সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১


দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করে হিমা দাসের বিশ্ব মিটে সোনা জয় : বটু কৃষ্ণ হালদার


প্রকাশিত:
৬ মার্চ ২০২১ ১৮:৫০

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৩৫

ছবিঃ হিমা দাস

 

আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় আমরা বহু নমুনা দেখে থাকি, যেমন কেউ এক টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে রতন টাটা আম্বানি দের মত বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়ে যায়, আবার কেউ ভাগ্যের দোহাই দিয়ে কোটিপতি থেকে রাস্তার ভিখারি হয়ে যায়। আবার হাত-পা থেকেও কেউ সামান্য ডোবা জলে ডুবে মরে,আবার পা না থাকা সত্ত্বেও মাসুদুর রহমানের মত সাঁতারু রা ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। আবার কেউ কেউ হেঁটে হাফ কিমি রাস্তা পার হতে পারে না,আবার কেউ মাইলের পর মাইল দৌড়ে দেশের জন্য সোনা জয় করে নিজের স্বপ্নকে আকাশ ছুঁয়ে ফেলে।বর্তমান সময়ে সেই সোনালী স্বপ্নের কারিগর হিমা দাস এক উজ্জ্বল তম নাম।যদি বলা হয় যে নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করেছিলেন, অদম্য ইচ্ছা শক্তির জোরে, কথাটি নেহাত ভুল বলা হবে না। ২০০৯ সালে অসমের নগাও জেলার ধিং গ্রামে এক গরিব কৃষক ঘরে তার জন্ম। পিতা রঞ্জিত দাস এবং মাতা জোনালী দাসের ষষ্ঠ এবং কনিষ্ঠতম সন্তান। ছোটবেলা থেকেই হিমা খেলাধুলা ভালোবাসতেন। প্রথম জীবনে সে ফুটবল খেলত স্থানীয় গ্রামের ছেলেদের সত্যে। স্থানীয় কোচের পরামর্শে সে অ্যাথলেটিক্স গ্রহণ করে। সে সময় এক আন্তঃজেলা প্রতিযোগিতায় সে ১০০ মিটার এবং ২০০ মিটারে স্বর্ণ পদক জিতে নেন। তার উদীয়মান প্রতিভায় মুগ্ধ হন যুব কল্যাণ অধিদপ্তর এর অ্যাথলেটিকস কোচ নিপণ দাস। কোচের ভাষায়"হিমা সস্তা স্পাইক পড়ে হাওয়ার মতো দৌড়ে ছিলেন, এমন প্রতিভা তিনি আগে কখনো দেখেননি"। শুধুমাত্র স্পাইক ছাড়া তার কাছে কোনো রকম খেলার ভালো সরঞ্জাম ছিল না।কোচ নিজেই ঠিক করেছিলেন হিমা কে কোচিং করাবেন। তার জন্য গ্রামের সহজ-সরল গরিব কৃষক পিতা কে বোঝান যে এই অ্যাথলেটিক্সে হিমার ভবিষ্যৎ আছে।তার জন্য তাকে গ্রাম থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে গুয়াহাটিতে নিয়ে যেতে চান। অবশেষে পিতার সম্মতিতে সে কোচের সাথে রওনা দেয় গুয়াহাটিতে। সেই থেকে আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি।

