মাসের জন্য দেয়া হয়। ভিসা যে মেয়াদের জন্য মঞ্জুর হয়, তারচেয়ে বেশি সময় থাকতে চাইলে তখন অস্ট্রেলিয়ার বাইরে গিয়ে নতুন করে আবেদন করে আবার ভিসা নিয়ে আসতে হয়। এ ভিসার আবেদন করতে সরকারী ফি ১৪০ ডলার জমা দিতে হয়।



এছাড়াও অনেকে তাদের বাবা-মায়ের জন্য ভিজিটর ভিসা হিসেবে পরিচিত ‘স্পন্সর্ড ফ্যামিলি স্ট্রিমে’ আবেদন করেন। ভিজিটর ভিসার সুবিধা হলো এক্ষেত্রে থাকার মেয়াদ সাধারণত বারো মাসের জন্য অনুমোদিত হয়। এক্ষেত্রেও ভিসার আবেদন খরচ ১৪০ ডলার তবে স্পন্সর হিসেবে থাকা সন্তানদের কাছ থেকে সরকার সিকিউরিটি বন্ড হিসেবে বাড়তি টাকা জামানত রাখতে পারে।



ট্যুরিস্ট ভিসা পাওয়া তুলনামূলক সহজ বলেই অনেকে মনে করেন এবং এমনটি মনে করার যথেষ্ট কারণও আছে। ট্যুরিস্ট ভিসার আবেদনের ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছুটা দ্রুত ফলাফল জানানো হয় কিন্তু ভিজিটর ভিসার ক্ষেত্রে ভিসা প্রসেসিং এর জন্য বেশি সময় নেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ার সরকারী ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ট্যুরিস্ট ভিসার আবেদনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১৮ দিন পর্যন্ত প্রসেসিং সময় নেয়া হয় বলে উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে ভিজিটর ভিসার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গড়পড়তা প্রসেসিং সময় নেয়া হয় ৫৪ দিন। এর সাথে যোগ হয় সিকিউরিটি বন্ডের শর্ত যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা।



সুতরাং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অভিবাসীদের পিতা-মাতারা এদেশে অপেক্ষাকৃত সহজতর ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে আসছেন। সন্তানদের সাথে এবং পরিবারের সাথে অল্প মেয়াদের জন্য পাওয়া মূল্যবান সময়টুকু কাটিয়ে আবার দেশে ফিরে যাচ্ছেন।



উপরোল্লিখিত দুই ক্যাটাগরির ভিসা’র বাইরেও স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ সম্বলিত ভিসাও অস্ট্রেলিয়া দিয়ে থাকে। এজড প্যারেন্ট ভিসা (সাবক্লাস ৮০৪) এবং প্যারেন্ট ভিসা (সাবক্লাস ১০৩) এর আবেদন মঞ্জুর হলে তখন এদেশের নাগরিক কিংবা স্থায়ী বাসিন্দাদের পিতামাতা এদেশে স্থায়ীভাবে আসার সুযোগ পান। সমস্যা হলো এই ক্যাটাগরিতে আবেদনের সরকারী খরচ ৬,১০০ ডলারের বেশি এবং কতদিন পর তার ফলাফল জানা যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এক্ষেত্রে চার/পাঁচ বছর থেকে শুরু করে চল্লিশ বছর পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হতে পারে ভিসা আবেদনের ফলাফল জানার জন্য। অন্যদিকে কারো পিতামাতা এদেশে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ীভাবে থেকে কাজ করতে চাইলে তার জন্য রয়েছে কন্ট্রিবিউটরি এজড প্যারেন্ট ভিসার ব্যবস্থা। এই ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন সাবক্লাসের ভিসার খরচ ত্রিশ হাজারের বেশি থেকে শুরু করে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে হতে পারে, এবং ফলাফল পেতেও অনেক বছর লেগে যায়।



এমনতর সব জটিলতার কারণে এবং অন্যদিকে ট্যুরিস্ট বা ভিজিটর ভিসায় আসলে থাকার স্বল্পমেয়াদের কারণে দীর্ঘদিন থেকেই অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসীরা সরকারের কাছে এ বিষয়ে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ভিসা পদ্ধতির জন্য দাবী-দাওয়া জানিয়ে আসছিলো। এরই ফলশ্রুতিতে অস্ট্রেলিয়া সরকার অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক, স্থায়ী বাসিন্দা এবং নিউজিল্যান্ডের শর্তযুক্ত নাগরিকদের পিতামাতাকে দীর্ঘসময়ের জন্য এদেশে নিয়ে আসার সুযোগ দিয়ে নতুন একটি ভিসার নিয়ম গত ২৮ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে এদেশের সংসদে পাশ করেছে। এটিই বর্তমানে সম্প্রতি অনুমোদিত এবং নতুন চালু হতে যাওয়া প্যারেন্ট ভিসা নামে পরিচিত।



চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে এ ভিসাটি প্রদান করা শুরু হবে। প্রবাসীদের অনেকেই আশা করেন তাদের বাবা-মাকে সবসময়ের জন্য নিজেদের সাথে রাখতে। তাই নতুন এ ভিসার নিয়মকানুন এবং সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে বেশ কৌতুহল দেখা যাচ্ছে। অনেকেই ইতোমেধ্যে পরিকল্পনা করছেন এ ভিসায় তাদের পিতামাতার জন্য ভিসার আবেদন করতে, খোঁজখবর নিচ্ছেন তথ্যের জন্য। নিম্নে প্যারেন্ট ভিসার মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সহজে বুঝার সুবিধার্থে তালিকা আকারে তুলে ধরা হলো।




  • এ ভিসার আবেদন করতে হবে দুই পর্যায়ে। প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসী সন্তানকে আবেদন করতে হবে স্পন্সর হওয়ার জন্য। জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছে ইমিগ্রেশন বিষয়ক মন্ত্রী ইতিমধ্যেই বলেছেন, এই আবেদন গ্রহণ করা শুরু হবে আগামী মাসে ১৭ এপ্রিল ২০১৯ তারিখ থেকে। প্রথম এই আবেদনপত্রের ভিত্তিতে দ্বিতীয় পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়া আসতে ইচ্ছুক পিতা-মাতা ভিসার জন্য আবেদন করবেন। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া সরকারের পরিকল্পনা হলো ১ জুলাই ২০১৯ তারিখ থেকে বিশ্বব্যাপী এই আবেদনপত্র গ্রহণ করা শুরু হবে।

  • তিন বছর মেয়াদের ভিসার খরচ ৫,০০০ ডলার, পাঁচ বছর মেয়াদী ভিসার খরচ ১০,০০০ ডলার এবং সর্বোচ্চ দশ বছর মেয়াদী ভিসার খরচ ২০,০০০ ডলার।

  • এ ভিসায় আগত পিতা-মাতারা অস্ট্রেলিয়ায় কোন কাজ করার অনুমোদন পাবেন না। সরকার আশা করছে তারা এসে সন্তানদের পরিবারে থাকার কারণে যখন পরিবারের শিশুরা তাদের সাথে থাকবে তখন এতে করে পরিবারের শিশুদের জন্য চাইল্ডকেয়ার সংস্থাগুলোতে যাওয়ার প্রয়োজন কমে আসবে।

  • এ ভিসায় যারা আসবেন তারা কখনো স্থায়ী নিবাসের সুযোগ বা পার্মানেন্ট রেসিডেন্সির জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবেন না।

  • এ ভিসায় আসার পিতামাতার যে কোন চিকিৎসার জন্য সন্তানদেরকে বেসরকারী হেলথ ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে। এর পাশাপাশি যদি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কোন সরকারী খরচ হয় তাহলে সে খরচ পুরোপুরি পরিশোধের দায়িত্ব সন্তানদের উপর বর্তাবে।

  • প্রতিবছর ১৫,০০০ মানুষকে এভাবে টেম্পোরারি স্পন্সর্ড প্যারেন্ট ভিসা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অস্ট্রেলিয়ান সরকার।



