সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


বিশ্বজুড়ে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস


প্রকাশিত:
৫ মে ২০১৯ ১৭:৫৩

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ১৬:২৩

বিশ্বজুড়ে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস

রাত পেরোলেই বিভিন্ন দেশে শুরু সিয়াম সাধনার মাস, রমজান। মুসলিম বিশ্বজুড়ে তাই পুরোদমে চলছে পবিত্র মাসটিকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি।সন্ত্রাসী হামলা মোকাবেলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করেছে নানা দেশ।



মিসর, ফিলিস্তিন, জর্ডান, কুয়েত, কাতার, ওমান, ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে আগামীকাল থেকে রমজান শুরু হবে। আল্লাহর রহমত বিস্তারের আধার সিয়ামের এ মোবারক মাসকে গনিমত মনে করে মুসলিম উম্মাহ আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকেন। আরব-আজম, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য তথা দুনিয়ার দিকে দিকে সাড়া পড়ে যায় মোবারক এ মাসটি বরণের প্রস্তুতিতে। 

আরবে সৌহার্দের বসন্ত

শবেবরাতের পর থেকেই সৌদি আরবে পুরোদমে রমজানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। মহিমান্বিত এ মাসকে ঘিরে পড়ে যায় সাজ সাজ রব। একে অপরে দেখা হলেই ‘শাহরু আলাইকা মুবারাকা’ (রমজান তোমার জন্য বরকতময় হোক) বলে কুশলবিনিময় করেন। রমজানে আরবজুড়ে ব্যাপকভাবে চলে দাওয়াতি কাজ। নানা ধরনের ক্যালেন্ডার, হ্যান্ডবিল, লিফলেট, বই, সহিহ হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত সকাল-সন্ধ্যার দোয়ার ছোট কার্ড ইত্যাদি ছাপিয়ে মসজিদে মসজিদে বিতরণ করে থাকেন। এটি চলতে থাকে রমজানজুড়েই। বিভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে এসব ছাপা হয়। যেমন রমজানের ফজিলত, রোজার ফজিলত এবং রমজানের গুরুত্বপূর্ণ আমল ইত্যাদি। 

রাস্তার পাশে কিংবা বাজারে ও মার্কেটে দেখা যায় সারি সারি তাঁবু। অনেকগুলো আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এগুলো রোজাদারদের ইফতার করানোর জন্য তৈরি করা হয়। এসব তাঁবুতে সর্বোৎকৃষ্ট ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। একেক তাঁবুতে শতাধিক থেকে শুরু করে হাজারো রোজাদার ইফতার করেন। বিভিন্ন তাঁবুতে আবার কিছু ইসলামী প্রশ্ন নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে ওমরায় যাওয়ার টিকিটসহ নানা পুরস্কার থাকে। এছাড়া মসজিদগুলোতে থাকে ইফতারের ব্যবস্থা। অনেকে নিজ এলাকায় ইফতার করার জন্য মানুষকে দাওয়াত দিয়ে থাকেন। আরবে বসবাসরত শ্রমিকদের পুরো রমজানে ইফতার বা রাতের খাবার কখনও কিনতে হয় না। আর এসব কাজ পুরোপুরি নিজস্ব উদ্যোগে করা হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের এবং উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে- যারা এসব কাজে অর্থের জোগান দেন, তাদের কেউ চেনেন না, কেউ জানেন না কে তাদের ইফতার করাচ্ছেন! তারা কোনো বাহবা পেতে বা নামের জন্য এ কাজ করছে না। শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতেই তাদের এ প্রচেষ্টা, যা আমাদের দেশে খুবই বিরল অথচ শিক্ষণীয়। 

আরব দেশগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ভোজ্যপণ্যের ওপর রমজানকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন ছাড় দিয়ে থাকে। বাদশাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন ভোজ্যসামগ্রী সংবলিত গিফট বক্স (যাতে চাল, তৈল, চিনি, চাপাতা ও দুধ ইত্যাদি থাকে) পুরো দেশের সর্বত্র যারা তুলনামূলক দুস্থ তাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