কেই বা চিনত তাকে, কোন মিডিয়ায় এগিয়ে আসেনি তার খবর প্রচার করার জন্য। যে দেশে প্রতিনিয়ত কৃষকদের আত্মহত্যার খবর জানা যায় সেই দেশে অসমের এক প্রত্যন্ত গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের কন্যা ডাল-ভাত খেয়ে বিশ্বের দরবারে ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছে। কোন প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খাবার জোটে নি তার কপালে তবুও জাতীয় সংগীত চলাকালীন হিমা দাসের দুচোখের জল আমরা দেখেছিলাম। তার সেই দিনের চোখের জল আজ ভারতের আশীষ হয়ে জ্বলজ্বল করছে বিশ্বময়। তিনি কোন সেলিব্রেটি ছিলেন না ছিলেন না কোন বিশ্বসুন্দরী বা বিখ্যাত অভিনেত্রী। তবুও বর্তমান সময়ে তিনি সংবাদ শিরোনামে। তাকে এই মুহূর্তে সবাই জেনে ভারতের সোনার মেয়ে হিসেবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেখানে সবাই পুত্র সন্তানের কামনা করে লিঙ্গ নির্ধারণ করে কন্যা সন্তান জানতে পারলে ভ্রুণ হত্যা করে, কার্যত সোনার মেয়ে হিমা দাস সেইসব নিম্নরুচির সমাজব্যবস্থার মুখে ঝামা ঘষে দিলেন। ১৫ দিনের ব্যবধানে দেশকে দিলেন পাঁচ-পাঁচটি স্বর্ণপদক। তবে দুঃখের বিষয় যে সময় তিনি দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে ব্যস্ত বিশ্বের দরবারে, গলায় উঠেছে সোনার পদক, ঠিক সেই সময় তার জন্মভূমি আসাম বন্যা কবলিত। আয়ের অর্ধেকেরও বেশি দিয়ে দিলেন বন্যাকবলিত দুস্থ অসহায় মানুষগুলো সেবা করার জন্য। সে প্রমাণ করে দিল ভদ্র পোশাক পড়লে যেমন সভ্য ভদ্র হওয়া যায় না ঠিক তেমনি টাকা থাকলেই বড় মনের মানুষ হওয়া যায়না। তার জন্য দরকার একটা বড় মন। বস্তাপঁচা সমাজব্যবস্থার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন নারী-পুরুষ সবাই সমান।

রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী আদর্শ নারীর সংজ্ঞা। নারীদের ক্ষেত্রে রুপ আর গুণের মধ্যে এই বিভেদ রেখা কেন? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী আজ জল স্থল অন্তরীক্ষে সমানতালে পাল্লা দিয়ে চলেছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে প্রমাণ করেছে যে তারা এ সমাজে পুরুষদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তবু কেন এত ভেদাভেদ? শুধু নারীরা নয়,এ সমাজের বুকে কন্যা শিশুরা আজও সুরক্ষিত নয়। সময় পরিবর্তনশীল। বিশ্ব আজ তালুবন্দি। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় সভ্য সমাজের সুষম বিকাশ ঘটেছে।অথচ উত্তরাখণ্ডের এক গ্রামে গত ছয় মাসে একটা শিশুকন্যা জন্মায়নি। কন্যাভ্রূণ নির্মূলন যজ্ঞে যোগ দিয়েছেন অজাত শিশুর পরিবার, শিক্ষিত ডাক্তারবাবুরা এবং আইনের মুখে ছাই দেওয়া প্রশাসন। জন্মাবার আগেই গর্ভপাতের প্রবণতা বেড়েছে। অথচ আমাদের ভারতবর্ষের বুকেই আইন রয়েছেন লিঙ্গ নির্ধারণ আইনত অপরাধ।অথচ জন্মের লগ্নেই ১০০০ শিশুপুত্রের তুলনায় ১০৪ জন মেয়ে কম জন্মায় আমাদের দেশে। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ফুলের কলিরা। জন্ম থেকে ছয় বছর পর্যন্ত কন্যা ও পুত্র সন্তান অনুবাদ কমে চলেছে ১৯৪১ সাল থেকেই। কন্যাভ্রূণ নির্মূলনে চলে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। পিছিয়ে নেই কলকাতার শিক্ষিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত অঞ্চল। এই কলকাতার বুক থেকেই নির্দ্বিধায় চলছে কন্যা শিশু নারী পাচার। তবুও ঘটা করে কুমারী পূজা বরণ। এসব আজ লোক চক্ষুর সম্মুখে মিথ্যা প্রহসন ভ্রষ্টাচার ছাড়া আর কিছুই নয়।

