সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

হিপোক্রেটিসের দর্শন ও কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের অবদান : নজরুল ইসলাম


প্রকাশিত:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৯:২১

আপডেট:
১১ মে ২০২০ ২০:৩৬

 

মহান গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিসকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলা হয়, যিনি দ্বিতীয় হিপোক্রেটিস নামেও পরিচিত। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র শেখাতেন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে; তিনি জোর দিতেন ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের এবং বিভিন্ন রোগের বিভিন্ন মৌলিক তত্তে¡র ওপর। তাঁর সম্পর্কে যে উক্তিটি এখনও আমাদের অনুপ্রানিত করে তা হল, ‘তিনি একই ভুল দ্বিতীয়বার করেননি’।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস মানবেতিহাসের ন্যায় প্রাচীন। অথচ একুশ শতকে এসে আজ সেই চিকিৎসাবিদ্যা এক মহা সংকটের সম্মুখীন। বিশ্বজুড়ে এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস ডিজিজ (কোভিড-১৯)। বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ২,১৭,১৫৩ জনে দাঁড়িয়েছে; আক্রান্তের সংখ্যা ৩১,১৬,৩৯৮ (যদিও সংখ্যাটা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তন হচ্ছে)। চীনের পর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রও আজ এই জৈব-মহামারির সামনে অসহায়।

বাংলাদেশেও এপর্যন্ত ৬,৪৬২ জন আক্রান্ত হয়েছে, যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৫৫ জনের। তবে অনেকের মতে এটা প্রকৃত চিত্র নয়, প্রকৃত চিত্র আরও খারাপ। কোভিড-১৯ উপসর্গ আছে এমন রোগীদের মধ্যে টেস্ট করার হার অনেক কম; প্রতিদিন আইইডিসিআর-এ যে পরিমাণ ফোন আসে, তার মধ্যে অল্প সংখ্যক নমুনাই পরীক্ষা করা হচ্ছে। অনেকে সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রন্ত হওয়া সত্তে¡ও নমুনা পরীক্ষা করাতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে তারা হয়ত নীরব বাহক হিসেবেই থাকছেন, এবং আক্রান্তের হিসেবেও আসছেন না। অনেকে এই ধরণের উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন, যারা মৃতের হিসেবেও থাকছেন না।

তবে সম্প্রতি নমুনা পরীক্ষা সংগ্রহের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। প্রথম দিকে কোভিড-১৯ উপসর্গ আছে এমন রোগীরা শুধুমাত্র আইইডিসিআর-এ যোগাযোগ করতো। বর্তমানে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের ল্যাবরেটরি করোনা রোগী শনাক্তকরণ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে; এর মধ্যে ঢাকায় সাতটি। আতঙ্কের কথা হচ্ছে, নমুনা পরীক্ষার পরিধি বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যাও।

দেশের অনেক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা করোনাভাইরাসের কারণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ঠান্ডা-সর্দি, জ্বর-কাশির রোগীকে তাঁরা এড়িয়ে যেতে চাইছেন। সংক্রমিত নয়; কিন্তু জ্বর, সর্দি বা কাশির সমস্যায় ভুগছেন- এমন রোগীকেও চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। অনেক চিকিৎসক ব্যক্তিগত ক্লিনিক ও প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রেখেছেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকেদের ভাষ্য তাদের চিকিৎসা দিতে আপত্তি নেই, কিন্তু তাদের যথাযথ নিরাপত্তামূলক পোশাক- পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) থাকতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু আমাদের নয়, সমগ্র বিশ্বেই পিপিই স্বল্পতা রয়েছে। গত ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মোতাবেক এখন পর্যন্ত মোট ৩ লাখ ৫৭ হাজার পিপিই সংগ্রহ করা হয়েছিল। কয়েকবছর আগে দেশে বার্ড ফ্লু দেখা দিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে পিপিই পেয়েছিলাম আমরা। করোনাভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়াতে শুরু করার পর এখন স্থানীয়ভাবেই পিপিই উৎপাদন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পিপিই স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে বিতরণ করা শুরু হয়েছে। তবে স্থানীয়ভাবে পিপিই উৎপাদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন কতটা অনুসরণ করা হচ্ছে, সেটা বিবেচ্য।

