সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

যে উদ্যোগ সুরক্ষিত করে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের : সালেক খোকন    


প্রকাশিত:
১৪ জুন ২০২০ ২০:৫২

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৪০

 

প্রতিদিনই বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যুও। ভাইরাসের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে প্রথমসারিতে থেকে কাজ করছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। ফলে বাড়ছে তাদের আক্রান্তের সংখ্যাও। এরই মধ্যে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন চিকিৎসক। এর বাইরে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী কোয়ারেন্টিনে আছেন ৷

এছাড়া হাসপাতালে অনেক রোগী করোনাভাইরাসের উপসর্গ বা লক্ষণের তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে আসছেন। উপসর্গ বিহীন এসে করোনা পজেটিভ হয়েছেন এমন সংখ্যাটিও কম নয়।

এসব কারণে ভয়াবহ এ রোগটি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে ৷ এতে বেশ কিছু হাসপাতালই লকডাউন করা হয়েছে৷ ফলে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চিকিৎসা না পেয়ে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর সংবাদও উঠে আসছে গণমাধ্যমে।

এ সব ঘটনা শুধু উদ্বেগজনকই নয়, বরং এটি গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছে। তাহলে কি নন- কোভিড রোগীরা বাংলাদেশে বিনা চিকিৎসাতেই মারা যাবে?

বলা হচ্ছে চিকিৎসক বাঁচলেই মানুষ বাঁচবে। কিন্তু বাস্তবে সরকার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি কি যথেষ্ঠ? মানুষকে বাঁচানোর যুদ্ধের যোদ্ধারা কি নির্ভয়ে মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পারছেন? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। তাহলে কী করা উচিত আমাদের? এ নিয়ে সারাদেশে চলছে নানা আলোচনা ও পর্যালোচনা।

কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে এই প্রশ্নগুলোরই সমাধানের খবর এলো টাঙ্গাইলের কালিহাতি থেকে। যা আমাদের আন্দোলিত করেছে প্রবলভাবে। করোনাভাইরাসের সময়েও মেধা ও উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন বেশ কিছু মানুষ। এই অসময়েও যা আমাদের আশ্বস্ত করে, ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস জোগায়।

কী ঘটেছে সেখানে?

করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ সময়টাতে সেখানকার উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আরা নিপা হাসাপাতালে দুটো উদ্ভাবনী উদ্যোগের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন। তাকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাও। ফলে বদলে গেছে কালিহাতি হাসপাতালের দৃশ্যপট।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সাধারণ রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা অক্ষুণ্ণ রাখতে তিনি সেখানে চালু করেছেন ডক্টরস সেফটি চেম্বার ও ডক্টরস সেফটি কার্ট নামক দুটি বিশেষ উদ্যোগের।

উদ্যোগ দুটি নিয়ে আলোচনার পূর্বে সরকারি হাসপাতালে আউটডোরে চিকিৎসা সেবা গ্রহণের প্রক্রিয়াটি জেনে নেয়া প্রয়োজন।

সাধারণ নিয়মে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে রোগীকে চিকিৎসা নিতে হলে প্রথমে একটি কাউন্টার থেকে সেবা গ্রহণের টিকেট কাটতে হয়। এই টিকেট নিয়ে ডাক্তারকে দেখালে ডাক্তার রোগী দেখে টিকিটের গায়ে লিখে প্রেসক্রিপশন করেন। ওই প্রেসক্রিপশন ফার্মেসি বিভাগে দেখালে রোগীর ওষুধ সরবরাহ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় যে কোনো রোগীকে টিকেট কাউন্টার, ডাক্তারের চেম্বার ও  ফার্মেসি- এই তিনটি বিভাগে যেতে হয়। ফলে কোন রোগীর ভাইরাস থাকলে তার সংস্পর্শে এসে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের শরীরেও ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায়।

মূলত এই ঝুঁকি এড়াতেই কালিহাতি হাসপাতালে সেবাদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত টিকেট দাতা, চিকিৎসক এবং ফার্মাসিস্টকে চারকক্ষ বিশিষ্ট একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেফটি চেম্বারের মধ্যে রেখে সেবা প্রদানের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ডক্টরস সেফটি চেম্বার।

