সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


নায়কের মা : আহাদ আদনান


প্রকাশিত:
৭ নভেম্বর ২০২০ ২৩:০৪

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:০০

 

‘মিজান, তুমি স্ক্রিপ্টতো দিলা না’।

‘অ্যান্টি, সব রেডি আছে। আসলেই পেয়ে যাবেন। দেরি করবেন না। রওনা হয়েছেন’?

‘এইযে, বের হচ্ছি। মালিবাগ থেকে উত্তরাই তো। সিএনজিতে দুই-তিন ঘণ্টার বেশি লাগবে না’।

মালিহা বেগম সিএনজির জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকদিন এই যানটাতে চড়া হয়না। হাতে কাজ নেই ছয়মাস হয়ে গেল। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে তার সংসার। স্বামী নেই ছয় বছর। মেয়েটা একটা বেসরকারি কলেজের প্রভাষক। ‘বাস’ই এখন তাদের পারিবারিক যান।

ঢাকায় আজ জ্যাম খুব বেশি নেই। সিএনজির চালকটা ভালোই টেনে যাচ্ছে।

‘খালাম্মা, একটা কথা কই। কিছু মনে কইরেন না’।

‘হ্যা, বল’।

‘আপনাকে কোথায় যেন দেখছি। টিভিতে মনে হয়। ভুল কইলাম’?

‘দেশি চ্যানেল তো এখন কেও দেখেনা। সব জলসা, সিরিয়াল। তুমি আমাকে দেখলা কিভাবে’?

‘ঠিক কইছেন। আমিও জলসা দেখি। তবে আপনাকে দেখছি মনে হয়। মোশারফ করিমের মা হইছিলেন না আপনি’?

‘তাই নাকি? হবে হয়তো। এখন তো আর কেও ডাকে না আমাকে, আমাদের’।

দীর্ঘশ্বাসটা বাতাসে মিলতে মিলতে গাড়িটা থামে উত্তরার খুব পরিচিত একটা ভবনের সামনে। সবাই বলে ‘শুটিং বাড়ি’। ভীরু পায়ে মালিহা বেগম ভিতরে ঢুকেন। নীচতলায় শুটিং হচ্ছে। বিজ্ঞাপন হবে মনে হয়। নাকি ‘মিউজিক ভিডিও’? কাওকে চেনা লাগছে না তার। মিজান বলেছে সোজা তৃতীয় তলায় চলে যেতে। সেখানে গিয়ে দেখেন তেমন কেও এখনও আসেনি।

‘মিজান, আমি তো এসে পড়েছি। লোকজন কই’?

‘ও, আসছেন? এই আমি আসছি। মনা বলে একটা ছেলে আছে। আমি ফোন দিচ্ছি। চা দিবে আপনাকে’।

ফাঁকা ফ্ল্যাটটায় একা বসে মালিহা বেগম তার শুটিং জীবনের একটার পর একটা ছবি সামনে দেখতে পান। দেশ মাত্রই স্বাধীন হয়েছে। তার বয়স তেরো চৌদ্দ হবে হয়ত। বাবা ভর্তি করে দিয়েছিলেন গানের স্কুলে। সুবীর কাকু একদিন বললেন, ‘কীরে, তোরা টিভিতে গান গাবি’? সুবীর কাকু সিনেমার গানের সুর করেন।

জানুয়ারির সন্ধ্যাবেলা। জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে। মালিহা ঘামছে দরদর করে। আরও দশটা মেয়ের সাথে সে গান গাচ্ছে, ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয়রে ছুটে আয়, আয়, আয়’।

মিজান এসে গেছে। মালিহা বেগম হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।

‘আমার স্ক্রিপ্ট কই, মিজান’?

‘অ্যান্টি, আমাদের পরিচালক অনেক আধুনিক। আপনাকে সিকোয়েন্সটা বুঝিয়ে দিবে। সংলাপ নিজের মত করে বলবেন। আপনি সিনিয়র আর্টিস্ট। আপনার আবার স্ক্রিপ্ট লাগে নাকি’?