আমেরিকায় শান্তির শীতল পরশ

বর্তমান বিশ্বের সুপার পাওয়ার খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ৭০ লাখ মুসলমান রমজানকে স্বাগত জানাতে সানন্দে প্রতিক্ষায় রয়েছেন। ওয়ান ইলেভেনে টুইন টাওয়ারের সন্ত্রাসী ঘটনার পর আমেরিকার মুসলমানদের ওপর মারাত্মক ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব থাকলেও মুসলমানরা ধৈর্যের সঙ্গে তা মোকাবিলা করে ইসলামের সৌন্দর্য মার্কিন মুল্লুকে বিকশিত করেন। তাই তো সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের শুরু করা রমজান উপলক্ষে হোয়াইট হাউসে ইফতার পার্টি বর্তমানে একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে সূত্রেই ২০১৩ সালের রমজানে হোয়াইট হাউসে ৫৩টি দেশের মুসলিম প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করে ইফতার পার্টি আয়োজন করা হয়। আরও আনন্দের বিষয় হচ্ছে, অনেক অমুসলিম এ মহাপবিত্র বরকতময় মাসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হচ্ছেন। 

অনলাইন সূত্রে জানা যায়, বেশিরভাগ মুসলমান বাস করেন ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ইলিনয়েস, ইস্তিয়ানো, মিসিগান, টেক্সাস, ভার্জিনিয়া এবং মেরিল্যান্ড রাজ্যগুলোতে। রমজানকে কেন্দ্র করে আমেরিকার বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন বিশেষ কর্মসূচি পালন করে। 

ইউরোপে ব্যস্ততা বেড়ে যায়

রমজানে ইউরোপের দেশগুলোতে রোজাদারদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহুগুণে। একদিকে বাড়তি শিফটের কাজ, অন্যদিকে ইফতারি ও সাহরির আয়োজন এবং ইবাদত-বন্দেগি করা। নীরব শহর, শান্তির শহর, সাত পাহাড়ের শহর এবং পোপের শহরখ্যাত আটলান্টিক মহাসাগরের কিনারায় অবস্থিত ইতালিতে মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ হলো মুসলমান। এ অল্পসংখ্যক মুসলমান রমজানকে ঘটা করে স্বাগত জানান। 

গতবারের মতো এবারও রমজানে সবচেয়ে বেশি সময় রোজা রাখবেন উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত উত্তর মেরুঘেঁষা দেশ আইসল্যান্ডের মুসলমানরা। প্রায় ২১ ঘণ্টা। ইফতার, মাগরিব, এশা, তারাবি, সাহরি এবং ফজর নামাজের জন্য মাত্র ৩ ঘণ্টা সময় পাবেন তারা। এছাড়া নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কসহ সব স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোতেই প্রায় ১৯ থেকে ২০ ঘণ্টা দিন থাকবে। জার্মানি, ব্রিটেন ও রাশিয়াতে এ সময় প্রায় ২০ ঘণ্টার মতো। ইউরোপের একমাত্র মুসলিম প্রতিনিধি তুরস্কে রমজান উপলক্ষে সরকার কর্তৃক মেলার আয়োজন করা হয়। মেলায় যারা রমজানের ইফতারের খরচ পোষাতে পারেন না বা যেসব শ্রমিক ইফতারের জন্য ঘরে ফিরতে পারেন না, তাদের জন্য বিনামূল্যে ভাত ও গোশতের ব্যবস্থা থাকে। 

আফ্রিকায় তাকওয়ার আবহ

আফ্রিকার মুসলিম প্রধান ও পিরামিডের দেশ মিসরে রমজানকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় অভিসিক্ত করা হয়। কায়রোয় তোপধ্বনি দিয়ে রমজানের সূচনা ঘোষণা করা হয়। এ মাসের প্রতি সন্ধ্যায় দিনের উপবাস সমাপ্তি ঘোষণা করার জন্য ফের তোপধ্বনি করা হয়। তোপধ্বনির বিষয়টি রমজানের এত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকে পরিণত হয়েছে যে, টেলিভিশনেও এটি প্রচারিত হয়। এ মাসে অফিসের কর্মঘণ্টা কমানো হয়, যাতে রোজাদাররা মসজিদে ইবাদতে পর্যাপ্ত সময় পান। দলবেঁধে তারা মসজিদের দিকে ছুটেন এবং আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে চারদিক প্রকম্পিত করেন। দিনের কাজকর্ম করে তারা রাতে তারাবি এবং কোরআন তেলাওয়াত করে কাটিয়ে দেন। 

