সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

পর্ব তের: ওকলাহোমা


প্রকাশিত:
২৫ জুন ২০১৯ ০৫:৪৫

আপডেট:
৬ এপ্রিল ২০২০ ১৯:৪০

আহসান হাবীব

ঈদের পরদিন আমরা এষার বন্ধু শাদমানের গাড়িতে করে রওনা হলাম ওকলাহোমা স্টেট এর উদ্দেশ্যে। ওকলাহোমা আমেরিকার একটা বিশেষ ধরনের স্টেট (দ্যা ল্যান্ড অফ নো বাউন্ডারী)। কারণ এখানে প্রচুর ক্যাসিনো আছে। লাস ভেগাসের থেকেও সংখ্যায় বেশি বিশাল বিশাল সব ক্যাসিনো। এইসব ক্যাসিনোর মালিক হচ্ছে সেইসব রেড ইন্ডিয়ানদের বংশধররা, যাদের কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করতে গিয়ে হত্যা করেছিল! আমেরিকান সরকার আইন করেই এই স্টেটে ক্যাসিনোতে তাদের মালিকানা দিয়ে রেখেছে। আমেরিকানরা আসলে অদ্ভুত এক জাতি... চোররে কও চুরি কর, পুলিশরে কও ধর ধর টাইপ আরকি...!

মজার ব্যাপার হচ্ছে কলম্বাস আসলে বের হয়েছিল পাক-ভারতের একটা আলাদা রুট আবিষ্কার করতে। আমেরিকায় (নেটিভ ল্যান্ড) এসে সে ভাবল এটাই বোধ হয় ইন্ডিয়া, কিন্তু এদের চামড়া লাল বলে সে নামকরণ করল রেড ইন্ডিয়ান। (রেড ইন্ডিয়ান বলতে হয় না, যেমন বলতে হয়না নিগ্রো বা ব্ল্যাক। এদের বলতে হয় নেটিভ আমেরিকান, আর ব্ল্যাকদের বলতে হবে আফ্রিকান আমেরিকান) তবে এখানে মানে আমেরিকায় আস্তে আস্তে কলম্বাস অজনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। “কলম্বাস ডে” এখন আর সব স্টেট এ পালিত হয় না। 

ওকলাহোমাকে সুনারদের (Sooner) স্টেটও বলে। এখানে একটা ব্যাপার আছে... এই ওকলাহোমা ছিল বিশাল শূণ্য নেটিভ ল্যান্ড, যার অধিকার শুধু নেটিভদেরই আর কারো না। সুনাররা বা সাদারা এসে দ্রুততম সময়ে এসব জমি দখল করে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। এদেরকে কি কারণে ওকলাহোমা এত গর্বের সাথে সেলিব্রেট করে, সেটা বোঝা গেল না। ইউনিভার্সিটি অফ ওকলাহোমা এলাকায় প্রথম আসা সুনারদের সুন্দর সুন্দর সব ভাস্কর্যও আছে, আমাদের দেখার সৌভাগ্য (?) হয়েছে।

যাহোক ডালাস থেকে ওকলাহোমা, তিন ঘন্টার একটা লং ড্রাইভ আমরা যথেষ্ট এনজয় করলাম। পথে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল বলে গাড়ি থামাতে হল। একটা খাবারের দোকানে ঢোকা হল। কফি, ফ্রেঞ্চ-ফ্রাই কেনা হল, গাড়িতে যেতে যেতে খাওয়া হবে। বৃষ্টি একটু কমলে গাড়িতে উঠতে গিয়ে আমি ভুল করে আরেক আমেরিকানের গাড়িতে উঠে পড়ি... এই নিয়ে চরম হাসাহাসি! গাড়ির আমেরিকান মালিকও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি অবস্থা। আমার কি দোষ দুটো গাড়ির রং একই রকম!