যেখানে প্রথম চেম্বার থেকে রোগী তথ্য দিয়ে টিকেট করলে তার নম্বরটি রোগীকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ওই টিকিট সেফটি চেম্বারের মধ্যে থাকা ডাক্তারকে (দুজন) দেওয়া হয়। ডাক্তার চেম্বারের ভেতরে থেকেই গ্লাসে লাগানো বিশেষ গ্লাভসের সাহায্যে স্টেথোস্কোপের মাধ্যমে রোগীকে পরীক্ষা, ডিজিটাল থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে তাপমাত্রা পরিমাপ, ডিজিটাল পালস অক্সিমিটারের মাধ্যমে রোগীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা এবং পালস পরিমাপ করেন। রোগীর সঙ্গে ডাক্তার কথাও বলেন ভিতরে ও বাইরে লাগানো মাইক্রোফোনের মাধ্যমে।

এরপর ডাক্তার রোগীর জন্য প্রেসক্রিপশন লিখেন কম্পিউটারে। যার প্রিন্ট বের হয় চেম্বারের ভেতরে থাকা ফার্মাসিস্টের কাছে। তিনি রোগীর কাছ থেকে টিকেট নম্বরটি জেনে প্রিন্টেড প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তাকে ওষুধ সরবরাহ করেন। সঙ্গে তার প্রেসক্রিপশনটিও দিয়ে দেওয়া হয়।

এই প্রক্রিয়ায় হাসপাতালের ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীরা যেমন করোনাভাইরাস সংক্রমণে ঝুঁকিমুক্ত থেকে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন, তেমনি বর্তমান পরিস্থিতে রোগীদেরও ভোগান্তিবিহীন চিকিৎসা সেবাও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।

ডক্টরস সেফটি চেম্বার চালুর অন্তরালের গদ্যটি শুনি ইউএনও শামীম আরা নিপার মুখেই। তার ভাষায়-

কালিহাতি উপজেলায় প্রথম যে ব্যক্তির করোনাভাইরাস পজিটিভ হয় তার হিস্ট্রি নিয়ে জানা গেল তিনি আগের দিনই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে সেবা নিয়েছিলেন। ফলে ওই রোগীর সংস্পর্শে আসা ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীদের কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয় এবং তার মধ্যে একজন স্বাস্থ্যকর্মীর করোনা পজিটিভও আসে।

ডাক্তারদের কোয়ারেন্টিনে রাখাকালীন হাসাপাতালে সাধারণ রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দারুণভাবে বিঘ্নিত হতে থাকে। ঠিক তখনই সাধারণ রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার স্বার্থে হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে ভাবনা আসে। ডাক্তাররা সুস্থ না থাকলে রোগীরাও সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই ‘ডক্টরস সেফটি চেম্বার’ চালু করেছি। এই চেম্বারে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সম্পৃর্ণরূপে প্রেটেকটেট। ভাবনার মূল বিষয়ই ছিল রোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে ডাক্তারদের সুস্থ রাখা।’

নিপা এর পরই মনোযোগ দেন করোনা ওয়ার্ডে ডাক্তারদের সেফটি নিশ্চিত করার বিষয়টির ওপর। উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে হাসপাতালে ‘ডক্টরস সেফটি কার্ট’-ও তৈরি করে দিয়েছেন তিনি।

সেফটি কার্টটি আসলে কেমন?

মূলত এটি ব্যাটারিচালিত একটি ছোট্ট এয়ারপ্রুফ গাড়ি। যা অনায়াসেই হাসপাতালের ওয়ার্ডে চালানো যায়। গাড়ির ভেতরে থেকেই ডিজিটাল থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে রোগীর তাপমাত্রা মাপা, স্টেথোস্কোপের মাধ্যমে রোগীকে পরীক্ষা করা এবং গাড়ির সাথে সংযুক্ত ডিজিটাল পালস অক্সিমিটারের সাহায্যে রোগীর শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা এবং পালস মাপাও সম্ভব হচ্ছে। রোগীর সঙ্গে কথোপকথনের জন্য কার্টের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে মাইক্রোফোন। ফলে সেফটি কার্টের মধ্যে বসেই রোগীর বিষয়ে ডাক্তার প্রয়োজনীয় নোট নিতে পারছেন।

