সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১


পশু কুরবানি আত্মকুরবানির প্রতীক


প্রকাশিত:
১১ আগস্ট ২০১৯ ১৯:০০

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ১৫:২৩

পশু কুরবানি আত্মকুরবানির প্রতীক

পিতা-পুত্রের সুমহান আত্মত্যাগের ফলে প্রতিষ্ঠিত হলো ইব্রাহিম (আ)-এর সুন্নাত হিসেবে মানবসন্তানকে যবেহ করার পরিবর্তে সম্পদের মোহ ত্যাগ করে গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার বিধান কুরবানি প্রথা। এর দ্বারা আল্লাহর প্রতি বান্দার প্রেম ও সম্পদের প্রতি লোভ-লালসার আতিশয্যের কামনা-বাসনা ত্যাগের পরীক্ষা করা হয়। এর বিনিময়ে আল্লাহর কাছ থেকে মুমিন বান্দারা পুণ্যের আধিক্যতা ও জান্নাতের নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে। এই ত্যাগের প্রতীক বা স্মারক হিসেবে কুরবানির ঈদের রীতি প্রবর্তিত হয়- যাতে সুস্পষ্ট হয়ে যায় ঈদুল আজহার সৌন্দর্য এবং উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মানবিক মূল্যবোধ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কুরবানি করো।’ -কাওছার : ২।



সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহকে (স) জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই কুরবানি কী?’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের সুন্নাত’। -ইবনে মাজা। মেহেরবান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য বছরে দুটি শ্রেষ্ঠ খুশির দিন উপহার দিয়েছেন। একটি ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আযহা। দুই ঈদেরই রয়েছে দুই রকম বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য। ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ আসে ত্যাগের মহিমা নিয়ে। আরবি ‘আজহা’ এবং ‘কোরবান’ উভয় শব্দের অর্থ- উৎসর্গ। ‘কুরব্’ ধাতু থেকে কুরবানি শব্দটির উৎপত্তি। এর অর্থ আত্মত্যাগ, উৎসর্গ বা বিসর্জন, নৈকট্য বা অতিশয় নিকটবর্তী হওয়া ইত্যাদি। ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ বিশ্ব মুসলিম মননে আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের দৃঢ়প্রত্যয় গ্রহণের তাগিদ সঞ্চারিত করে।



ইসলামের পরিভাষায় কুরবানি বলা হয় ঐ নির্দিষ্ট পশুকে যা একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর নামে জবাই করা হয়। কুরবানি দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি হাসিল করা যায় বলে এমন নামকরণ। কুরবানির বিধান যুগে যুগে সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। উদ্দেশ্য একটাই- আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ -হজ্জ : ৩৪।



কুরবানির শুরু হয়েছিল আদম (আ)-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের মধ্যে সংঘটিত কুরবানির মাধ্যমে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে রাসূল! আপনি তাদেরকে আদমের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কুরবানি করেছিল, তখন একজনের কুরবানি কবুল হল এবং অন্যজনের কুরবানি কবুল হল না। সে (কাবিল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কুরবানি কবুল করেন। সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার প্রতি হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ -মায়েদা : আয়াত ২৭-২৮। এ হলো কুরবানি কবুল হওয়া ব্যক্তির ভাবাবেগ ও মানসিকতা। কেননা কুরবানি তাকওয়াবান লোকদের আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য নিদর্শন।



বর্তমান মুসলিম মিল্লাতের এই কুরবান বা উৎসর্গের রয়েছে অর্থবহ এক ঐতিহাসিক পটভূমি। ইব্রাহিম (আ) আল্লাহর সন্তুষ্টির পরীক্ষায় ইসমাইল (আ)কে কুরবানির স্মৃতিময় ঘটনা নিজেদের মধ্যে বিরাজমান করা। ইব্রাহিম (আ) স্বপ্নে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কুরবানি দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হন। এজন্য তিনদিনে দৈনিক ১০০ করে মোট ৩০০ উট কুরবানি করলেন; কিন্তু তা আল্লাহর দরবারে কবুল হলো না। বারবারই স্বপ্নে আদেশ করা হলো, ‘তোমার প্রিয় বস্তু কুরবানি করো।’অবশেষ তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে তার নিজের ছেলেকে কুরবানি দিয়ে ঈমানের কঠিন পরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত ইব্রাহিম (আ) উত্তীর্ণ হন।



এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘যখন তারা (পিতা-পুত্র) উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইব্রাহিম তার পুত্রকে (যবেহ করার জন্য) কাত করে শায়িত করলো, তখন আমি তাকে আহবান করে বললাম, ‘হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে!’ এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে (ইসমাঈল) মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানির বিনিময়ে।’ -সাফফাত : ১০৩-১০৭।



ত্যাগ ছাড়া ঈদুল আজহার আরেকটি বড় শিক্ষা হল আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া। কুরবানির গোশত গরিব আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী, মিসকিন, দ্বীন-দুঃখী, হতদরিদ্রসহ যত বেশি অভাবী মানুষকে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া যায় ততই উত্তম। এটা তাদের হক বা অধিকার। কুরবানি করে সব ফ্রিজে জমা রেখে সপরিবারে গোশত খাওয়া যেন ধনীদের মনকে পেয়ে না বসে। মানুষের মনের মধ্যে যে পশুশক্তি সুপ্ত বা জাগ্রত অবস্থাায় বিরাজমান তা অবশ্যই কোরবান করতে হবে। কেননা কুরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা, পশু কুরবানি হচ্ছে আত্মকুরবানির প্রতীক মাত্র।



কুরবানির দিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধনী-গরিব নির্বিশেষে এক কাতারে নামাজ আদায়, কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর কুরবানি করা হয়। এদিনে অশ্রসিক্ত হয়ে অনেকেই যান কবরস্থাানে, বাবা-মাসহ প্রিয়জনদের রুহের মাগফিরাত কামনায়।



পশু কুরবানির মাধ্যমে আমাদের মাঝে বিরাজমান যাবতীয় পশুত্ব তথা মির্মমতা, ক্রোধ, হানাহানি, লোভ, পরশ্রীকাতরতা, সকল অশুভ ইচ্ছে ও কু-বাসনার কুরবানি হোক, সকল কু-রিপুর কুরবানি হোক। মানবতাবোধে উজ্জীবিত হওয়ার শিক্ষাই হলো কুরবানির মহান শিক্ষা। সত্য সুন্দর আর পবিত্রতায় সকল কু-রিপুকে কুরবানি করে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক এই কামনা মহান কর“নাময় মেহেরবান আল্লাহর পাকের দরবারে। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে লোক দেখানোর জন্য কুরবানি নয় বরং পশুকে জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনের পশু ও আমিত্বকে জবাই করার তাওফিক দান করুন। কুরবানির মাধ্যমে নিজেকে তাকওয়াবান হিসেবে তৈরি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top