সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

করোনা ভাইরাস ও মানবিক পৃথিবী : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
২২ আগস্ট ২০২০ ২৩:৪১

আপডেট:
২২ আগস্ট ২০২০ ২৩:৪৪

 

অমানবিক পৃথিবীকে মানবিক হয়ে ওঠার জন্য করোনা ভাইরাস নামক অদৃশ্য অনুজীবটির খুবই প্রয়োজন ছিল। পৃথিবী কোনোভাবেই মানুষ নামক সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। তাই তো পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসের আবির্ভাব। করোনা ভাইরাস হয়তো আপাতত পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে কিংবা বিশ্রাম নেবে। আমাদের আরও কিছুদিন মানবিক পৃথিবীতে অমানবিক আচরণের সুযোগ দেবে। কিন্তু তারপর?

ক্ষণকাল বিরতি দিয়ে আমাদের অত্যাচার বেড়ে যাবে। পৃথিবী সে অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না। আমাদের পাপে ভারী হয়ে উঠবে সবুজ গ্রহটি। তখন এর চেয়েও শক্তিশালী কোনো দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য শক্তি দিয়ে পৃথিবী আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে কিংবা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। সেদিন বেশি দূরে নয়। সেদিনের ধ্বংস অনিবার্য।

 

আমার ছোটোবেলা কেটেছে গ্রামে। সরাসরি দেখেছি কৃষকেরা কীভাবে চাষাবাদ করেন। আমার বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। আমাদের চাষাবাদ তেমন ছিল না। কিন্তু ইরি বোরোর মৌসুমে আমাদের জোলোজমিতে ইরি ধান চাষ হতো। তখন আমরা ভায়েরা মিলে স্কুল-কলেজের অবসরে ইরিক্ষেতে কাজ করতাম। কিছুটা প্রয়োজনে কিছুটা আনন্দে। তখন ইরিক্ষেতে সেলোমেশিন দিয়ে পানি দেওয়া হতো। কিছুদিনের মধ্যেই ধানগাছ সবুজ লকলকে হয়ে উঠত। ধানগাছগুলো যখন অপ্রতিরোধ্যগতিতে বেড়ে উঠছে তখনই ধানক্ষেতে পানি দেওয়া কয়েকদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হতো। ধানগাছগুলো কিছুদিনের জন্য কেমন শুকনো বিমর্ষ হয়ে যেত। তখন আমার কিশোর মনে খুব কষ্ট হতো। বড় ভাই ও ক্ষেতে কাজ করা গ্রামের কৃষকদের কাছে পানি না দেওয়ার কারণ জানতে পারলাম- একাধারে পানি দিলে ধানগাছগুলো ঝাপালো হয়ে যায়, তাতে ধানের ফলন ভালো হয় না, ধানে চিটা হয় বেশি। এজন্য কয়েকদিন পর পর ধানের ক্ষেত রোদে শুকাতে হয়। তাহলে ধানগাছগুলো আরও শক্ত ও বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে। যখন ধান পাকার সময় হবে তখন গাছগুলো ধানের ভারে পড়ে যাবে না। কয়েকদিন পরপরই এই নিয়ম পালন করা হতো। সম্ভবত এখনও এই নিয়ম মেনেই ইরি-বোরো ধানের চাষ করা হয়।

আমরা মুসলিমরা যারা বছরে এক মাস রোজা রাখি বা সিয়াম সাধনা করি এটাও আমাদের ধর্মীয় আদেশ পালনের পাশাপাশি শারিরীকভাবে সক্ষমতা এবং শরীরকে আরও রোগমুক্ত রাখারই একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। শত শত বছর আগে এটি মানবজাতিকে রোগমুক্ত, বলিষ্ঠ ও সক্ষম করার একটি পদ্ধতি যা ইসলাম মুসলমানদেরকে এনে দিয়েছে।

সম্প্রতি জাপানের একজন বিজ্ঞানী মুসলমানদের রোজা বিষয়ে গবেষণায় জানিয়েছেন, মানুষের শরীরে কিছু অকেজো কোষ থাকে যারা শরীরে কোনো উপকারে আসে না বরং নানা ক্ষতি করে থাকে।

