সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

বিসিএস মোহ ও দুর্ভাগ্যে যাতনা : অনজন কুমার রায়


প্রকাশিত:
২০ জুলাই ২০২০ ২১:৫৪

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৩৫

 

স্বপ্ন বুননই যাদের লক্ষ্য তারা তো স্বপ্নেই বিভোর থাকবে। প্রিয় বিদ্যাপীঠের গণ্ডি পার হয়ে যখন চাকরির ক্ষেত্রে প্রবেশ করবে তখন তাদেরকে এক অন্তহীন মাঠের মাঝে হেঁটে যেতে হয়। তখনই তারা বেছে নেয় তাদের সফল ক্যারিয়ারের সুন্দরতম দিকটি। সেখানে চলে আসে বিসিএসের নামটিও। তাই তারা প্রাণপণে পরিশ্রম করে এক মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ থেকে বিসিএস (BCS) সীমানার তীরে আসে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডারকেই নিশ্চিত করে চাকরির নিশ্চয়তা রক্ষা করতে চায়। প্রাণপণ চেষ্টায় ব্রতী হয়ে সেটাকে লাভের চেষ্টা করে। কেউ একশত ভাগ সফল হয়, কেউবা বিফল মনোরথ নিয়ে ফিরে আসে। প্রসঙ্গক্রমে আমরা ব্যক্তির সাফল্যের মনোরথকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। যারা সামনের সারিতে আসে তাদেরকে নিয়ে গর্ববোধ করি। তাদেরকে অতি মেধাবীর কাতারে নিয়ে আসি।

অন্যদিকে যারা বিফল মনোরথে ফিরে আসে তাদেরকে আমরা মেধাবীর অন্তরায় নিমিষেই গণনা করতে কুন্ঠিতবোধ করি না। ফলে তারা নিজেরা অনেকটা যেন শাপমোচনের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে খান্ডব দাহনের মাঝে নিজেদের নিমজ্জিত রাখে। আমরা তাদের কথা কতজনই জানি, কতজনই বা তাদের খোঁজ রাখার চেষ্টা করি। আমরা সবাই স্পর্শিত আলোর বিভাবরীকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি যেখানে আলো টিকরিয়ে সোনালী আভা বেরিয়ে আসে। ফলে; তাদের জীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। কেউ দেখতে পায় না পিছনে পড়ার কাহিনী। শুনতে পায় না তাদের জীবন বাঁকের উপকথাগুলো। কেউ ঠাঁই দিতে চায় না সমাজে পড়ে থাকা পিছনের মানুষগুলোকে। ধন্য করে বেড়াই প্রতিষ্ঠিত মানুষের সম্মানে। এক সময় যারা স্বপ্ন দেখতো তাদের এখন স্বপ্ন বিক্রি করতে দেখি।

কেউ হয়তো দারিদ্রের মাঝে বেড়ে উঠে ক্যাডার হয়েছে, কেউবা মেধাবীর কাতারে থেকে এসে বিসিএসে চূড়ান্ত পর্যায়ে সাফল্য পেয়েছে। আবার কারো জীবনে হার না মানা কাহিনী নিয়ে এসে জয়ী হয়েছে। তারা সকলেই মেধাবী বলে আমরা এতশত ভাগ বিশ্বাস করি।

আমাদের দেশে কোন চাকরিকে কিভাবে আমরা মূল্যায়ন করবো তার কারণ ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন হয়। আমার এক প্রাণবন্ত বন্ধুকে বিসিএসের ভাইভা বোর্ডে প্রশ্ন করা হয়, তুমি ক্যাডারের পছন্দক্রমের বাছাইয়ে সর্বপ্রথমে এই ক্যাডারটি (ক্যাডারের নামটি উল্লেখ করলাম না) পছন্দ করলে কেন? উত্তরদাতা এক পর্যায়ে গ্যাড়াকলে পড়ে বলে ফেলল, এই ক্যাডারে আসলে সামাজিক মর্যাদাবৃদ্ধিসহ শক্তিপ্রয়োগ (Power) করা যায়! ফলশ্রুতিতে; ভাইভায় ফেল।