বিশ্বব্যাপী এই মহামারী প্রতিরোধে যখন দেশে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই পিপিই সংকটে ছিলেন, তখন প্রথম দিকে অনেক প্রশাসনিক/ ব্যাংক কর্মকর্তারারা অহেতুক পিপিই ব্যবহার করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ১৫ মার্চ একটি নির্দেশনা প্রচার করেছিল, এবং সেখানে বলা ছিল, ‘বিশ্বব্যাপী পিপিই তথা স্বাস্থ্য সেবা দাতাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে, এবং এ পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে দেশের স্বাস্থ্য সেবাদাতাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সঠিক নিয়মে যৌক্তিকভাবে সামগ্রীসমূহ ব্যবহার করতে হবে।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালকের বক্তব্য- ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের, এমনকি আমারও পিপিই ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কারণ, আমরা সরাসরি আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে যাই না। এগুলো তাদেরই দরকার যারা আক্রান্ত রোগীকে সরাসরি সেবা দেবেন।’

করোনাভাইরাস সংক্রামণের এই সময়ে সবারই দায়িত্ব ও নিরাপত্তার ধরণ অনুযায়ী পিপিই প্রয়োজন আছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনতো রয়েছেই, আছে পুলিশ, সেনাবাহিনী, সংবাদকর্মী, মাঠ-প্রশাসন কর্মকর্তা, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক এবং আরও অনেকের। অনেক সরকারি অফিস/ ব্যাংকের তুলনায় ঔষধের দোকানে এখন ভীর বেশি হচ্ছে। তাই বলে তাদের সবারতো আর স্পেসস্যুট লেভেলের পিপিই প্রয়োজন নেই। গত ৩১ মার্চ গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যাদের প্রয়োজন নেই, তাদের পিপিই ব্যবহারের দরকার নেই। পিপিই সবার ব্যবহারের জন্য নয়। এটি ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য। অযথা এর অপব্যবহার করবেন না।’

চিকিৎসকদের প্রাইভেট ক্লিনিক ও প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রাখার বিষয়ে গত ৩ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী চিকিৎসক ও নার্সদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘মানুষের পাশে দাঁড়ান। মানুষের সেবা করেন। এটাই সময়, আমরা লক্ষ্য করছি। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পিছপা হবো না।’ এর আগেও গত ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে সব হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে চিকিৎসকদের নিশ্চিতের নির্দেশনা দেয়া হয়। আর এ নির্দেশ অমান্য করলে প্রয়োজনে লাইসেন্স বাতিলসহ আইনি ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দেয়া হয় (যদিও পরে তা বাতিল করা হয়)।

সব চিকিৎসকরাই কি ঠান্ডা-সর্দি, জ্বর-কাশির চিকিৎসা প্রদান করেন নি? আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- আকস্মিকভাবে আমি এই মাসের ২০ তারিখে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন কনসালটেন্ট-র শরণাপন্ন হই। হাসপাতালে যাওয়ার সময় আমি কিছুটা দিধাগ্রস্থ ছিলাম, যেহেতু নিউমোনিয়া এবং কোভিড-১৯ এর সিম্পটম প্রায় এক। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম অনেক রুগী, এবং সবাই এসেছে রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগে। চিকিৎসকের সামনে থাকা অবস্থায় আমি খেয়াল করে দেখেছি তিনি শুধু সাধারণ হ্যান্ড গ্লাভস ও একটি এন-৯৫ রেসপিরেটর মাস্ক পড়ে আছেন। তো, সব চিকিৎসকরাই রোগী দেখেননি- কথাটি ঠিক নয়।