সারা বছর মানুষ খাওয়া-দাওয়া করে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য। কিন্তু রোজা মানবশরীরে এক মাসের জন্য শরীরের নানা কলকব্জাকে বিশ্রাম দেয়। ফলে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে আরও ফিট ও সক্রিয় করে তোলে। জাপানি এ বিজ্ঞানীর মতে, যখন মানুষ অভুক্ত অবস্থায় থাকে তখন শরীরের সক্রিয় কোষগুলো নিস্ক্রিয় কোষগুলোকে খেয়ে ফেলে, ফলে শরীরে আরও নতুন নতুন কোষ তৈরি হয় এবং শরীরকে আরও বেশি সক্ষম করে তোলে।

আমাদের প্রিয় পৃথিবীর বেলায়ও নিয়মটা একই। এ জন্যই পৃথিবীতে যুগে যুগে ক্ষরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, এসিডবৃষ্টি, ভ‚মিকম্প, সাইক্লোন, সুনামি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস-সহ আরও নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটিয়ে পৃথিবী নিজেকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু মানুষ পৃথিবীর এ নিয়ম পালনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।  অন্যদিকে মানুষের ক্ষমতাকে অবদমন করার জন্য পৃথিবীতে প্লেগ, কলেরা, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফ্লু ভাইরাস, ইবোলা ভাইরাস, স্প্যনিশ ফ্লু-সহ নানা রোগ বালাই দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে। নিচ্ছে।

সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন মানুষকে। সাথে সাথে আমাদের একটা জিনিসের প্রতি আগ্রহ খুবই প্রবল করে সৃষ্টি করেছেন। সেটা হচ্ছে লোভ। সীমাহীন লোভ।

মানব শরীরের অভ্যন্তরের যন্ত্রপাতিগুলোকে আরও সুসংহত ও সামর্থবান হতে যদি বছরে এক মাস বিশ্রাম দেওয়া হয় তাহলে পৃথিবীকে অন্তত হাজার বছর পরপর এক বছরের মতো বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে বৈকি!

আমরা মানুষেরা নিজেদের প্রয়োজনে পৃথিবীর পাহাড়গুলোকে কেটে রাস্তা বানাচ্ছি। বসতবাড়ি তৈরি করছি। পাহাড় আমাদের কিছু বলে না। বিনা কারণে আমরা মানুষেরা মাটির উপর লাফালাফি করছি- মাটি মুখ বুজে সহ্য করে। আমরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পৃথিবীর গাছগুলোকে কেটে ফেলছি- গাছ আমাদের কিছু বলে না। অথচ গাছেরও প্রাণ আছে। আমরা নদী-সাগরের বুকে লঞ্চ, স্টিমার, বড়ো বড়ো জাহাজ হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছি। জাহাজ থেকে নির্গত তেল পানিকে দূষিত করছে। আর প্লাস্টিক, পলিথিন সহ নানা বস্তু তো পানিতে ফেলেই চলেছি। নদী দূষিত হচ্ছে। সাগর দূষিত হচ্ছে। কিন্তু নদী-সাগর আমাদের বাঁধা দেয় না। আমরা পৃথিবীর মানুষেরা পৃথিবীর বনগুলো যেমন- আমাদের সুন্দরবন, পৃথিবীর ফুসফুস অ্যামাজনসহ সকল বনজঙ্গল অবলীলায় ধ্বংস করে চলেছি। পৃথিবীকে একটু একটু করে রোগাক্রান্ত করে চলেছি। কিন্তু বন আমাদের পায়ে বেড়ি পরায় না।

আমরা আমাদের প্রয়োজনে পৃথিবীর বুকে অজস্র রাস্তাঘাট নির্মাণ করেছি, আর সেসব রাস্তাঘাটে চলছে অসংখ্য যানবাহন। সেসব যানবাহন থেকে নির্গত হচ্ছে কালো ধোঁয়া, শিশা ও ক্ষতিকর কার্বন মনোঅক্সাইড। দূষিত হচ্ছে পৃথিবীর বাতাস। বাতাস তবুও আমাদের করুণা করে নিশ্বাস নিতে দেয়।

আমরা মানুষেরা নিজেদের প্রয়োজনে বড়ো বড়ো অট্টালিকা, টাওয়ার নির্মাণ করছি। আর নির্মাণের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মাটি ও গাছপালা। একদিকে ইট তৈরির জন্য বাতাস দূষিত হচ্ছে অন্যদিকে গাছপালা ও মাটির ক্ষয় হচ্ছে। তবুও আমার প্রকৃতি আমাকে বাঁধা দেয় না।