মন্দ কি কিছুক্ষণের জন্য অনেকের বিনোদনের কারণ হলাম না হয়। যথারীতি বৃষ্টির কারণে লেট। বৃষ্টির জন্য এখানেও জ্যাম। ঢাকা শহরে  বৃষ্টি হলে জ্যাম লেগে যায়, কারণ ট্রাফিক ছাতা আনতে ছুটে তখনই সবাই নিয়ম ভাঙ্গে। এখানে কি কারণ জানি না। এখানে অবশ্য কোনো ট্রাফিক নেই। তবে প্রবল বৃষ্টিটা গাড়ির ভিতর বসে থেকে বেশ এনজয় করলাম বলাই বাহুল্য। শেষ পর্যন্ত তিন ঘন্টার জার্নি পাঁচ ঘন্টায় শেষ হল, আমরা এসে পৌঁছলাম হোটেল রেডিসনে। চমৎকার হোটেল! হোটেলে ফ্রেশ টেশ হয়ে সুটকেস ইত্যাদী রেখে ছুটলাম আবার। এবার যাচ্ছি শাদমানের বাসায় নরম্যান এ। সেখানেই খাওয়া দাওয়া হবে; শাদমানের রান্না করা খাবার। ইলিশ মাছ, রুই মাছ, ডাল আর সাদা ভাত, শাদমান ভাল রাঁধে সন্দেহ নেই। 

শাদমানের দোতলা বাসায় চমৎকার একটা বারান্দা আছে। ওখানে বসে থাকলে এমনিই মন ভাল হয়ে যায়। বেশ অনেকক্ষণ বসে থাকলাম আমরা, চা খেলাম। রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে এক সময় বের হলাম শাদমানের ইউনিভার্সিটি দেখতে। বিশাল ইউনিভার্সিটি। এষারটার থেকেও অনেক বিশাল। রাতের বেলা দেখতে কোন অসুবিধে হল না। প্রথমেই গেলাম ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। এখানেই শাদমান পিএইচডি করছে। অতি সম্প্রতি সে একটা কনফারেন্সে String থিওরীর উপর একটা গুরুত্বপূর্ণ পেপার প্রেজেন্ট করেছে। তার একটা পোস্টার দেখলাম ডিপার্টমেন্টে ঝুলছে। ডিপার্টমেন্টের ভিতরে মহা মহা সব বিজ্ঞানীদের ছবি লাগানো। দুএকজনের সঙ্গে ছবি তুললাম আমরা। 

ইউনিভার্সিটির ইউনিয়ন সেন্টারে গেলাম, মানে ওদের TSC আরকি। এত রাতেও খোলা। একজায়গায় নানারকম খেলার আয়োজন। ফুসবল (পুতুল প্লেয়ার দিয়ে ফুটবল খেলা)খেললাম আমি আর শাদমান। জীবনে এই প্রথম খেলাধূলায় কাউকে হারালাম! শাদমানকে হারিয়ে মনে হচ্ছিল কার্টুনিস্ট হিসেবে জীবন শুরু না করে ফুটবলার হিসেবে জীবন শুরু করলেও হয়ত শাইন করতে পারতাম, কে জানে!      

অনেক রাত হয়ে গেছে, শাদমানের গাড়িতে আবার ছুটলাম আমাদের হোটেলে। পথে একটা রেস্টুরেন্টে নামলাম খেতে। গভীর রাত বলে শূন্য রেস্টুরেন্ট। আরেকটা আমেরিকান দম্পতিও আছে। সাথে ছোট্ট বাচ্চা খাচ্ছে। এত রাতে এত ছোট বাচ্চা নিয়ে খেতে এসেছে, অবাক করার মত ব্যাপার। শাদমান জানালো এরা একধরনের হোমলেস। এদের হয়ত বাড়ী ঘর নেই, কিন্তু গাড়ী আছে। গাড়িতেই ঘুমায় আর রাতের বেশির ভাগ সময় কাটায় এইসব রেস্টুরেন্টে খেতে বসে। খেয়াল করে দেখলাম মা’টা আমেরিকান, বাবা আফ্রিকান আমেরিকান... ছোট্ট বাচ্চাটা হই চই করে খাচ্ছে, আহা কেন জানি বড্ড মায়া হল।   

 

ফিরে গেলাম হোটেলে। সাদমান বিদায় নিয়ে চলে গেল, কাল সকালে আসবে বলে। তারপর আমরা এক সঙ্গে নাস্তা করে ঘুরতে বের হব। তখনও জানি না কি বিপদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে পরদিন!!  

