সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


প্রতিশ্রুতি : কানুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
৪ নভেম্বর ২০২০ ২২:০৫

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:১৪

 

গল্পটা আমার বন্ধু আবীরের কাছ থেকে শোনা। গল্প বলা ভুল, বরং ঘটনা বলা শ্রেয়।

আবীর নর্থ আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট থেকে ইংরাজী সাহিত্য নিয়ে রিসার্চ করেছে। গাইড হিসেবে পেয়েছিল অ্যানা উইলসনকে। চল্লিশ একচল্লিশ বছরের লম্বা, তন্বী এবং রীতিমতো আকষর্নীয়া নারী অ্যানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ছাত্রদের কাছে ঈর্ষার পাত্র হয়ে গিয়েছিল আবীর। প্রথম দর্শনেই সদা হাস্যময়ী প্রানোচ্ছ্বল অ্যানার শান্তশিষ্ট ভাবুক প্রকৃতির আবীরকে খুব পছন্দ হয়। কিছুদিনের মধ্যে সম্পর্ক পারিবারিক হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝেই অ্যানার বাড়িতে ডিনারের জন্য আবীরের ডাক পড়ে। অ্যানার স্বামী জিমকেও আবীরের খুব ভালো লাগে। আবীরের মনে হয় অ্যানা আর জিম একেবারে মেড ফর ইচ আদার। রান্নাঘরে অ্যানা স্যুপ রান্না করতে ঢুকলে জিম তার পাশে দাঁড়িয়ে ছুরি দিয়ে ব্রকোলি কাটতে থাকে। চিকেনের বড় পিসটা জিম অ্যানার পাতে তুলে দেয়, আবার অ্যানা সব থেকে সরেস স্ট্রবেরিটা জিমের জন্য রেখে দেয়। ঘর ছেড়ে দূরে পড়ে থাকা আবীরের এই সম্পর্ক দেখে খুব আনন্দ হয়।

একদিন আবীর অ্যানার বইয়ের ভাঁজে খুব সুপুরুষ মাঝবয়সী এক ব্যাক্তির ছবি আবিষ্কার করে। ছবির নীচে অ্যানার মুক্তোর মতো হাতের লেখা, ‘ মাই ডিয়ার লুইস, আই মিস ইউ’। কে এই লুইস ? অ্যানার কোন গোপন প্রেমিক? আবীরের মাথায় নানান প্রশ্ন তোলপাড় করে।

দিন কয়েক পর এক রেস্তোরায় কফির টেবিলে আবীর প্রশ্নটা করেই ফেলে,’ অ্যানা, আমি একটা অজান্তে অন্যায়   কাজ করে ফেলেছি। তোমার বইয়ের পাতায় লুইস নামক একজনার ছবি দেখেছি। আই অ্যাম সরি’।

 আবীর ভেবেছিল অ্যানা হয়ত খুব রেগে যাবে, অথবা আবীরের কৌতুহল মিটিয়ে লুইস রহস্য প্রকাশ করবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। অ্যানা নীচের দিকে মুখ করে কফি পান করে উঠে চলে গেল। আবীর ঠিক করল, লুইসের প্রসঙ্গ আর কখনো সে আনবে না।

মাস তিনেক পর এক জানুয়ারীর দুপুরে আবীর ঘরে একা বসে আছে। কয়েকদিন বরফপাতের জন্য ইউনিভার্সিটি বন্ধ আছে। এটা এখানকার অতি সাধারন ঘটনা। শীতে মাঝেমাঝেই তুষারপাতে গোটা বেলফাস্ট বরফে ঢেকে যায়। ঘরে রুমহিটার চলছে বলে ঠান্ডাটা সেরকম মালুম হচ্ছে না। কিন্তু দরজা একটু ফাঁক করলেই কনকনে হাড় হিম করা ঠান্ডা টের পাওয়া যাচ্ছে। আবীর ভাবল আজ ব্রাউন রাইস, বাটার আর ডিম ভাজা দিয়েই দুপুরটা চালিয়ে দেবে। দেশের জন্য মনটা খুব খারাপ করছে। বেশী দিন ঘরে বসে থাকলেই মনটা এরকম বিষন্ন হয়ে যায়।

এমন সময় অ্যানার ফোন, ‘ মাই ডিয়ার ইয়াংম্যান, তুমি কী এখন একবার আমার বাড়িতে আসতে পারবে? আজ তো আবহাওয়া অনেক ভালো। আমরা একসাথে লাঞ্চ করব। ‘ আবীর ভাবল ব্যাপারটা মন্দ না। একটু বাইরেও যাওয়া হবে, অ্যানার বাড়ির দূরত্ব মাত্র মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। আবার দুপুরের রান্নার ঝামেলাটাও থাকল না। সে সানন্দে নিমন্ত্রন গ্রহন করল।

অ্যানার বাড়িতে আবীর পৌঁছালো দুপুর দেড়টা নাগাদ। অ্যানা বাড়িতে একা, জিম কাজে বেড়িয়ে গেছে। খাবার টেবিলে বসে আবীর দেখল অ্যানা তার জন্য খাবারের নামে একটা ছোটখাটো পাহাড় হাজির করেছে।

আবীরের ইতস্ততঃ মুখের দিকে তাকিয়ে অ্যানা বলল, ‘আমি জানি, তোমরা ইন্ডিয়ানরা খেতে খুব ভালোবাসো। আস্তে আস্তে খাও। খেতে খেতে গল্প করব’।

আবীর বলল, ‘ আমি ইন্ডিয়ান হলেও এই সাতমাসে আমার খাবার দৌড় নিশ্চই বুঝে গেছ। আমি কিন্তু মাত্র কুড়ি শতাংশোই শেষ করতে পারব। তাও কষ্টে সৃষ্টে’।

অ্যানা বলল, ‘ ঠিক আছে স্যুপ আর স্যালাড দিয়ে শুরু কর।আজ আমার মনটা খুব খারাপ আছে। তোমার সাথে কিছু দুঃখ শেয়ার করতে চাই’।

আবীর অবাক হল। পাশ্চাত্যের মানুষরা সাধারনতঃ প্রাচ্যের মতো এতটা খোলা মনের হয় না।  মাত্র কয়েক মাসের পরিচয়ে বাইরের কারো সাথে গোপন কথা শেয়ার করে না। সে চুপ করে থাকল।   

অ্যানা উঠে গিয়ে একটা ছবি হাতে করে নিয়ে এল, ‘তুমি এর কথাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে না  আবীর?’ আবীর দেখল ছবিটা সেই লুইস নামক ব্যক্তির ছবি।

অ্যানা একটু চুপ থেকে বলল, ‘হি ওয়াজ মাই সুইটহার্ট। মাই ফার্স্ট হাজব্যান্ড। অসময়ে ডিভোর্স না হলে আজ বারো বছরের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি সেলিব্রেশন হতো’।

আবীর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। এরকম একটা ব্যাপার তার চিন্তা ভাবনার বাইরে ছিল।

অ্যানা আবার বলল, ‘অবাক হচ্ছ , না ? জিম আমার সেকেন্ড হাজব্যান্ড। লুইসের সাথে সেপারেসন হয়ে গেছে। বাট, স্টিল আই লাভ হিম’।

আবীর স্যালাড খেতে খেতে ভাবল, আজ অ্যানা কথা বলার মুডে আছে। নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞসা করার দরকার নেই। যা বলার অ্যানাই বলে যাবে।

অ্যানা এক নিঃশ্বাসে পুরো কাহিনীটা বলে গেল। অ্যানার বয়ানেই শোনা যাক।

‘লুইসের সাথে আমার প্রথম দেখা আজ থেকে বছর পনেরো আগে। লন্ডনে একটা কলেজের দর্শনের শিক্ষক ছিল লুইস। আমি সেখানে ইংরাজীর অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিলাম। আমাদের লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট ছিল না। তবে ঊনত্রিশ ত্রিশ বছরের এই ছটফটে যুবককে প্রথম থেকেই ভালো লাগত। প্রেম জন্মায় আস্তে আস্তে। আমরা একে অন্যকে কফি অফার করি, ডিনারে যাই, নাইট পার্টি অ্যাটেন্ড করি। ক্রমশ বুঝতে পারি, আমরা একে অন্যের পরিপূরক।

বিয়ের আগে একবছর লিভ-ইন সম্পর্কে ছিলাম। চার্চে পাদ্রীর সামনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একে অন্যকে প্রতিশ্রুতি দিই। না, সারাজীবন এক সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি নয়, আমাদের প্রতিশ্রুতি একটু অন্যরকম। সারাদিন দুজনে যেখানেই থাকি না কেন, সন্ধ্যা আটটার মধ্যে ঘরে ফিরে আসব। এরপর একসাথে ডিনার করব, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব, তারপর একসাথে বিছানায় যাব। দুজনেই প্রানপনে চেষ্টা করেছি এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার। এমনও হয়েছে, কোন বার্থ ডে পার্টি বা নিউ ইয়ার পার্টি অর্ধসমাপ্ত রেখেই আমি আর লুইস ফিরে এসেছি শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য। না, এর জন্য কোন দুঃখ ছিল না আমাদের। কারন এই ভরসার ওপর ছিল আমাদের সম্পর্কের স্থায়িত্ত্ব, আমাদের সুখ।

বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর পেড়িয়ে গেল হাসি-কান্নায়। আমাদের কোন সন্তান হয় নি, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। লুইসের সেই নিয়ে দুঃখ ছিল না। আমি সঙ্গে আছি, এতেই সে খুশি। সেই সময় জিমের সাথে আমার পরিচয়। জিম একটা ছোট সংবাদপত্রের সাব এডিটর ছিল। একবার লন্ডনের রাস্তায় বড় ধরনের গোলযোগ হয়। একটি স্থানীয় স্কুলে এক বন্দুকবাজ এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে। লোকজন দিশেহারার মতো রাস্তায় দৌড়াচ্ছে। আমিও অসহায়ের মতো ছুটে বেড়াচ্ছি। সেই সময় জিম আমাকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দেয়।

জিমই আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। বিপদ থেকে রক্ষাকর্তার ওপর মানুষের স্বাভাবিক দূর্বলতা থাকে। আমি তো একজন মেয়ে। জিমের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ফেলি। না, লুইসের কাছে সম্পর্কটা লুকোই নি আমি। লুইস রাগ করে নি। বলেছিল, “ডার্লিং, যতদিন আমরা প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ থাকব, বুঝব আমরা দুজনে দুজনেরই আছি। কারন, যে মানুষ কোন সম্পর্ককে অস্বীকার করতে চাইবে, সে দেওয়া প্রতিশ্রুতিটাও রাখতে পারবে না।”

বিয়ের আগে জিমের সাথে দু বছরের সম্পর্কে আমি লুইসের প্রতি সেই অঙ্গীকারকে অস্বীকার করি নি। লুইসও একজন সহকর্মীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা জানতাম, দিনের শেষে আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি, একে অন্যের প্রতি দায়বদ্ধ।

সেদিনটা খুব মনে পড়ে। দিনটা একত্রিশে ডিসেম্বর। সারা বিকেল, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা অবধি পার্টি করে আমি আর জিম খুব ক্লান্ত। আমি জিমকে বিদায় জানিয়ে চলে আসছি। জিম আবদার করে বসল, আরো মিনিট পনেরো আমার সঙ্গ চায়। আমি ভেবে দেখলাম, পৌনে আটটায় বেরোলেও ঠিক আটটার মধ্যে পৌঁছে যাব। কিন্তু জিমের কোয়ার্টারে ঢুকে কি যে হল, দু চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল।

ঘুম ভাঙ্গল ভোর চারটেয়। জিম তখনো অকাতরে ঘুমাচ্ছে। আমি অসহায়ের মত কাঁদলাম আর লুইস আর ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। জানি, লুইসও সারারাত অনিদ্রিত আছে। সেও হয়ত,  ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছে, এই সম্পর্ককে এতদিন টিকিয়ে রাখার জন্য।

সকালের আলো ফোটার আগেই আমি দরজার বেল টিপলাম। লুইস দরজা খুলল। চোখ লাল। সে চোখে ক্ষোভ নেই, বরং আমার জন্য করুনা আছে।আমিই প্রথমে কথা বললাম, “দুঃখিত লুইস। আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসি। কিন্তু প্রতিশ্রুতি রাখতে পারলাম না। আমি জানি না এরপর আমাদের দুজনের ভাগ্যে কি লেখা আছে?”

লুইস শান্ত গলায় বলল, “ডার্লিং, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা নিয়েও কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের আস্থা আর দেওয়া অঙ্গীকারের ওপর। আস্থা ভেঙ্গে গেলে সেই সম্পর্ক শুধু ভা্লোবাসার কঙ্কাল হয়ে বেঁচে থাকে। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে সব থেকে বেশী কষ্ট আমার হবে। কিন্তু ক্ষমা করলে ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিক্ষা দেবার জায়গায় থাকব না”।

কথা বলতে বলতে লুইসের গলা ধরে এলো। আমি আবছা চোখে দেখলাম, লুইস আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে জমাট কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেল’।

 

কানুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
বর্দ্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top