আমরা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষেরা এতেও সন্তুষ্ট নই। যুদ্ধ-বিগ্রহ করছি। নিজেরা নিজেদেরকেই ধ্বংস করছি। আমরা আকাশে উড়ছি। বাতাস দূষিত করছি। আমরা পানিতে ছুটে বেড়াচ্ছি। নদী কাঁপিয়ে। সাগর-মহাসাগর দাপিয়ে। পানিকে দূষিত করছি। আর মাটিকে তো দূষিত অহরহই করছি। কিন্তু আমরা যা কিছুই করছি মাত্রা রেখে কোনো কিছুই করছি না। সবকিছুই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে করছি। আর সব বাড়াবাড়িরই একদিন শেষ আছে।

আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাও একই রকম। পৃথিবীটাকে টুকরো টুকরো করেছি আরও অনেক আগে। দেশ-মহাদেশ, সাগর-মহাসাগর, দ্বীপ-উপদ্বীপে ভাগ করে ফেলেছি। আর তৈরি করেছি নিজেস্ব ভূখণ্ড। নিজেস্ব বলয়। নিজ নিজ রাজনৈতিক পরিচয়। গঠন করেছি গোত্র-উপগোত্র। দল-উপদল। তৈরি করেছি নিজেস্ব রক্ষাবাহিনী, প্রতিরক্ষাবাহিনী। উদ্দেশ্য একটাই নিজেকে নিরাপদ রাখা, অন্যকে প্রতিরোধ করা। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা মানুষগুলো হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। তারা ভাবে আমাদের কেউ পরাজিত করতে পারবে না। আমরা সবাইকে পরাজিত করব। আর এই হীন আপাতস্বার্থ হাতের মুঠোয় আনতে সে নানা ছক কষে। সেই ছকের শিকার হয় প্রথমে মানুষ, তারপর প্রকৃতি। প্রকৃতি তো মুখ ফুটে সরাসরি কিছু বলে না।শুধু হিসাবটা মনে রাখে। কিন্তু মানুষ কখনো কখনো প্রতিবাদী হয়। তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য যুগে যুগে রাষ্ট্রের শাসকগণ নির্যাতন চালায়। ফলে কিছু মানুষ সুবিধার আওতায় আসে, কিছু মানুষ নির্যাতন ভোগ করে। যারা সুবিধা ভোগ করে তারা নির্যাতিতদের পাশে কখনো দাঁড়ায় না। ভাবে এবং বলে তুমি নির্যাতিত তাতে আমার কী? আমি কেন তোমার কষ্টের ভাগ নেব? এমনকি কাছের মানুষ, আত্মীয়পরিজন হলেও সুবিধাভোগী মানুষ এগিয়ে আসে না। প্রকৃতি কিন্তু বসে থাকে না। সে ভেতরে ভেতরে প্রতিশোধ নেবার কৌশল ও শক্তি অর্জন করে।

পৃধিবীর ইতিহাস বলে, পৃথিবী প্রথমে মানুষকে ও ক্ষমতাধরকে সতর্ক করে তারপর ধ্বংস করে দেয়। এমন নজির পৃথিবীতে হাজার হাজার। আর পৃথিবী যখন তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করে তখন বিনা দোষেও কিছু সাধারণ মানুষের প্রাণ যায়। পৃথিবীর এটাকে প্রতিশোধপরায়ণতা মনে হলেও পৃথিবী তার টিকে থাকা এবং নিজেকে সুসংহত রাখার প্রয়োজনেই মাঝে মাঝে মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।

পৃথিবী আর কত সহ্য করবে? সহ্যেরও সীমা আছে। পৃথিবী আমাদেরকে প্রতিনিয়তই সতর্ক করে। নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং নানা রোগবালাই দিয়ে। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের ওই একই অসুখ- শুধু নিজেকে বাঁচানো। নিজেকে ভালো রাখা। যতক্ষণ না সরাসরি নিজে আক্রান্ত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ভাবে- অমুখের অসুখ হয়েছে তাতে আমার কী? তমুকের বিপদ হয়েছে তাতে আমার কী? আমার তো কিছু হয়নি।

বর্তমান এই করোনা পরিস্থিতিতেও পৃথিবী মানুষকে সতর্ক করার কাজই করে চলেছে। করোনা ভাইরাস নামক অদৃশ্য শক্তির আবির্ভাব চীনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে কয়েকদিনের ব্যবধানেই সারা পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে পড়ল। তাও আবার মানুষই তা ছড়াল। পৃথিবী ইচ্ছা করলে বাতাসের মাধ্যমে, পানির মাধ্যমে মুহূর্তেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে পারত- কিন্তু না তা করেনি, মানুষের মাধ্যমেই মানুষকে শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতি চিন্তা করল।

করোনা ভাইরাস ধীরে ধীরে পৃথিবীর সকল মানুষের হাতে, মুখে, ফুসফুসে পৌঁছে গেল। অদৃশ্য এই শক্তির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আমরা পৃথিবীবাসীরা আবার চৌদ্দশ বছর আগে ফিরে গেলাম। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে নানা কর্মফলের জন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মহামারি দিয়ে থাকেন। পৃথিবীর মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সা.) চৌদ্দশ বছর আগে বলেছিলেন, যখন কোনো এলাকায় মহামারি শুরু হয় তখন আক্রান্ত এলাকার মানুষ ভালো ও সুস্থ এলাকায় যাবে না এবং সুস্থ ও ভালো এলাকার মানুষ আক্রান্ত এলাকায় যাবে না।

চীন এই নীতি কিছুটা মানল, কিছুটা মানল না। কিছুটা না মানার কারণে সারা পৃথিবীকে ফেলল এক মহা বিপর্যয়ের মুখে। চীনে সারা পৃথিবীর যত মানুষ ছিল তাদেরকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাল। ফলে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল অদৃশ্য শক্তি। আর সেই অদৃশ্য শক্তির ভয়ে আমরা পৃথিবীর মানুষেরা হলাম ঘরবন্দি। আমরা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অনেক মানুষই অজান্তেই যার যার ঘরে নবীজীর দেওয়া বিধান পালন করতে লাগলাম।

করোনা ভাইরাস নামক অদৃশ্য শক্তি আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে শৃংখলিত জীবন যাপন করতে হয়। পৃথিবী যখনই মানুষের অত্যাচার, নিপীড়ন আর সহ্য করতে পারে না, তখনই সে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। আমরা মানুষরা তা বুঝি না। পৃথিবী ভূমিকম্প দিয়ে আমাদের শান্ত ও বিনীত হতে বলে- আমরা আরও অশান্ত হয়ে উঠি। পৃথিবী সাইক্লোন ও সুনামি দিয়ে যখন আমাদের বলে তোমরা নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করো- আমরা তা কর্ণপাত করি না। আমরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠি। পৃথিবী বার বার আমাদের সতর্ক করলেও আমাদের প্রতি তার সহানুভূতিও কম নয়। আমাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান কেড়ে নিয়ে একেবারে কখনো নিঃস্ব করে দেয় না। আমাদেরকে আদিম যুগে ফেরত পাঠায় না। আমরা ক্ষণিকের জন্য কখনো কখনো শান্ত ও বিনীত হলেও ক্ষণকাল ব্যবধানে আবার উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া হয়ে উঠি।

আমরা পৃথিবীর মানুষেরা পৃথিবীর স্পষ্ট সব প্রতিবাদ ও সতর্কবার্তা দেখেও সংশোধিত হই না। আমাদের চরিত্রের বদল হয় না। আমাদের আবারও লোভ, সীমাহীন লোভ পেয়ে বসে। আমরা ভোগবিলাস ও ক্ষমতার লোভে আবারও সবকিছুকে দু'পায়ে দলে নিজের স্থান সুউচ্চে নেওয়ার চরম প্রতিযোগিতায় নামি। তার জন্য কার কী ক্ষতি হলো, কার কী হারাতে হলো তাতে আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না।

পৃথিবী তার প্রিয় বন্ধু মানুষদের এই কীর্তিকলাপ দেখতে দেখতে আর সহ্য করতে পারে না। তাই সে অদৃশ্য শক্তি দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। শৃংখলিত জীবন যাপন করতে বাধ্য করেছে।