পরদিন দেখি ভয়াবহ বৃষ্টি আর ঝড়! ঘুম থেকে উঠে দেখি চারিদিকে থই থই পানি। পুরা আমাদের মিরপুরের অবস্থা, কোনো গাড়ি ঢুকতে পারছে না। বেরুতেও পারছে না। কিন্তু শাদমান কিভাবে কিভাবে যেন এসে হাজির হয়েছে। তবে এখন আর বেরুনো যাবে না, পানি আরো বেড়েছে। সবচেয়ে বড় যে আঠারো চাকার গাড়ী গুলো (এই ট্রাকগুলোকে এইটটিন হুইলার বলে) সেগুলো পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে।

হোটেলের নাস্তা নয়টার সময় বন্ধ হয়ে যায়, আবার পাঁচটায় খুলবে ডিনারের জন্য। অনলাইনে খোঁজ নিয়ে জানা গেল তাদের সার্ভিস এই আকস্মিক বন্যার কারণে এখন সব বন্ধ। কি জ্বালা... তার মানে সারাদিন না খাওয়া! এমনিতে খিদে লাগেনি। কিন্তু যেই বুঝলাম খাওয়া দাওয়া পাওয়া যাবেনা সাথে সাথে পেটের ভিতর ইঁদুর কূলের নৃত্য-গীত শুরু হল যেন। তবে মনে হচ্ছে এই হোটেল এলাকার ড্রেনেজ সিস্টেমে সমস্যা আছে। আমাদের ঢাকা শহরে পানি জমলে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পানি সরে যায়। এখানে সরছে না। অনেক পরে বিকেল পাঁচটার দিকে আমরা কোন রকমে গাড়ি নিয়ে বেরুলাম, আসলে আমাদের পুরো দিনটাই মার গেল। কি আর করা! প্রথমে খাওয়া দাওয়া, তারপর একটা মার্কেটে গেলাম। এটা নাকি বিখ্যাত একটা মার্কেট, এখানে ব্র্যান্ডের জিনিষপত্র কম দামে পাওয়া যায় বলে বেশ ভিড়। ওরাও কিছু কেনাকাটা করল। 

পরে আমরা গেলাম দূরে কোথায় একটা পেন্ডিং দাওয়াতে। বাড়ির কর্তা লিথু বাংলাদেশী,  স্ত্রী ভারতীয়। দুই কন্যা। বিরাট খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। ওখানে পরিচয় হল এক ভারতীয় পেইন্টারের সঙ্গে, নাম মুকেশ প্যাটেল। তার সাথে শিল্প সাহিত্য নিয়ে জ্ঞানগর্ভ(!) আলোচনা করলাম কিছুক্ষণ। কাচকি মাছ দিয়ে ভাত খেলাম। আসলে কাচকি মাছ ছাড়াও আরো বহু আইটেম ছিল, নাম বলে শেষ করা যাবে না। লিথুর বাড়িটাও সেইরকম। পিছনে বিশাল জায়গা, সুইমিংপুল কি নেই! ঘন্টা খানেক সময় কাটিয়ে বেরুলাম আমরা আবার। এবার যাত্রা সিনেমা হলের দিকে। আজকের দিনটা আসলে বৃষ্টির কারণে কিছুই প্ল্যান মত হল না, তাই হঠাৎ এই সিনেমা দেখার সিদ্ধান্ত। বিশাল হল! অটো টিকেট কাউন্টার। টিকিট কেটে ঢুকে দেখি দর্শক শুধু আমরাই! পুরো হল খালি। সিনেমার নাম “আলাদিন”। 

পরদিন হোটেল থেকে চেক আউট করে বের হলাম। ওকলাহোমা সিটি ন্যাশনাল মেমোরিয়ালটা দেখতে। এটা এখানকার খুবই বিখ্যাত একটা জায়গা। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের আগে আমেরিকার সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞ! ৯ জন শিশু সহ ১৬৮ জন মানুষ মারা যায় ১৯৯৫ সালের এই বোম্বিংয়ে। যে আমেরিকান বোমাটা মেরেছিল সে এখনও জেল খাটছে। এখানে যে বিশাল ভবনে বোমাটা মারা হয়েছিল সেটার জায়গায় প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা চেয়ার আকৃতির স্মৃতি স্তম্ভ বানিয়ে রাখা হয়েছে (যেন ঐ চেয়ারটায় সে বসে আছে এখনো)। দেখার মত জায়গা। ট্যুরিস্টরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছবি তুলছে। একটা জায়গায় তারের বেড়ায় সবাই এটা সেটা লাগিয়ে রেখে যায় আবেগে। আমিও আমার একটা ভিজিটিং কার্ড রেখে এলাম। ওখানে মিউজিয়ামও আছে একটা, কিন্তু সময়ের কারণে দেখা সম্ভব হল না। 