মালিহা বেগম এসব খুব অপছন্দ করেন। আশি, নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে একটার পর একটা নাটকে অভিনয় করে গেছেন তিনি। চেহারাটা নায়িকা নায়িকা ছিলনা তার। নায়িকার বান্ধবী, নায়কের বোন, পাশের বাড়ির মেয়ে, পরে ভাবী, ছোট চাচি, চরিত্রের অভাব হয়নি তার। বাঘা বাঘা সব প্রযোজক সবাই। চিত্রনাট্য নিয়ে এক মাস, দুই মাস ধরে সেকি মহড়া। দিন যেত রামপুরায়, রাত নামত রামপুরায়। আর এখনকার ছোকরা কি বলে এসব!

‘তা স্ক্রিপ্ট না হোক, আমার চরিত্রটা কি, বলবা তো’?

‘আপনি নায়কের মা। নায়ক নায়িকা বিয়ে করে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। নায়কের একটা পরকীয়া আছে। ডিভোর্স হয়ে যাবে অবস্থা। আপনি নায়ক, মানে ছেলেকে বুঝাবেন, এসব ভালো না। এই আরকি’।

চরিত্র শুনে মালিহা বেগম চুপসে যান। এত হালকা চরিত্রও তাকে করতে হবে ভাবেননি কোনদিন। আবার তিনি চলে যান নব্বইয়ের দশকে। নতুন নতুন প্যাকেজ নাটক হচ্ছে। প্রথম তিনি ‘মা’ চরিত্রে অভিনয় করছেন। চুলে তখন সাদা রঙ দিতে হত। এখন তার কোন কালো চুল নেই। সেই দিনও চলে গেছে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নায়ক এখনও আসেনি। দুপুরে দুইটা শিঙ্গাড়া আর চা দিয়েছিল স্পটবয়। খিদেয় পেট চোঁচোঁ করছে। একটু কি বাইরে গিয়ে ভাত খেয়ে আসবেন? মেকআপ যদি নষ্ট হয়? এসব ভাবতে ভাবতে আটটার দিকে নায়ক এসে পড়ে।

‘ভাই বসেন। এসিটা বাড়িয়ে দে’, হুলস্থূল পড়ে যায়।

‘আরে, গাজীপুর থেকে আসছি রাত তিনটায়। সামনের ঈদে চল্লিশটা নাটক যাবে আমার। আর পারিনা। দেখি, তোমাদেরটা শেষ করে যাই। সিকোয়েন্স কি’?

সিকোয়েন্স শুনে নায়ক তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।

‘ঘণ্টার নাটক বানানো শিখছ। ছেলেরে বুঝাইতে মা’র সামনে আসার দরকার কি? ফোন নাই? রাস্তার ফকিরও তো ফোনে কথা বলে, আর তোমরা? আমার নাটকে কোন মা, বাবা চরিত্র থাকবে না, বুঝছো? এমনি বাজেট নাই, বাজেট নাই কর, আবার রাখছে নায়কের মা চরিত্র। ক্যামেরা রেডি কর। আমি ফোনে কথা বলার সিন কইরা দেই। পরে মহিলা ভয়েস বসাইয়া দিও। দুই ঘণ্টার বেশি আমি সময় দিবনা’।

‘ভাই, আপনি জিনিয়াস। আপনি যেভাবে বলেন সেভাবেই হবে। ওই ক্যামেরা রেডি কর’।

বাস যাচ্ছে মালিবাগের দিকে। মালিহা বেগমের হাতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট। মিজান ছেলেটা মুখ কাঁচুমাচু করে কিছু টাকা আর এই প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। তার খিদা মরে গেছে। এখন খাবার নামবে না গলা দিয়ে। মালিহা বেগমের চোখে জল। তার ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে কাঁদতে।

শুকনো চোখে গ্লিসারিন লাগিয়ে কান্নার চেয়ে চোখ ভরতি জল আটকে রাখার অভিনয়টা অনেক কষ্টের করে দিয়েছেন বিধাতা।

 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top