সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিজ ফসলের দাম কম, নতুন প্রজন্ম  কৃষিকাজে আগ্রহ হারাচ্ছে : আরিফুল ইসলাম সাহাজি


প্রকাশিত:
২ জুলাই ২০২০ ২১:০৭

আপডেট:
২ জুলাই ২০২০ ২১:১৬

 

গ্রামীণ সমাজের মানুষ হওয়ার অভিজ্ঞান থেকেই 'ভারতবর্ষ 'কে খুব ভালো করে চিনতে শিখেছি। যাঁরা শুধুমাত্র শহুরে রাস্তার আলোক ঝলকানিকে দেশ বোঝেন, তাঁরা ভারতবর্ষের আসল রুপ দেখেননি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে  না। গ্রামের মাঠ ঘাট, নদী নালা, পশুপাখির ঐক্যতান ব্যতীত দেশের আসল রুপ কখনই ভাস্বর হতে পারে না, এ কথা জোর দিয়ে বলতে গবেষণার ছাত্র হওয়ার দরকার নেই । গ্রামীণ ভারতের কথা বলতে গেলেই মাঠভরা সবুজের ছয়লাপ ধানজমি, সরষে খেতের  হলুদ ফুল বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে নত মস্তক হওয়া, দুই মানুষ সমান পাটখেতের  মধ্যে লুকোচুরি খেলবার আস্বাদ, রহিম চাচার পান্তাভাত থেকে শুকনো লঙ্কা নিয়ে সোনা বাগদীর পান্তা খাওয়া। একটি দেশের মধ্যে এ যেন আলাদা আরও একটা স্বদেশ, এখানে আলোর ঝলকানি নেই, আছে কৃষক বাবার মাটি মাখা বুকে সন্তানকে জড়িয়ে ধরার ঈশ্বরিক প্রশান্তি। 

গ্রামীণ সমাজের এই প্রশান্তময় চিত্ররুপের আদলগত কিছুটা বদল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নব্যপ্রজন্ম যাঁরা কৃষক বাবার প্রতিনিধি হিসাবে উত্তরাধিকার বহন করার তাগিদে হালের বলদ নিয়ে ছুটবেন মাঠে, সেই নতুন প্রজন্মের যুবকদের মধ্যে কিন্তু পিতার পেশায় আসবার কোনরকম কৌতুহল দেখা যাচ্ছে না। কৃষক পরিবারের নব যুবকগণ কোন স্বাধীন ব্যবসা, চাকরি সরকারি কিম্বা বেসরকারি যায়হোক, আবার এগুলো সম্ভব না হলে সেলাই বা অনন্য ক্ষেত্রের শ্রমের সঙ্গে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে নিচ্ছেন। এইরুপ অবস্থার নেপথ্যের কারণের গভীরে তলিয়ে যাওয়ার পূর্বে বিষয়খানি ঋজু করে পরিবেশন করা প্রয়োজন। আমার বাবা একজন কৃষক, আমি কৃষক পরিবারের সন্তান, এই পরিচয়টা আমার কাছে অত্যন্ত গর্বের, অহংকারের। শিক্ষকতা, চিকিৎসা পেশার মতোই কৃষিকাজ একটি পবিত্রতম পেশা। এই দেশ গঠনে আমার বাবার মতো কোটি কোটি কৃষক বাবা প্রতিমূহূর্ত অবদান রাখছেন। জটিলতা বাড়ানো ঠিক হবে না, মূল বিষয়ে আসি। বাবা পিতার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দশ বারো বিঘা জমি চাষ আবাদ করতেন। কৃষিজমির অঙ্কের দিক থেকে দেখলে জমির পরিমাণ অনেকটা দেখালেও আমাদের সংসার স্বচ্ছল ছিল না কখনই। খাওয়া ও পোশাকের ব্যাপারটা কোন রকমে মিটলেও পড়াশুনার খরচ চালাতে বাবাকে হোঁচট খেতে হতো। মনে পড়ে একবার, (তখন বেশ ছোট আমি) দাদার পরীক্ষার ফি দেওয়া হয়নি। ফি না দিলে পরীক্ষা দেওয়া হবে না, ফি তো মকুব হওয়ারও প্রশ্ন নেই। বাইরে থেকে গ্রামের মধ্যে বেশ বড়লোক আমরা। মা ব্যঙ্গ করে প্রায় বলতেন, নামে তাল পুকুর, ঘটি ডোবে  না। যায়হোক, বাবার কাছে নেই একটাও ফুটো  কড়ি। আমার এক কাকা, একটি স্কুলের শিক্ষক, মা হাত পাতলেন তাঁর কাছে। কিছুটা অপমানই তিনি করেছিলেন মাকে। বাইরে থেকে ধার করাও ভালো দেখায় না, আমাদের বাড়ির পাশে একজন বিত্তবান মানুষ ছিলেন, রাতের অন্ধকারে হাতে পায়ে ধরে টাকা এনে মা দাদার পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। মায়ের একটাই মাত্র কানের রিং ছিল, আমাদের পরীক্ষার ফি দেওয়ার জন্য প্রতিবারই সেটা বন্ধক দিতে হতো । 