তারপর গেলাম ওকলাহোমা চিড়িয়াখানায়। বিশাল আয়োজন। ট্রেন দিয়ে ঘোরা যায়, আবার হেঁটেও ঘোরা যায়, ticket ১১ ডলার। সব জায়গায় টিকিটে তিন ডলার ছাড় পাই, বয়স ৬০ এর উপরে বলে। এখানে পাওয়া গেল না। কারণ এখানে ছাড় হচ্ছে ৬৫ বছরে! এবার নিজেকে বেশ তরুণ তরুণ মনে হল। কি নেই এই চিড়িয়াখানায়, সবই আছে। বাঘ, সিংহের জায়গাটা দেখে ভয় পেলাম কারণ বিশাল বিশাল বাঘ, সিংহ কিন্তু খুবই সামান্য তারের বেড়া দিয়ে আটকানো। আমার মনে হল সিংহ যদি ছুটে এসে এই তারের বেড়ার উপর ঝাপিয়ে পরে তাহলে এই বেড়া এক মুহুর্তে ফর্দাফাই হয়ে যাবে। পরে বুঝলাম এত সোজা না। প্রত্যেক তারের বেড়ার সঙ্গে ইলেকট্রিক কানেকশন দেয়া আছে, ওরা বেরুতে চাইলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালকা শক দেয়া হবে। 

আমেরিকায় হ্যান্ডিক্যাপদের খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রত্যেক পার্কিংয়ে একটু পর পর হ্যান্ডিক্যাপদের জন্য পার্কিং। এয়ারপোর্টেও দেখেছি ওদের জন্য আলাদা চেয়ার, আলাদা ওয়াশরুম,  পরে নিউইয়র্কের সাবওয়েতেও দেখেছি ওদের জন্য আলাদা সীট। চিড়িয়াখানায় দেখলাম অনেক বাবা মা তাদের হ্যান্ডিক্যাপ শিশুদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেকে তাদের আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে। যেকোন শপিং মলের ভিতরও তাই। আমি প্রায়ই ভুল করে মাঝে মধ্যে ওদের জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসে পড়তে যাই তখন এষা আমাকে হুশিয়ার করে “ বাবা কোথায় বসছো ওটাতো হ্যান্ডিক্যাপদের চেয়ার...” তখন সাবধান হই। একবারতো এতই ক্লান্ত লাগছিল যে বসেই পড়লাম। এষা যথারীতি চেঁচিয়ে উঠল, - “বাবা কোথায় বসছ ওটাতো হ্যান্ডিক্যাপদের... !”  আমার আর উঠতে ইচ্ছে হল না, বললাম “ওদের চেয়ারগুলো কতটা মজবুত একটু চেক করছি... !” এই প্রসঙ্গে একটা রিয়েল লাইফ জোক মনে পড়ছে। আমাদের উন্মাদের জুলকরনাইন জাহাঙ্গির একবার বিদেশে কোথায় যেন যাচ্ছে। এয়ারপোর্টে তার প্রচন্ড বাথরুম পেয়েছে। কিন্তু ওয়াশ রুমে বিশাল লাইন। কি করা! হঠাৎ দেখে আরেকটা ওয়াশরুম পুরাই খালি সে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল। কিন্তু ঢুকেই বুঝতে পারল এটা হ্যান্ডিক্যাপদের জন্য। হায় হায় এখন উপায়? তখনই সে কিভাবে যেন একটা আছাড় খেল। যখন বেরুলো তখন সে রীতিমত খোড়াচ্ছে। কে বলবে সে এখন আর হ্যান্ডিক্যাপ নয়! 

এবার ফেরার পালা। ...বিদায় ওকলাহমা। শাদমানই আমাদের আবার ডালাসে নামিয়ে দিয়ে আসবে। আবার দীর্ঘ যাত্রা,  তিন ঘন্টার পথ। শেষবারের মত নরম্যানে শাদমানের দোতলা বাসার বারান্দায় চা খেয়ে আমরা রওনা হলাম। সত্যি এই বারান্দাটার কথা অনেক দিন মনে থাকবে, বারান্দার সামনের পাশাপাশি তিনটা দীর্ঘ গাছকেও, কি গাছ ছিল ওরা কে জানে!

 

লেখকঃ কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top