সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

করোনা চিকিৎসায় স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন দরকার : ওসমান গনি


প্রকাশিত:
২১ জুন ২০২০ ২১:১০

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৯:৫৭

ওসমান গনি

 

দেশে করোনা পরিস্থিতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে সাথে মৃত্যুর সংখ্যা ও বাড়ছে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর বেশীর ভাগই মারা যাচ্ছে চিকিৎসার অভাবে। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার পর্যাপ্ত পরিমান সুব্যবস্থা না থাকার কারনে করোনা পরিস্থিতিতে সামনের দিকে আমাদের পরিস্থিতি কি হতে পারে বলা বড় মুশকিল। বর্তমানে যে পরিমান রোগী আক্রান্ত তা সামাল দিতে সরকার কে হিমশিম খেতে হচ্ছে।  আর পরিস্থিতি যদি আরও ভয়াবহ হয় তখন আমাদের কি হবে? তাই এখনও সময় আছে আগ থেকে স্বাস্থ্যখাত কে দ্রুত গতিতে ঢেলে সাজান। দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে তড়িৎ ব্যবস্থা নিন। দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে, এই করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশের এমন কিছু লোক চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে যাদের কে দেশের বুদ্ধিজীবি পর্যায়ের লোক হিসাবে মানুস জানে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে গত এক সপ্তাহে সর্বেচ্চসংখ্যক নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, এমন শীর্ষ ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ এবং আক্রান্তের সংখ্যায় শীর্ষ ২০ দেশের মধ্যে ১৯ তম। এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে, দেশে করোনা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। শুরু থেকেই করোনা প্রতিরোধে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার কথা শোনা গেলেও করোনামোকাবিলায় তা অপর্যাপ্তই রয়ে গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়া, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিদারুণ অবহেলার চিত্রের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে অনেক রোগীর মৃত্যুবরণের মর্মভেদী চিত্র প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৭টিতেই আইসিইউ ব্যবস্থা নেই। অথচ যেকোনো হাসপাতালে জটিল রোগীর জন্য আইসিইউ থাকা অপরিহার্য। জেলা পর্যায়ের প্রায় অর্ধেক হাসপাতালে এই গুরুত্বপূর্ণ সেবাটি না থাকা অত্যন্ত দুঃখজনক।

