অভিবাসন ও নাগরিকত্বের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়া সরকার কঠোরতা অবলম্বন করছে
প্রকাশিত:
১৩ জুন ২০১৯ ১৭:১৬
আপডেট:
১৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:২৬

অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসন, স্থায়ী বাসিন্দা এবং নাগরিকত্বের সুযোগ প্রদান বিষয়ে এদেশের সরকার সম্প্রতি বেশ কঠোরতা অবলম্বন করা আরম্ভ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিগত কয়েক মাসের নানা ঘটনাবলীতে এ বিষয়টি সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের নজরে উঠে এসেছে।
এ বছরের শুরুতেই গণমাধ্যমগুলোতে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত লোকের অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি বেশ আলোড়ন তুলে। ডিপার্টমেন্ট অফ হোম এফেয়ার্স প্রতারণার অভিযোগে এই নাগরিকত্ব বাতিল করে। আইনী কারণে তার পুরো নাম গোপন রেখে কেবলমাত্র মিস্টার সিং হিসেবে পত্রপত্রিকায় এ ঘটনার কথা প্রকাশ করা হয়। সেসময় জানানো হয়, হোম এফেয়ার্স মন্ত্রী পিটার ডাটন সরাসরি নিজেই এই নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এডমিনিস্ট্রেটিভ আপিল ট্রাইবুনালের করা পুনর্বিবেচনার আবেদনও খারিজ করে দেয় সরকার।
৩৮ বছর বয়স্ক মিস্টার সিং ১৯৯৭ সালে একজন ছাত্র হিসেবে ভারত থেকে প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। কিছুদিন পর তিনি এখানেই অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণকারী একজন নারীকে বিয়ে করেন এবং স্বামী হিসেবে ভিসার আবেদন করেন। পরবর্তীতে তাদের মাঝে ২০০২ সালে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে সেবছরের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি ভারতে যান এবং এবং সেখানেই ভারতীয় বংশোদ্ভুত আরেকজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিককে বিয়ে করেন।
এ সময় আগের ভিসা ও বিবাহবিচ্ছেদের কারণে নতুন ভিসা পেতে সমস্যা হতে পারে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি অন্য একটি নাম এবং জন্ম তারিখ ব্যবহার করে নতুন আরেকটি ভারতীয় পাসপোর্ট নেন এবং তা দিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীর স্বামী হিসেবে আবার অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। ২০০৫ সালে তিনি এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হন এবং পরবর্তীতে এ নতুন পরিচয়েই ২০০৭ সালে তিনি এদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়ার সময়েই তিনি সরকারের কাছ থেকে তার পূর্ববর্তী পরিচয়ের বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন যা সম্প্রতি ডিপার্টমেন্টের এক ফরেনসিক এনালিসিসে ধরা পড়ে যায়।
এর আগে বিগত বছরের শেষদিকে আরেকজন ভারতীয় নাগরিকের পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি বরখাস্ত করে তাকে ভারতে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছিলো সরকার। সে ঘটনায় ৩৮ বছর বয়স্ক পরমজিৎ সিং এর অপরাধ ছিলো বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে তার জড়িত হওয়া।
পরমজিৎ সিং ১৯৮৮ সালে কিশোর বয়সে তার বাবার সাথে থাকার জন্য অস্ট্রেলিয়া আসে। এরপরে বিভিন্ন শ্রেণীর ভিসায় দশ বছর থাকার পর ১৯৯৮ সালে তিনি এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হন। প্রায় পুরো জীবন এদেশে কাটানোর পরেও সম্প্রতি আদালতের সিদ্ধান্তে তার পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি বাতিল করে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এর কারণ হলো ১৯ বছর বয়স থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তিনি সর্বমোট ৩০ টি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং এর মাঝে ২০১৭ সালে তাকে কারাদন্ডও দেয়া হয়েছে। এসব অপরাধের মাঝে আছে ২০১৫ সালে একজন ফার্মাসিস্ট এবং একজন সিকিউরিটি গার্ডের উপর আক্রমণ করার ঘটনা যখন তিনি এবং তার বান্ধবী ফার্মেসী থেকে বিভিন্ন পণ্য চুরি করতে গিয়ে তাদের কাছে ধরা খেয়েছিলেন। তার অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মাঝে আছে বিভিন্ন সময়ে সহিংসতামূলক আচরণ ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির মতো ঘটনা।
পরমজিৎ সিংয়ের এ ঘটনার কাছাকাছি সময়ে আরেকটি ঘটনাও অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়। এ সময় ডিপার্টমেন্ট অফ হোম এফেয়ার্স বিবাহ-ভিসা জালিয়াতির সাথে সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে ১৬৪ টি পার্টনার ভিসার আবেদনপত্র বাতিল করে। এ সময় ৩২ বছর বয়স্ক জগজিৎ সিংকে আদালতে টাকার বিনিময়ে এ ধরণের জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া বিয়ে সাজিয়ে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি পাওয়ার কর্মকান্ড পরিচালনার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। একই সাথে এতো বিপুল সংখ্যক ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যানের ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না।