যদিও এইসব নিয়মকানুন ইতোমধ্যেই সরকারীভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং খুব দ্রুতই এ ভিসা সংক্রান্ত কাজকর্ম শুরু হতে যাচ্ছে তথাপি অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসীদের মাঝে এ ভিসা প্রসঙ্গে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ এবং ক্যাম্পেইন সংগঠকরা এ ভিসার শর্তাবলী সহজতর করার জন্য সরকারের সাথে দেনদরবার চালিয়ে যাবেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।



এই নতুন ভিসা পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো ভিসার জন্য মোটা অংকের খরচের বিষয়টি। অনেকের প্রশ্ন হলো ১৭০ ডলার দিয়ে যদি এক বছরের জন্য ভিজিটর ভিসায় বাবা-মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার সুযোগ থাকে তাহলে তিন বছরের জন্য ৫,০০০ ডলার কিংবা দশ বছরের জন্য ২০,০০০ ডলার দেয়ার যৌক্তিকতা কি? এর পাশাপাশি হেলথ ইন্সুরেন্সের খরচ, যদি সরকারী কোন স্বাস্থ্যসেবা নিতে হয় সেক্ষেত্রে বিশাল অংকের খরচ এবং পরবর্তীতে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার কোন সুযোগ না থাকা এসব মিলেই অভিবাসীদের অনেকে নতুন ভিসাপদ্ধতিটিকে পছন্দ করছেন না। পরিবারের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষগুলোকে দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজেদের কাছে রাখার স্বপ্ন দেখলেও বাস্তব কারণেই এ ভিসার ব্যবস্থা করা অনেক মানুষের সামর্থ্যের ভেতরে নেই। 



আবার অন্যদিকে এসব বিষয়গুলো মাথায় রেখেও অনেক অভিবাসী পরিবার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাদের পরিবারের গুরুজনদেরকে দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজেদের কাছে নিয়ে আসার। পাঁচ কিংবা দশ বছরের জন্য যদি পিতা-মাতাকে নিজের সাথে রাখার সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে তার অর্থ হলো সন্তানদের বেড়ে উঠার সময়ে অনেকগুলো বছরের জন্য, দীর্ঘ একটি সময়ের জন্য তাদের সাথে একসাথে বসবাসের সুযোগ পাওয়া। অনেকের জন্যই সুদূর পরবাসে এটি অনেক মূল্যবান একটি সুযোগ।



সিডনির সুপরিচিত অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আরিয়ানা ইমিগ্রেশন পার্টনার্স এর প্রিন্সিপাল মাইগ্রেশন কনসালটেন্ট ড. ফয়সাল আহমেদ নতুন প্রবর্তিত এই প্যারেন্টস ভিসা সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, যারা তাদের বাবা-মা’কে এই প্রবাসের মাটিতে নিজেদের সাথে রাখতে চায় তাদের জন্য নতুন এই ভিসাটি খুবই চমৎকার একটি সুযোগ। ড. ফয়সাল সিডনিতে ইমিগ্রেশন বিষয়ে দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করে আসছেন। তিনি তার বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলেন, তার জানার ভেতরেই প্রচুর মানুষ আছে যারা এ মুহুর্তে আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছে আবেদনপত্র গ্রহণ শুরু হওয়ার দিনটির জন্য। যেহেতু সরকার প্রতি বছরে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় এ ভিসা ইস্যু করবে সুতরাং দেখা যাবে যারা আগে আবেদন করেছে তাদের সব ডকুমেন্টস ঠিক থাকলে তারাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের বাবা-মা’কে পাঁচ বা দশ বছর সময়কালের জন্য নিজেদের কাছে নিয়ে আসতে পারবে। কোন পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই যদি পূর্ণকালীন কাজ করেন তাহলে খরচ এবং অন্যান্য শর্তাবলী মিলিয়ে তাদের জন্য এ ভিসার সুযোগ নেয়া খুবই সহজ বলেও তিনি মতপ্রকাশ করেন।



 



 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top