বেচারা অনেক বড় আশা নিয়ে ভাইভায় গিয়েছিল। হয়তো সমাজের রন্ধ্রে থেকে শক্তিপ্রয়োগ (Power) শব্দটি তাকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল কিংবা আশান্বিত করেছিল। আমাদের সমাজে যারা অন্ধশ্লাঘা লোক তারা হয়তো এসব মনোভাব পোষণ করে বলেই আমরা এখনো সেই শক্তি তত্ত্বের নান্দনিকতায় নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাই। সেজন্য হয়তো শক্তি প্রদর্শনের মতো শব্দটি তার মাথায় বিঁধেছিল। তাই, সমাজ ব্যবস্থার প্রায়োগিক দিক বিবেচনায় না নিয়ে চাকরি জীবনে উচ্চাবিলাসী মানব মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আস্তে আস্তে লক্ষ্যটুকু থিঁতো হয়ে সমাজের জৌলুুস বসনে নিজেকে স্থায়ীরুপ দিতে চায়।  যাদের ইচ্ছে ছিল দেশ সেবার তারাই আজ দেশ শাসণ করার স্বপ্নে বিভোর।

আবার, যে কারো যে উদ্দেশ্যই নিহিত থাক না কেন, সামাজিক স্তরে এসে মানব সেবায় নিয়োজিত থেকে ব্রতী হতে পারবে সে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে ভাইভায় উত্তীর্ণ হয়। মহৎ পেশা হিসেবে মেনে নিয়ে নির্মোহতা চাকরির ক্ষেত্রে কাজ করে। বস্তুত: সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে উন্মোচন করার চেষ্টা করে।

ভবিতব্য বিষয়ে আমরা এটাকেই মেনে নেই। পরিবেশটাই এভাবে গড়ে তুলি। বিসিএস নিয়ে মাতামাতি। তারুণ্যে ভরপুর শিক্ষাজীবনের সুন্দরতম সোনালী অধ্যায়টুকু শেষ করে জীবনযুদ্ধে উৎসারিত হবার নিমিত্তে অগাধ বই-পুঁথি নিয়ে বসে পড়ে। যার যার মেধার বিকাশ ঘটিয়ে চাকরি পেতে চেষ্টায় রত হয়। একইভাবে বিসিএস পরীক্ষায় মেধার বিকাশ ঘটাতে পারঙ্গম ব্যক্তিরাই তাদের যোগ্যতাটুকু দেখাতে সক্ষম।

প্রিলিমিনারী পরীক্ষাতে দুইশত নাম্বার উতরিয়ে কয়েক লক্ষ প্রার্থীর মাঝে টিকে থাকা অনেক দু:সাধ্যের ব্যাপার বলা চলে। তারপর নয়শত মার্কসের রিটেনের মতো কঠিন পরীক্ষার বেসাতি! সেটা কঠিন এজন্যই বললাম, ধৈর্য্যই এখানে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। তার উপর নয়শত নম্বরের বিভাজনে আলাদাভাবে ওই সবগুলো বিষয়ে সম্যক ধারণা নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে হয়। এ তো শুধু জেনারেল বা প্রফেশনাল ক্যাডারদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু উভয় ক্যাডার হলে ১১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা। মনে হয় সে এক কঠিন সময়ের আবর্তনে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখে কাউকে ফেলে দিয়ে আসা।

বাস্তব অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে এমন অনেককেই দেখেছি, লিখিত পরীক্ষায় দু'একটি তে অংশ গ্রহণ করে বাকিগুলো থেকে মুক্তি চেয়ে পরীক্ষা থেকে বিদায়! আবার তাদের মাঝে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহাস্যে প্রকাশ করে বিসিএস পরীক্ষা দিলে অতি মেধাবীর কাতারে চলে যেত! স্নিগ্ধতায় মুখর কথাগুলো শুনে আফসোস করি। তাই বলি লিখিত পরীক্ষায় অতি কাঠিন্যের প্রাকৃত রূপ যাতে চূড়ান্ত ধৈর্য্যের সাথে অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। তারপর দুইশত মার্কসের ভাইবা। প্রিলিমিনারীর দুইশত নম্বর গণনা নেয়া হয় না। জেনারেল ক্যাডারের নয়শত নম্বর এবং ভাইভার দুইশত নম্বর। সবগুলো মিলিয়ে এগারশত নম্বর। যদি প্রফেশনাল ক্যাডার সহ গণনাতে নেয়া হয় তবে সেক্ষেত্রে ১৩০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। যদিও ৩৪ তম বিসিএস পর্যন্ত প্রিলিমিনারীতে একশত নম্বরের পরীক্ষাই বিদ্যমান ছিল। ৩৫ তম বিসিএস থেকে দুইশত নম্বরের প্রিলিমিনারী পরীক্ষা হয়ে থাকে।

সেই সকল পরীক্ষা উতরায়ে যারা ভাইভায় ফলপ্রসু তাদেরকে অবশ্যই মেধাবী কেন অতি মেধাবীর কাতারে ফেলা যায়। তাদের প্রজ্ঞা, জ্ঞান, মেধা কাজে লাগিয়ে সেখানে প্রবেশ করেছে। কিন্তু যারা ভাইভা থেকে ফিরে আসে তাদের কোন কাতারে ফেলা হয় জানি না।

অন্যান্য চাকরি তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই বিসিএস ক্যাডার থেকে নিয়োগকৃত চাকরি ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে। যে সকল চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় তার মাঝে বিসিএসেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পদের বিপরীতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। যদিও জেনারেল ক্যাডারে সে অনুপাতে কম সংখ্যক পদই থাকে। তাছাড়া অন্যান্য চাকরি তুলনায় পেশাগত বৈচিত্র্য চাকরি প্রত্যাশিতদের আলাদাভাবে প্রলুব্ধ করে। হয়তো এ ধরণের চাকরির সান্নিধ্যে থাকলে সমাজে চাকরির মর্যাদা কিংবা জৌলুস আরও কয়েক গুণ বেড়ে যায়! তাই তাদের বিসিএসের প্রতি মোহ জন্ম নেয়।

হ্যাঁ, তরুণরা আজ বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত। তাদের এই ব্যস্ততার মাঝেই তাদের কোন একটি স্বপ্ন কাজ করে। স্বপ্নটুকু বাস্তবায়নের মাঝেই যেতে চায় সোনালী ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে। অনেক আত্মবিশ্বাসের বলয়ে এসে অতি পরিশ্রমের মাঝে নিজের পান্ডিত্য প্রকাশে বলিয়ান হয়। তবে এই আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হওয়া নি:সন্দেহে ইতিবাচক ধারণার ইঙ্গিত বহন করে।

অনেক চড়াই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে নিজেকে ভাইভার জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করতে হবে। সেক্ষেত্রে ভাইভা হলো ভাগ্য নির্ধারক যা আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার স্বপ্নময় জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। পর পর চারটি ভাইভায় উপস্থিত হয়েও সফলতার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসি। অভিজ্ঞতার মাঝেও আমার জেনারেল ক্যাডারে লিখিত পরীক্ষার ঝুলিতে ৬২.৫০% নম্বর নিয়েও ভাইভায় অকৃতকার্য! যেখানে দশ-বারটি ভাইভা বোর্ড বসে সেখানে একই বোর্ডে বার বার ডাক পাওয়া দুর্ভাগ্যেরই নামান্তর বটে।

সে না হয় মেনে নিলাম ভাগ্যের পরিহাস হিসেবে। কিন্তু গণিত (Mathematics) বিষয় নিয়ে বোথ (Both) ক্যাডারে কোয়ালিফাই করেও ভাইভায় সরব উপস্থিতি জানান দিই। তাতেও হার মেনে পিছু হটতে হলো। অথচ গণিত বিষয়ে যতটি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন চাওয়া হয় প্রফেশন্যাল ক্যাডারে ঠিক তত সংখ্যক প্রার্থীকে ভাইভায় পাওয়া কঠিন ব্যাপার। কিন্তু কপালের নিয়ন্তা ভাগ্যই বার বার বিড়ম্বিত করে ভগ্ন দশাকে আরো ভগ্ন করে ফেলে!

তারপরও আমরা নৈরাশ্যবাদে বিশ্বাসী নই। তাই আশা নিয়ে এগিয়ে চলি। কিন্তু আশার মাঝেও যখন সীমাবদ্ধতা চলে আসে তখন নৈরাশ্যকেই আলিঙ্গন করে বেঁচে থাকতে হয়। তাই মাঝে মাঝে ভাবি, বিসিএস ভাইভায় পারঙ্গম বলতে যা বুঝায় তা কখনো বুঝে উঠতে পারিনি। আঁচ করতে পারিনি জীবনযুদ্ধ একটি অসমতার স্থান। সম্ভবত নিজের ভাগ্যই সেখানে পথ খোঁজে দেখিয়ে দেয় তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে।

আবার ভাইভার মাঝেই কারো কারো ক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তি গড়ে দেয়। ভাইভা ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক বলেই ভাগ্যের অন্বেষণে অনেকে স্বপ্নের সিড়িতে হোঁচট খেয়ে ফিরে আসে। মনে হয় ভাইভা ভাগ্যের সহায়ক কিংবা বিড়ম্বনায় পর্যুবসিত এক অসহায়ত্বের প্রবেশদ্বার।

 

অনজন কুমার রায়
 ব্যাংকার ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top