তবে সেই প্রাচীন পৌরাণিক যুগের সময় হতেও নারীরা উপেক্ষিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে উপেক্ষিত দুই সতী সীতা ও দ্রৌপদী তার জীবন্ত নিদর্শন। আবার তেমনি প্রাচীন ইতিহাস থেকেও আমরা বহু মহীয়সী নারীর কথা জানতে পারি যারা নিজেদের যোগ্যতায় ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছিলেন। তেমনি উনবিংশ শতকে বহু নারী সমাজে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাতঙ্গিনী হাজরা, বাংলার প্রথম রাজবন্দী ননীবালাদেবীরা এগিয়ে এসেছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে। ইতিহাস তো আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আবার বর্তমান সময়েও আরতী সাহা, পি টি ঊষা, কল্পনা চাওলা, সাইনা নেহওয়াল, কর্মকার সাইনা নেহওয়াল, ঝুলন গোস্বামী, লীলা মজুমদার, বাসন্তী দেবী, মাদার টেরিজা, মহাশ্বেতা দেবীর মত বহু নারী দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল বিশেষ ভূমিকা পালন করে এসেছে। তবুও এই অত্যাধুনিক সভ্যতার যুগে নারীরা শুধুমাত্র ভোগ্য পণ্য আমদানি-রপ্তানি বিলাস বৈভবের চিহ্নমাত্র। বর্তমান সমাজের বুকে দুধের শিশু থেকে মাঝবয়সী এমনও ষাটোর্ধ্ব নারী ও আজ বেআব্রু। শিক্ষিত সমাজের বিবেকবান অর্জুন রা আজ নির্বিকার। মাঝে মাঝে ধর্ষণের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। চারিদিকে মোমবাতি মিছিলে পা মেলায় সমাজের বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ জনগণ। কিন্তু ওই মিছিলেই লুকিয়ে থাকে শিকারের নীল চোখ।

কথায় আছে গোবরে পদ্মফুল ফোটে। তা আরো একবার প্রমাণ করে দিল বিশ্ব মিটে সোনাজয়ী হিমা দাস। তিনিই ভারতের প্রথম অ্যাথলিট যিনি যে কোনও পর্যায়ের বিশ্ব চ্যাম্পিনশিপের ট্র‌্যাক ইভেন্টে সোনা জিতেছেন। ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব ২০ জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, ফিনল্যান্ডের ট্যামপেয়ারে, মহিলাদের ৪০০ মিটারে স্বর্ণ পদক জিতে নিতে সময় নিয়েছেন ৫১.‌৪৬ সেকেন্ড। ২০১৮ জাকার্তা, এশিয়ান গেমসে তিনি মহিলাদের ৪০০ মিটারে রৌপ্য  এবং মহিলাদের ৪ x 8০০ মিটারে রিলে ও  ৪ x 8০০ মিটার মিশ্র রিলেতে স্বর্ণ পদক জিতেছেন। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার ইচ্ছাশক্তি যদি অদম্য থাকে তাহলে সাফল্য কখনোই আটকানো যায় না।

স্বাধীনতার ৭৪ বছর অতিক্রান্ত। তবুও দেশের বহুলাংশে আজও হয়নি উন্নত রাস্তাঘাট, বিদ্যুতের সংযোগ, নেই ভালো স্কুল কলেজ, খেলাধুলার উপযুক্ত পরিকাঠামোর,তবুও এমন বহু প্রতিভা বারবার দেশের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে। যদি কেউ কঠোর পরিশ্রম করে মনোযোগ সহকারে তাহলে শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি উঠে আসবেন প্রচারের আলোয়। সাফল্য অবশ্যই দরজায় কড়া নাড়বে। সেটাই ফের প্রমাণ করে দিলেন অসমের প্রত্যন্ত গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সোনার মেয়ে হিমা দাস। তার কঠোর পরিশ্রমের কাছে উচ্চাস নের সিড়ি অবশেষে ধরা দিয়েছে।

 

বটু কৃষ্ণ হালদার
কবরডাঙ্গা,কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top