আশার কথা, গত ২৬ মার্চ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চীনের পাঠানো ১০ হাজার টেস্টিং কিট ও পিপিই এবং এক হাজার ইনফ্রারেড থার্মোমিটার, এবং একদিন পর আলিবাবার সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা’র দেওয়া ৩০ হাজার টেস্টিং কিট ঢাকায় পৌঁছছে। এদিকে দেশের বেক্সিমকো গ্রুপ কোভিড-১৯ আক্রান্ত রাগীদের সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সুরক্ষায় পিপিই, ওষুধ ও টেস্টিং কিট সরবরাহে ১৫ কোটি টাকা সহায়তা করেছে। অন্যদিকে ডাক্তার ও নার্সদের জন্য ১০ হাজার পিপিই দিয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই পিপিই তৈরি ও বিতরণ করছেন।

রোগজীবাণুর সাথে মানুষের যুদ্ধ চলেছে অনাদিকাল থেকে। দিনে দিনে রোগজীবাণু শক্তিশালী হয়েছে, অন্যদিকে উপশমের নতুন পন্থাও আবিষ্কৃত হয়েছে। আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞান যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তা নিশ্চিতভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের হাত ধরেই এসেছে। আমাদের জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে মহান সৃষ্টিকর্তার পরেই রয়েছে চিকিৎকদের অবদান। গত শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারের জন্য যখন সমগ্র বিশ্বব্যাপী জরিপ করা হল, দেখা গেল হিগস-বোসন কণা, কিংবা রোবটিক্সের মতো প্রযুক্তিকে পিছনে ফেলে মানুষ এক্স-রশ্মি এবং পেনিসিলিনকে বেছে নিয়েছে।

সবাই এখন আশায় আছে, কখন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একটা ভ্যাকসিন আবিস্কার করবেন; কখন একটা এন্টিভাইরাল ড্রাগ নিয়ে উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবিভর্‚ত হবেন। পৃথীবিতে যে দুটি দেশ তাদের জিডিপি’র সবচেয়ে বেশি অংশ গবেষণায় খরচ করে, দক্ষিণ কোরিয়া তার একটি। যখন স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষায় পিপিই, গ্লাভস, মাস্ক সরবরাহ করতে গিয়ে উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে, তখন দক্ষিণ কোরিয়া এক ধরনের বুথ চালু করেছে যার ভেতরে থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা পিপিই ছাড়াই সম্ভাব্য আক্রান্তদের নমুনা সংগ্রহ করতে পারছেন। আমরা যদি শিক্ষা ও গবেষণায় জিডিপি’র সবচেয়ে বেশি অংশ ব্যয় না করে যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে অর্থ ও সময় ব্যয় করি, তাহলে প্রয়োজনের সময় কিভাবে ভ্যাকসিন বা এন্টিভাইরাল ড্রাগ দ্রুত পাবার আশা করি?

হিপোক্রেটিসের একটা দর্শন হচ্ছে, রোগীর চিকিৎসা কর, রোগের নয়। আজও চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডিগ্রি নেয়ার সময় যে শপথ পাঠ করতে হয় তা হিপোক্রেটিসের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। বিশ্বব্যাপী এই মহামারীতে যখন স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তখন আমরা যদি চিকিৎসাবিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের অবদানের কথা এড়িয়ে যাই, তাহলে সেটা অশোভন হবে। সব পেশাতেই ভুল দুইবার করার সুযোগ থাকে না, যেমন চিকিৎসাপেশায়। তবে হিপোক্রেটিস যেহেতু একই ভুল দ্বিতীয়বার করেননি, অবশ্যই তাঁর শিষ্যদেরও সেই গুণ রয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস।

নজরুল ইসলাম
কলাম লেখক, প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ; উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়
এমফিল রিসার্স ফেলো, স্কুল অব এডুকেশন, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top