করোনা ভাইরাস পৃথিবীর মাত্র কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ৭০০ কোটি মানুষকে বিনীত হতে শিখিয়ে দিচ্ছে। শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর পৃথিবীতে আরও যেসব প্রাণীকুল, উদ্ভিদকুল, সর্বোপরি যা কিছু আছে সবাইকে স্বস্তি ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করছে। এমনকি সৌরজগতের মধ্যে উৎকৃষ্ট গ্রহটিকে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীকুল ও জীবজগতের আরও কিছুকাল বসবাসের জন্য সুগঠিত করার কাজ করছে।

পৃথিবীর আকাশ আজ আরও নীল হয়েছে।

পাখিদের কলকাকলীতে চারপাশ মুখরিত।

বনভূমি আরও সবুজ হয়েছে।

বন্যপ্রাণীগুলো তাদের স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে।

নদী-সাগর পরিশুদ্ধ হয়েছে।

মাছ ও জলজ প্রাণী আনন্দিত ও বাঁধাহীন।

বাতাসে কার্বনের মাত্রা কমে এসেছে।

বাতাস হয়েছে পরিশুদ্ধ।

করোনা ভাইরাস আমাদেরকে মারতে আসেনি, সামান্য কিছু ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে আমাদেরকে পরিশুদ্ধ করতে এসেছে।আমাদের বিবেককে জাগাতে এসেছে। আমাদেরকে সতর্ক করতে এসেছে। আর এসেছে আমাদের প্রিয় পৃথিবীটাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে। পৃথিবী ধ্বংস হলে আমরা নিশ্চয়ই সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে আশ্রয় পাব না।

কিন্তু আমরা কী মানবিক হতে পেরেছি?

আমরা কী এখনো ক্ষতিকর অ্যালকোহলের নেশায় বুঁদ নই?

আমরা কী আমাদের প্রিয় স্বজনদের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াতে পারছি?

আমরা কী নিজের মা ও স্বজনদের মৃতদেহকে সতকারের ব্যবস্থা করছি?

আমরা এখনও শুধু নিজেকে বাঁচানোর জন্যই দৌড়াচ্ছি... দৌড়াচ্ছি... দৌড়াচ্ছি...

করোনা ভাইরাস নামক অদৃশ্যশক্তি আমাদেরকে সতর্ক করতে চাইল কিন্তু আমরা সতর্ক হলাম না। আমরা সতর্ক না হলেও এই অদৃশ্য শক্তি কিন্তু পৃথিবীকে আবার করুণা করে আরও কিছু বছর সেই অকৃতজ্ঞ আমাদেরই বসবাসের উপযোগী করে যাওয়ার কাজটিই নীরবে করে গেল।

পৃথিবী সত্যিই দুর্যোগের মধ্যে আমাদের ফেলতে চায় না। কিন্তু আমরা মানুষেরাই পৃথিবীতে দুর্যোগ টেনে আনি। করোনা ভাইরাস কিংবা আরও কোনো দৃশ্যমান বা অদৃশ্য কোনো শক্তিকে আহ্বান জানায়।

করোনা ভাইরাস হয়তো আপাতত পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে কিংবা বিশ্রাম নেবে। আমাদের আরও কিছুদিন মানবিক পৃথিবীতে অমানবিক হয়ে থাকার সুযোগ দেবে। কিন্তু তারপর?

তারপর আবার যখন পৃথিবী আমাদের অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না, আমাদের পাপে ভারী হয়ে উঠবে, তখন এর চেয়েও শক্তিশালী কোনো দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য শক্তি দিয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণ কিংবা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। আর সে ধ্বংস অনিবার্য।

আমরা পৃথিবীর মানুষ এখনো যদি শুধু সম্পদের পেছনে, ভোগবিলাসের পেছনে, ক্ষমতার পেছনে না দৌড়ে একটু মানবিক পৃথিবী নির্মাণে সচেষ্ট হই তাহলে হয়তো পৃথিবী আমাদের করুণা করলেও করতে পারে!

 

মশিউর রহমান, শিশু সাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক
শিশু সাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওর্য়াড ও অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশু সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত
প্রকাশক, সৃজনী
পরিচালক (প্রচার), বাংলাদশে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top