আফ্রিকা মহাদেশের বড় একটি মুসলিম দেশ সুদান। রমজান উপলক্ষে সুদানিদের জীবনযাপনে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য লক্ষ করার মতো। একইভাবে আলজেরিয়াতেও বয়স্কদের মধ্যে বেশি ধর্মীয় মনোভাব লক্ষ করা যায়। এদেশে রমজানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে; কিন্তু ঈদের এক সপ্তাহ আগে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। লিবিয়াতে রমজানকে আগে থেকে খুব আনন্দ ও গুরুত্বের সঙ্গে অভিনন্দন জানানো হয়। 

মধ্যপ্রাচ্যে রাজকীয় প্রস্তুতি

সৌদি আরবের মতো তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশ কুয়েতে রমজান আসার আগ থেকেই শুরু হয় ব্যাপক প্রস্তুতি। ১৫ দিন আগে থেকেই রমজান ঘিরে দেশটির রাজধানীসহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সাজ সাজ রব। একে অপরকে রমজানের অভিবাদন জানানো শুরু করেন। আর পবিত্র রমজানের চাঁদ দেখার পর থেকে বদলে যায় জীবনচিত্র। বুড়ো, শিশু, গর্ভবতী মা আর রোগী ছাড়া প্রায় সবাই রোজা রাখেন। দলবেঁধে পাড়া-মহল্লার মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর অবস্থাও একই। ঘড়ির কাঁটা যেমন বন্ধ হয় না, তেমনি থেমে থাকে না যুদ্ধবিগ্রহের শিকার মানুষের জীবনযাত্রা। মানুষ সুখে থাকুক বা দুঃখেই থাকুক তার দৈনন্দিন কর্মকা- বন্ধ থাকে না। এখানে দৃশ্যত এক পক্ষ বিজয় লাভ করছে এবং অন্য পক্ষ পরাজিত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরাজিত হচ্ছে মানবতা। যুদ্ধবিগ্রহের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে অমুসলিমরা যেমন আছে, তেমনি আছে মুসলিমরাও। ইরাকের কথাই ধরা যাক। এখানে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত নূরি আল মালিকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে সুন্নি সমর্থিত আইএস যোদ্ধারা। ইয়ামেনে চলছে সৌদি জোটের বিমান হামলা। তবুও তাদের দৈনন্দিন আহার-নিদ্রা বন্ধ নেই। পবিত্র রমজান উপলক্ষে তারাও সিয়াম পালন করবেন। মুসলমানদের প্রথম কেবলা ‘মসজিদুল আকসা’র দেশ ফিলিস্তিনের মুসলমানরাও শত দুঃখ-লাঞ্ছনা সত্ত্বেও রমজানকে বরণ করে নেয় সানন্দে। ছোট-বড় সবার মধ্যে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা।

অস্ট্রেলিয়া: 

বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মহাদেশ হলেও অস্ট্রেলিয়া হচ্ছে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম দেশ। দেশটির বহু মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের হারও অনেক বেশি।দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখের মতো। 



এখন চলছে সিয়াম সাধনার মাস রমজান। আবহাওয়া ও সামাজিক রীতি-নীতির কারণে ওখানকার রমজান সংস্কৃতিতে কিছুটা পার্থক্য থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। 



 মুসলিমদের নিজেদের উদ্যোগে ও আগ্রহে রোজা পালন করতে হয়। তবু মুসলিম কমিউনিটিগুলো রমজান এলেই সাজ সাজ রব পড়ে যায়। মসজিদের সাথে যোগাযোগ বাড়ে মুসলিমদের। অনেকেই কাজের ফাঁকে একটু ইবাদতের আশায় মসজিদে ঢুকে পড়েন। কেউ কেউ কর্মস্থলের অবসরে জিকির বা মুখস্থ কোরআন তেলাওয়াত করে থাকেন।অমুসলিম দেশ হওয়ার ফলে অস্ট্রেলিয়ার মুসলিমরা রোজা উপলক্ষে সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধার পান না বটে। তবে এর মধ্যেও এ সময় এখানকার মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। তারা পরস্পরের বাসায় ছুটির দিনে একসাথে ইফতার করেন। 

এ দেশের মুসলমানদের প্রায় ১২ ঘণ্টা রোজা রাখতে হয়। 


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top