আইসিইউবিহীন হাসপাতালকে ফুসফুসবিহীন মানুষের সাথে তুলনা করা যায়। হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নেই আইসিইউ থাকার বিষয়টি অত্যন্ত সাধারণ একটি বিষয়। অথচ দেশের প্রায় অর্ধেক হাসপাতালে এ ব্যবস্থা নেই। এ না থাকার মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কতটা দুর্বল তা প্রকাশিত হয়েছে। করোনা হানা না দিলে হয়তো এ চিত্র কোনো দিনই প্রকাশিত হতো না। এতদিন এ ধরনের রোগের প্রার্দুভাব দেখা না দেয়ায় আইসিইউ’র খুব একটা প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। তবে যে কোনো মুহূর্তে যে এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য, এ বাস্তবতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, জেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা বরাবরই উপেক্ষিত। বাধ্য হয়ে, গ্রাম-গঞ্জের অনেক মানুষকে উন্নত চিকিৎসার আশায় রাজধানীমুখী হতে দেখা যায়। চিকিৎসার জন্য গ্রামের মানুষগুলো ঢাকাতে আসলেও চিকিৎসার জন্য তেমন কোন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না। তার কারন ঢাকাতে বর্তমানে যে পরিমান লোকের বসবাস সেখানে তারাই তো চিকিৎসাসেবা পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঢাকাতে যে সমস্ত লোকজন বসবাস করে তাদের মধ্যে যারা প্রতাপশালী ও ধন্যাঢ্য ব্যক্তি তারা হয়তো কিছু লোক হাসপাতালে চিকিৎসা করার সুযোগ পাচ্ছে। আর অন্যান্য সাধারণ মানুষগুলো এখন নয় তারা আগেও তেমন কোন চিকিৎসাসেবা পেত না। অর্থ, শারীরিক দুর্বলতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি না থাকার কারনে এই অসহায় শ্রেনিপেশার মানুষগুলো চিকিৎসা কেন্দ্রের পাশে ঘেঁষতে ই পারত না। এটাই হলো সঠিক কথা। সেটা কেউ মানুক আর না মানুক। এটার জন্য সরকারের উপর দোষ চাপাইতে চাই। এটার জন্য নিজেরা দায়ী। আমাদের স্বভাব চরিত্র ঠিক না থাকার কারনে এমন হয়। চিকিৎসা কেন্দ্রে গেলে ডাক্তারের ওপর ঠেলা না পড়লে তারাও নিরীহ রোগীর কাছে যেতে চান না। যদিও কোন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে তাহলে তাকে পড়ে থাকতে হয় ফ্লোরে বা বারান্দায়। সেখানে মশামাছির কামড় খেয়ে আরো বেশী অসুস্থ্য হয়ে বিনা চিকিৎসায় শেষ পর্যন্ত মারা যায়। এটা হলো সরকারী হাসপাতালে গরীব লোকদের বাস্তব চিত্র।  এই করোনাকালে তো এর অবস্থা অনেকাংশে আরও বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন মানুষের সাধারণ জ্বর সর্দি আসলে করোনার ভয়ে কোন চিকিৎসক ই রোগী দেখতে চান না। যেসমস্ত রোগীর পেশীশক্তি আছে তারাই হয়তো ডাক্তার দেখাতে সক্ষম হন। এখন করোনার সময়ে রাজধানীর চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বানিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরও শোচনীয়। সেখানের হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে অনেক করোনা রোগী মৃত্যুবরণ করছে। লন্ডনী শহরখ্যাত সিলেটেও স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবস্থা একই। দেখা যাচ্ছে, এসব জেলায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হচ্ছে। এমনিতেই ঢাকার হাসপাতালগুলোতে করোনার পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। অসুস্থ অনেক রোগীকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। বিনা চিকিৎসায় অনেককে রাস্তায়ই মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। একদিকে হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সদের অবহেলার অভিযোগ, অন্যদিকে ক্রিটিক্যাল রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত আইসিইউ, ভেন্টিলেশন সিস্টেমের অভাব, তাদের ধুঁকেধুঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্যখাতে প্রতিবছরই হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই অর্থ কোথায়, কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, তার কোনো হদিস থাকে না। এ খাতে জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই। সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতির কথা বলা হলেও, তার চিত্র কতটা বেহাল, তা করোনার সংক্রমণ না হলে অজানাই থেকে যেত। সাম্প্রতিক সময়ে এ খাতে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির চিত্র বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম স্বাস্থ্যখাত নিয়ে এমন তুঘলোকি কান্ড বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। 

প্রতি বছর স্বাস্থ্যখাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও এ খাতের উন্নতি যে তিমিরেই পড়ে আছে, তা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। অনেক মানুষ উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার আশায় পার্শ্ববর্তী দেশে কেন ছুটে যায়, তা করোনাকালে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থার দৈন্যদশা বলে দিচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার হলে এতদিনে এ খাতটি যথেষ্ট উন্নতি লাভ করত। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। প্রতিটি জেলা-উপজেলার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসাসেবার বেসিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ, ভেন্টিলেশন সিস্টেম থেকে শুরু করে একজন রোগীর চিকিৎসায় যা প্রয়োজন, তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থাপন ও সচল করতে হবে। এ খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি বছর বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে যে পরিমান টাকা বরাদ্দ দেয়া সে টাকা যদি পুরোপুরি দেশের স্বাস্থ্যখাতে কাজে লাগানো যেত তাহলে মনে হয় সারাবিশ্বের ন্যায় উন্নত চিকিৎসা আমাদের দেশেও সম্ভব হয়। আমরা পারি না কেন?  না পারার কারন একটাই সেটা হলো আমাদের দেশে কাজের জবাবদিহি নাই। যদি জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকত তাহলে এমন হতো না। যে ঠিকাদারের মাধ্যমে হাসপাতালের কাজ করতে দেয়া হয় সেখানে দেখা গেছে তাকে বিভিন্ন জায়গায় অর্থ দিয়ে কাজ করতে হয়। যার কারনে বরাদ্দকৃত টাকার শতভাগ কাজ হচ্ছে না। সেটা কেউ তদারকি ও করছে না। আর কেউ তদারকি করতে যাওয়া মানে সেখান থেকে উৎকোচ গ্রহন করা। কাজ কেমন হলো সেটা দেখা তার মূখ্য বিষয় না।

 

ওসমান গনি
সাংবাদিক ও কলামিস্ট



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top