সম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, হোম এফেয়ার্স বিষয়ক মন্ত্রী পিটার ডাটনের অধীনে মন্ত্রণালয়টি বিগত অর্থবছরে মাত্র ১৫ শতাংশ নাগরিকত্বের আবেদনপত্র নিয়ে কাজ করেছে। অথচ মন্ত্রণালয়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিলো আবেদনপত্র জমা দেয়ার ৮০ দিন সময়কালের ভেতরে সকল আবেদনপত্রের অন্তত ৮০ শতাংশের কাজ সম্পন্ন করা। এ ধরণের কড়াকড়ির ফলে দেখা গেছে নাগরিকত্বের জন্য একটি আবেদনপত্র জমা দেয়ার পর তার ফলপ্রকাশ করতে ৪২২ দিন লেগে গিয়েছে যা এক বছরেরও বেশি সময়কাল।
নিত্যনতুন আইন এবং নিয়মকানুন প্রবর্তনের পাশাপাশি এসব আইন প্রয়োগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও এ সময়কালে বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকমাস আগেই মেলবোর্নে অভিবাসন সংক্রান্ত অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে ফেডারেল পুলিশ গ্রেফতার করার পাশাপাশি তাদের মালিকানায় থাকা প্রায় চার মিলিয়ন ডলার পরিমাণ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।
অস্ট্রেলিয়ান বর্ডার ফোর্সের একটি ধারাবাহিক তদন্তের অংশ হিসেবে ফেডারেল পুলিশের বিশেষ টাস্কফোর্স অভিযানে বাজেয়াপ্তকৃত এ সম্পত্তির মাঝে রয়েছে একটি বাণিজ্যিক ও তিনটি আবাসিক প্রপার্টি, ২০১৫ সালের একটি মার্সিডিজ এসইউভি গাড়ি, দুইটি ব্যাংক একাউন্টে থাকা ২৩০,০০০ ডলার এবং নগদ প্রায় ৫৮০,০০০ ডলার। এ সময় গ্রেফতারকৃত দুইজন পুরুষ এবং একজন নারীর বিরুদ্ধে মাইগ্রেশন এক্ট ১৯৫৮ এর অধীনে বেআইনীভাবে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান এবং কর্মঅধিকার ছাড়া আইনসঙ্গতভাবে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থানের অভিযোগ আনয়ন করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সিটিজেনশিপ, পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি ও বিদেশী নাগরিকদের কর্মসংস্থানের মতো বিষয়গুলো নিয়ে সরকারী এ সকল নানা কঠোরতার প্রভাব বেসরকারী খাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বর্তমানে বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তি করার আগে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করার বিষয়ে নানা সতর্কতা অবলম্বন করার চেষ্টা আরম্ভ করেছে। এর একটি উদাহরণ হলো প্রবিটাস কোয়াড নামের একটি বেসরকারী পেশাদারী প্রতিষ্ঠানের হাতে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের দায়িত্ব অর্পণ করার ঘটনা।
অস্ট্রেলিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম খাত হলো শিক্ষাখাত। বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় এদেশ প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে থাকে। গত বছরের উপাত্ত থেকে দেখা যায়, এই বিপুল সংখ্যক বিদেশী শিক্ষার্থীদের মাঝে শতকরা ১২ ভাগ ছিলো ভারত থেকে আগত।
বিদেশী শিক্ষার্থীরা যখন অস্ট্রেলিয়ায় পড়ালেখা করতে আসার উদ্দেশ্যে ভিসার আবেদন করে তখন নানা কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এসব প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মাঝে অনেকসময় জাল পাসপোর্ট, জাল ব্যাংক ডকুমেন্টস কিংবা ভুয়া অভিজ্ঞতার কাগজপত্র জমা দেয়া ঝুঁকি থেকে যায়। এসব কাগজপত্র সবসময়েই সাধারণত বিভিন্ন ব্রোকার বা এজেন্টদের মাধ্যমে সত্যায়িত হলে তখন গ্রহণ করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি প্রনিধানযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে এই সত্যায়নের দায়িত্ব পাচ্ছে সাবেক ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা এন্ড্রু ডার্স্টটনের পরিচালিত বেসরকারী সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার সাথে যৌথভাবে কাজ করার মাধ্যমে এ ধরণের জালিয়াতির সুযোগ নিয়ে ভিসা পাওয়া বন্ধ করতে তারা সক্ষম হবেন বলে তিনি বলেছেন।
অস্ট্রেলিয়ার ভিসা, স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সুবিধা কিংবা নাগরিকত্ব এসবই বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে অত্যন্ত আরাধ্য একটি বিষয়। যে কোন সচেতন মানুষই আশা করে এক্ষেত্রে যেন কোন ক্ষতিকর অপরাধ বা জালিয়াতির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা যেন অন্যায় সুযোগ না নিতে পারে। তবে এ নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করতে গিয়ে যারা নায্য সুবিধা পাওয়ার অধিকারী, তারাও যেন সংকটে জড়িয়ে না পড়ে এ বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: