বেকারত্ব ও ভারতীয় শিক্ষিত সমাজ : আরিফুল ইসলাম সাহাজি


প্রকাশিত:
২১ জুলাই ২০২০ ২২:১৪

আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৮:৪৩

 

দেশের ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে মা ভবানীর প্রেতছায়া। আরও অনেক মহাসংকটের মত অর্থায়ন পরিমিতিতে এসেছে কঙ্কালময় অভিব্যক্তি। দেশীয় সম্পদ কুক্ষিগত করবার দুরভিসন্ধি জনিত কারণে অর্থগত শোষণ 'জোর মারো হাঁইয়া' বলে গণমানবের নিত্যদিনের গল্পে সিনেমার ভিলেন অমলেশপুরী হয়ে উঠছে। একটি দুটি শিল্পগোষ্টির সম্পদ আকাশচুম্বী যেমন হচ্ছে, তেমনি অন্য অনেক শিল্পগোষ্টি হাম্বা হাম্বা করে পালাতে পারলে বাঁচি, এমন অবস্থার মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফলত স্বাভাবিকভাবেই অনেকেরই কোম্পানিতে পড়ছে তালা, কর্মীরা কর্মহীন হয়ে ঘরবাবু হয়ে পড়ছেন। 

কর্মযোগ বড্ড হালকা । প্রতি বছর হাজার হাজার যুবক যুবতী চাকরি যোগ্য হয়ে উঠছেন, অথচ রাষ্ট্রের সামান্যতম সমর্থ নেই তাঁদের সামনে কর্মদুয়ার খুলে দেওয়ার। স্বজীবনের অর্ধপর্ব কঠোর তপস্যা আর কৃচ্ছ্রসাধনে ব্যাপিত থেকে একজন শিক্ষিত দেশ নাগরিক রাষ্ট্রের কাছে তাঁর হকের একটা কাজ কী চাইতে পারেন না? অবশ্যই পারেন। 

বাবা মা অনেক স্বপ্নে দুই চোখে বপন করেন সন্তানকে ঘিরে। ছেলেটি মেয়েটিও স্বপ্ন দেখে, পাঠ্যজীবন শেষ করেই একটা চাকরি নেবে। বাবাকে বিশ্রাম দেবে, মাকে সুন্দর একটা বাড়ি করে দেবে। বিয়ে করবে, ছোট একটা সংসার হবে তাঁর। বাবা মা স্ত্রী সন্তান নিয়ে গড়ে উঠবে তাঁদের অনন্য জগৎ। হায় কপাল ! বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ চৌহদ্দির বাইরে এসেই আক্কেল গুড়ুম অবস্থায় এসে দাঁড়াই সেই যুব যুবতীগণ। স্বপ্ন ভেঙে পরে তাসের ঘরের মত । কাজ পেয়ে যে বৃদ্ধ বাবাকে বিশ্রাম দেবে ভেবেছিল ভাগ্যের ফেরে, রাষ্ট্রের ব্যর্থতাজনিত কারণেই বৃদ্ধ বাবার রক্ত ঘাম করা উপার্জনে জীবন নির্বাহ করতে হয় তাঁকে।

স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট, যন্ত্রণার পরিব্যপ্ত আবহ স্বরুপ সকলের কাছে স্পষ্টতর হবে এমনটি নয় । আপনি যদি স্বর্ণমন্দিরের পুরোহিত হন, তাহলে রিক্সা চালক পিতার শিক্ষিত বেকার যুবার যন্ত্রণা উপলব্ধি আপনার জন্য নয়। কর্মযোগের হাঁড়ি পূর্ণ ছিল না কোন কালেই, তবে এত্তটা শূন্য বোধহয়  কোন কালেই ছিল না। অন্ততঃ গত ৪৫ বছর যাবৎ এমন দুর্যোগপূর্ণ বেকারত্বময় কালো মেঘ আমাদের দেশকাশকে আচ্ছন্ন করেনি। দিশাহীন নেতৃত্বের উৎপাটন দিকনির্দেশনার জন্য এই অধঃপতনের গর্তে দেশ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, বিষয়টি সদ্য দাঁত ওঠা মানব শিশুর কাছেও স্পষ্টতর । 

রাষ্ট্র যদি তার বক্ষে পালিত স্বশিক্ষায় ভাস্বর স্বর্ণসন্তানদের মেরুদণ্ডহীন, কর্মহীন করে রাখে, তবে তা কর্মহারা সমাজের ব্যর্থতা নয়, তা রাষ্ট্রের অপদার্থতা । দুঃখের, যাঁরা দেশ ও জাতির মশালবাহী হবেন, তাঁরাই নিরাশার অন্তজালে নিমজ্জিত হয়ে আছেন, অনেকেই মস্তক অবনত করে নিয়ে নিয়েছে। পার্শ্ববর্তী গণমানবের কাছে অনেকেই ঠাট্টার স্টাচু হয়ে পড়েছেন। অনেকেই কোন রকম বেঁচে থাকবার জন্য,  জীবনের জন্য, সংসার করবার জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ অন্যত্র মাথা গুঁজছেন। লাঞ্ছনা, অপমান ও অনিয়মিত বেতন কাঠামোর আবর্তে তাঁদের  জীবন বাঁধা পড়ছে । বিষয়টি দৃষ্টান্তযোগে বললে পাঠক বুঝবেন। 

একটা কলেজের পাশাপাশি এক মিশন স্কুলেও পড়িয়েছি বেশ কিছু সময়। এ গল্প সেই সময়কার। গল্প বলতে সাধারণভাবে যেমন বোধ হয় আমাদের, তার থেকে এ গল্প কিছুটা স্বতন্ত্র। গল্পটি এক ঝাঁক তরুণ এবং তরুণীর। একটা কথা প্রচলিত আছে , বেসরকারি প্রতিষ্টানে কাজ করতে গেলে চামড়াটা নাকি একটু পুরু হতে হয়। কর্তাব্যক্তিদের মেজাজ বুঝে চলতে হয় । তাঁরা শুধু বলে যাবেন, আপনি কিছু বলতে পারবেন না। 

ঠিকঠাক মাইনে দিতে চাইত না উক্ত প্রতিষ্টানটি। এটা নাকি মিশন স্কুলের ঐতিহ্য, যদিও ব্যতিক্রম নিঃসন্দেহ আছে। তবে, আমাদের এই স্কুলটা শিক্ষিত যুবকদের খুব একটা কদর করতো বলে মনে হতো না। দেখতাম, পিছনে সকল শিক্ষক কানাঘুষি করতো, কলুর বলদের মত খাটিয়ে নিয়ে মাইনে দিতে এদের এত লাগে কেন? আমিও ভেবে পেতাম না, সত্যি সারাটা মাস এতটা পরিশ্রম করিয়ে এদের বেতন দিতে এত কিসের কষ্ট হয়। বিষয়টা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হতো না, চাকরি নেই, চারদিক বেকার অগুণতি যুবক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। একজন চলে গেলে ওই রকম কত্ত পাওয়া যাবে, এমন একটা মানসিকতা নিয়েই চলে এই সব বেনিয়ার দল। 

দুই মাস পর এক মাসের বেতন দেওয়ার নিয়ম ছিল। যদি ভাবেন, এক মাসের বেতন এক সঙ্গে দেওয়া হতো, তাহলে আপনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন মশায়। ওই টাকাটিও বেশ কয়েকটা কিস্তিতে দেওয়া হতো। সাধারণত দুই মাস শেষ হয়ে কুড়ি একুশ তারিখ হলে বেতন দেওয়ার সময় আসতো। অর্থাৎ ধরলে তিনমাস প্রায় কালব্যাপি সময়ে শিক্ষকগণ এক মাসের বেতন পেতেন। মাস তিন মত ছিলাম। নিজেকে কেমন ভিক্ষুক বলে মনে হতো। সারা মাস পড়িয়ে একবার একে ধরো, একবার ওর হাতে পায়ে ধরো, ও স্যার টাকার ভীষণ দরকার, ছেলেটা অসুস্থ, বৌ এর বাচ্চা হবে, দেবেন টাকাটা ? পাঠক, এম. এ প্রথম শ্রেণী, বি.এড করা একজন মানুষের কণ্ঠে আমি ভিক্ষুকের অধিক আকুতি দেখেছি। আঁতকে উঠেছি, ভেবে পায়নি একটা সভ্য দেশে সত্যকার মানব সম্পদ শিক্ষককে এইভাবে বেনিয়াদের কাছে ভিক্ষাপাত্র পাততে হবে ? এর থেকে লজ্জার, কষ্টের ছবি আর দুটি দেখেছি বলে মনে হয় না ।

ভাবনার গভীরে আরও নিমজ্জিত হওয়ার আগে, একটা ঘটনা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে। দুই মাস অতিক্রান্ত হয়ে চৌদ্দ তারিখ হয়েছে। হঠাৎ শুনলাম মাইনে হবে। সব্বাই জব্বর খুশি। প্রায় দশদিন পূর্বে মাইনে হচ্ছে, খুশি হওয়ারই কথা।  অফিস রুমে বসে আছি সব্বাই। এক এক করে ডাক পড়ছে। তারপর যে ঘটনাটি ঘটল, মনে হয়েছিল এই অপমান সহ্য করবার চেয়ে বিষ খেয়ে মরা অনেক ভালো। দুই মাস চৌদ্দ দিন পর এক একজন শিক্ষকের হাতে দুই হাজার তিন হাজার করে টাকা দেওয়া হচ্ছে। দেখলাম সব্বার আহ্লাদ করা মুখ হঠাৎ করেই বিষন্ন হয়ে উঠল। অনেকেই সব্বার সামনে কেঁদে পর্যন্ত ফেলছে। এর থেকে বড়ো লজ্জার মুখোমুখি হতে হয়নি আগে কখনও। একজন শিক্ষক জোর করে তার ঘরে নিয়ে গেল, দেখলাম তাঁর চোখ ভিজে। দুই হাজার টাকার কত্ত টুকু বাড়িতে পাঠাবে, আর কত্ত টুকুইবা নিজের নিজের কাছে রাখবে এই বিষয়টাই সে ঠিক করতে পারছে না। বললাম, আমি ছেড়ে দিচ্ছি, আপনি দিন। তিনি যা বললেন, তাতে আরও অবাক হলাম। তিনি বললেন, আপনার রেজাল্ট ভালো, লেখালিখি করেন, অনেকেই চেনে, আপনি যেকোন কাজ পেয়ে যাবেন, কিন্তু আমি ছেড়ে দিয়ে কী করবো? বললাম, এতটা অপমানের পরও থাকবেন? তিনি দীর্ঘশ্বাস টানলেন একটা, তারপর বললেন, পূর্ব জন্মের পাপ এসব স্যার !

সত্যই, পূর্ব জন্মের পাপ বটে। সকালে আলু, দুপুরে আলু, রাত্রী আলু খেয়ে আবাসিক থেকে বাচ্চা পড়িয়ে চোখের জল সহযোগে মাইনে নিতে হয়, এ পূর্ব জন্মের পাপ নয়তো কী ? যাঁরা দেশ ও জাতির অহংকার, যাঁদের হাত ধরে একটি দেশ হাঁটবে প্রগতির পথে, তাঁরা এইভাবে অর্ধশিক্ষিত বেনিয়াদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন প্রতিদিন। কোন রকম সৌজন্যবোধটুকু নেই। চাকরের মত ব্যবহার করেন। অল্প কয়েকটা টাকার বিনিময়ে শিক্ষিত ভারতকে কিনে নিয়েছে এমন আস্পর্ধা তাদের। এম. এ, বি.এড ডিগ্রি অর্জন করতেই পেরিয়ে যায় জীবনের বৃহত্তর প্রহর। মা বাবা আশায় বুক বাঁধে সন্তান যোগ্য হয়েছে সেই এবার সংসারের ঘানি টানবে। হায় রে, পোড়া দেশ ! চাকরির হাঁড়িতে মাকড়সা জাল বুনেছে আজ। মাত্র ছয় সাত হাজার টাকার বিনিময়ে এত্তদিনের অর্জিত মেধা জ্ঞান বিকিয়ে বসে শিক্ষিত মানুষগুলো। তাছাড়া করবেনটাই বা কী? শ্রমজীবী হিসাবে কিম্বা কলের কর্মী হওয়া কী তাঁর সাজে? তাই অর্ধ শিক্ষিত অমানবিক বেনিয়াদের অপমান সহ্য করেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকছেন তাঁরা। ঈশ্বর তাঁদের রক্ষা করুন, মঙ্গল করুন। 

 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top