ছোটবেলা থেকেই খুব কাছ থেকে কৃষকদের দুঃখ অভাব দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছি। ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অনুভব তৈরি হয়েছিল, কৃষক বাবার সন্তান হলেও চাষা হবো না। আমার মা'ও কখনও চাননি তাঁর সন্তানরা কৃষক হয়ে তাঁর ও বাবার মতো কষ্ট পাক। বলে রাখা দরকার, কৃষক হতে না চাইলেও ওই পেশা এবং পেশার মানুষদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু শ্রদ্ধা সম্ভ্রম এসব দিয়ে তো পেট চলে না ।  আমরা দুই ভাই, কেউই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত নয় আজ। দাদা স্বাধীন ব্যবসায় এবং আমি শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বরন করেছি। 

বিশ্বাস করুন, কৃষক সমাজ ভালো নেই আজ। কোন রকম উদরপূর্তিটুকুই হয়। একটা মারাত্মক রোগে পড়লে হাটে মাঠে চাঁদাই ভরসা। অথচ অনেক জমির মালিক হয়ত তিনি। জমি জায়গা  নিয়ে করবেন টা কী ? ভাতে দিয়ে খাবেন ? সারা বছর উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলান কৃষক, কতটুকু দাম পান তাঁরা ! এই যে পেঁয়াজের দাম এখন আকাশচুম্বী, কৃষকের পেয়াঁজ যখন ওঠে ঘরে তখন কত টাকা দাম থাকে, সেটা সকলেই জানেন - দুটাকা - আড়াই টাকা। বিঘা বিঘা চাষ করেন, অথচ দাম পান না। অনেক কৃষককে দেখেছি, উপড়ান না। গরীবগুর্বারা বস্তা বস্তা নিয়ে যান। আলু সাধারণত সারা বছরই আমাদের চড়া দামে কিনে খেতে হয়, অথচ যখনই কৃষকের আলু ওঠে তখন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় আলুর দাম। অনেক কৃষককে মহাজন, গ্রামের দিকে যাদের বলা হয় সুদখোর। এই সুদখোরদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে আলু চাষ করেন, কেন যে করেন ? এই বিষয়টা মাথায় আসা কঠিন, কেননা আলুর দাম কোন বছরেই আশানুরুপ থাকে না, বাবা একটি কথা বলেন প্রায়, চাষা মরে আশায়। কথাটি মিথ্যা নয় একেবারেই। আরও একটি চাষের কথা বলতে হয়, পাট চাষ। একটা সময় পাট ছিল গ্রামীণ কৃষক সমাজের প্রধানতম অর্থকরী ফসল। এককালীন একটা ভালো টাকা পেতেন কৃষকগণ। তবে সে সব এখন অতীত। কৃষক বাবার ছেলে তো, আসুন পাট চাষের লাভের হিসাব দিই, এক বিঘা পাট কাটতে শ্রমিকরা নেয় ছয় হাজার টাকা, পাট ধুতে দুই হাজার টাকার মত খরচ হয়। এই এক বিঘা জমির পাট বিক্রি করলে যদি খুব ভালো পাট হয়, তাহলে  দশ হাজার টাকার মত কৃষক হাতে পেতে পারেন। পাট খারাপ হলে অনেকেই পাট কাটেন না। তিনি জানেন লাভ তো হবে না  বরং গাঁটের কড়ি যাবে কতগুলো। ধান চাষের গল্পটাও একই। নিজে কাটা, সিদ্ধ করে ভাঙাতে পারলে অল্প কিছু লভ্যাংশ থাকে। এই কম লভ্যাংশের জন্য সরিষা, মূসূর, ধনিয়া, তিল প্রভৃতি একাধিক কৃষিজ দ্রব্যের চাষ প্রায় আর দেখায় যায় না। 

আমাদের দেশে কৃষকরা কোন কালেই ভালো ছিলেন না। আত্মহনন, অভাব, অশান্তি কৃষক নামটির পাশেই লেপ্টে ছিল চিরকাল। কৃষিজ ফসলের দাম কোন কালেই আশানুরুপ ছিল না। কৃষিজ ফসলের দাম না থাকলেও ক্রেতাকে  উচ্চহারেই কিনতে হয় । মাঝখানের মধ্যস্বত্বভোগীগণই খান লাভের সবটুকু গুড়। উৎপাদিত ফসলের দাম না থাকায়, কৃষক পরিবারের অর্থভান্ডার সব সময় অর্ধপূর্ণ হয়েই থাকে। অথচ অন্যান্য দ্রব্যদির দাম আকাশছোঁয়া, মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। ফলে কৃষক পরিবারে হেঁচকীটান লেগে থাকে সারা বছর। নব প্রজন্মের কৃষিজ জমিমুখী না হওয়ার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। তাঁরা সরাসরিই বলছেন, হবে টা কী চাষ করে? সারা বছর তো হাঁড়িতে বিরাজ করবেন মা ভবানী। মিথ্যা নয়, তাঁদের এই আক্ষেপ। দূর থেকে তাঁদের এই আক্ষেপ অনুধাবন করাও বোধহয় কঠিন। যাঁরা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত, কৃষক পরিবারের সঙ্গে যুক্ত তাঁরাই একমাত্র বুঝবেন কৃষকদের যন্ত্রণা। আসলে সব কিছু এই দামের বাজারে, কৃষকের ফসলই একমাত্র কমদামি। নব প্রজন্ম তাই কৃষিকাজে আগ্রহ হারালে তাঁদের দোষ দেওয়া খুব একটা যুক্তিযুক্ত ব্যাপার নয়। অবস্থার উন্নতি না হলে আগামী দিন কৃষি সংকটের মুখে পড়তে হবে, একথা বলতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই । 

 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top