হাসপাতালের করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে ডাক্তাররা নিয়মিত রাউন্ডে আসেন না। আসলেও অনেক দূর থেকে তারা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে চলে যান। যা রোগীদের মনে আরও ভীতি সৃষ্টি করছে। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতেই ‘ডক্টরস সেফটি কার্ট’ চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানান এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ‘সঠিক চিকিৎসা ও রোগীদের মনোবল বাড়াতে করোনাভাইরাস ওয়ার্ডে ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। কিন্তু করোনাভাইরাস অত্যাধিক সংক্রামক ভাইরাস হওয়ায় অনেক ডাক্তারদের মনেই পিপিই এর সুরক্ষামান নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া  পিপিই পরে বেশিক্ষণ ডিউটি করাও তাদের জন্য কষ্টকর। ফলে নিজেদের সুরক্ষা অনিশ্চিত রেখে অনেক ডাক্তারই করোনা ওয়ার্ডে যেতে আগ্রহী হন না। এই সমস্যার সমাধানের চিন্তা থেকেই ডক্টরস সেফটি কার্ট নির্মাণের উদ্যোগ নিই। মূলত মাশরাফি বিন মর্তুজার নড়াইলে নির্মিত ‘ডক্টরস সেফটি চেম্বার’টি প্রভাবিত করেছে। ওটাকে মাথায় রেখে চেম্বার বা বুথকে মুভ করিয়ে সেবা নিশ্চিত করার চিন্তা আসে তখন।’

বাস্তবায়ন কি খুব সহজ ছিল?

শামীম আরা নিপার ভাষায়- “না। কিছুটা কঠিন। নানা উদ্যোগী মানুষ পাশে ছিলেন। আমার হাজবেন্ড ডাঃ মোঃ শাহ আলম ঢাকা মেডিকেল কলেজে কর্মরত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ কাজে লেগেছে। কিন্তু হাসপাতালের ওয়ার্ডে চলাচলের মতো ছোট্ট গাড়ি বানানোর কাজটি সহজ ছিল না।”

“আইডিয়া ও রিকোয়ারমেন্ট জানাতেই প্রবাসে অবস্থানরত সহকর্মী ও উদ্যোগী অফিসার মুহাম্মাদ তালুত শুধু উৎসাহই দিলেন না, দ্রুত একটি ছোট্ট কার্টের ডিজাইন স্কেচ করে পাঠিয়ে দেন। বুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশুনা করেছেন তিনি।”

“কিন্তু কাজ করতে গিয়ে পরবর্তীতে চিত্রশিল্পী ওয়াল্টার মালিনোর বিখ্যাত ‘সিঙ্গেল’ চিত্রকর্মটি দেখে কার্টের ডিজাইনে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতো ছোট কার্টের কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকও প্রথমে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন পাশে পাই কলেজ পড়ুয়া তরুণ আল আমিন ও তার টিমকে। ডিজাইন দেখে স্থানীয় ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা মেরামত ও নির্মাণ শ্রমিকদের মাধ্যমে তৈরি করা হয় কার্টটি। বিভিন্ন ওয়ার্কশপে বিচ্ছিন্নভাবে কাজগুলো করাতে হয়েছে। একটি কার্ট তৈরিতে খরচ হয়েছে দেড়লাখ টাকার মতো। তবে বুয়েট বা প্রফেশনাল হ্যান্ডসকে ইনভলভ করা গেলে নিশ্চিতভাবে এটি আরও চমৎকার হবে। ডক্টরস সেফটি কার্ট তৈরিতে বিভিন্ন স্তরে যারা সহযোগিতা করেছেন আমি মনে করি এই সফলতা তাদের সকলেরই। এমন উদ্যোগ জেলা ও উপজেলার হাসাপাতালগুলোতে সহজেই চালু করা সম্ভব। বিশেষ করে ঢাকায় করোনা হাসাপাতালগুলোকে দ্রুত ডক্টরস সেফটি কার্ট চালু করা উচিত। তাহলে ডাক্তাররা  সুরক্ষিত থেকে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পারবেন।’

আমরা আশ্বস্ত হই এই ভেবে যে, ভাল কাজের উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের পরিবেশ এদেশে এখনও আছে। সবকিছু নষ্টদের দখলে বা সব মানুষই নষ্ট হয়ে যায়নি। পেশাগত কাজের বাইরে গিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু উদ্যোগী মানুষের উদ্ভাবনী আইডিয়াগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।

এই দুর্যোগে নিজের সুবিধা বা পরিচিতি নয়, ইউএনও শামীম আরা নিপার মতো মানুষেরা চান নতুন উদ্যোগগুলো সারাদেশে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র লাখো মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করুক। আমরাও আশা করি, করোনায় ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষিত রেখে মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণে এ উদ্যোগ সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।

 

সালেক খোকন
লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top