সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

দেশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড আর কতদিন? : ওসমান গনি


প্রকাশিত:
২৫ আগস্ট ২০২০ ২৩:১৩

আপডেট:
৫ মে ২০২৪ ২২:৪৪

 

দেশে একের পর খুন খারাবি বেড়েই চলছে। এ যেন কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রশাসনের লোক হতে শুরু করে দেশের সাধারণ মানুষের হাতেও এখন অহরহ মানুষ খুন হচ্ছে। যারা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত তাদের হাতে যখন মানুষ খুন বা হয়রানির শিকার হয় তখন এ দেশে আইন আছে বলে মনে হয় না। যদি দেশে আইনের শাসন কায়েম থাকত তাহলে তো একজন পুলিশের হাতে সেনাবাহিনীর লোক নিহত হতে না। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে অতিসহজে অনুমেয় হয় যে, দেশে আইন আছে শুধুমাত্র কাগজেকলমে। বাস্তবে আইনের শাসনের কোন প্রয়োগ দেখা যায় না। এটা আমরা বিশ্বাস করি আর না করি সেটা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। যদি দেশে আইনের শাসন থাকত আর অপরাধমূলক কাজের বিচার হতো তাহলে দেশের মধ্যে আজ মেজর সিনহার মতো একজন সেনাবাহিনীর অফিসার কে পুলিশের গুলিতে মরতে হতো না। আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রয়োগ না হওয়া ও অপরাধমূলক কাজের সঠিক বিচার না হওয়ার কারনে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও খুন, রাহাজানি ও ধর্ষণ মতো মহাঅপরাধমূলক কাজ বেড়েই চলছে।

 

একটা গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটা জঘন্যতম অপরাধ এবং এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবারই প্রশ্ন তুলছে। দেশের মানুষের মধ্য দেখা দিয়েছে বিরুপ প্রতিক্রিয়া। আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থামছেই না। কখনো কথিত ক্রসফায়ার, কখনো বন্দুকযুদ্ধ কখনোবা এনকাউন্টার নামে এ ধরনের হত্যাকা- সংঘটিত হচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কোনো তদন্ত আলোর মুখ দেখে না। বিচারও হয় না।

 

মানবাধিকার সংগঠনের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এক যুগেরও বেশি সময় আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে রুল জারি করেন। স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও রুল জারি করে সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন। কিন্তু সরকারপক্ষ থেকে এসব রুলের জবাব দেওয়া হয়নি। শুনানিও হয়নি দীর্ঘদিনেও। ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন জড়িতরা। গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনার ফের আলোচনায় উঠে এসেছে কথিত ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন থেকে একই দাবি এসেছে। এছাড়া প্রথমবারের মতো রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) পক্ষ থেকেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি উঠেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, শুধু মেজর সিনহা নন, দেশের সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসতে হবে।

 

 ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার এখন জনদাবিতে পরিনত হয়েছে। দেশের সকল শ্রেনিপেশার মানুষের ও রাজনৈতিক দলগুলোর একটাই দাবি অনতিবিলম্বে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ করা। দেশে একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ করা নাহলে দেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। জানা গেছে, দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ সালে প্রথম ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে। এরপর ২০০২ সালে এ ধরনের হত্যাকান্ড শুরু হয়। আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে। দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ ও অবৈধ ঘোষনা করতে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার গুলো বার বার চেষ্টা করেও কোন ফলাফলে পৌঁছাতে পারেননি।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে দেখা গেছে,  চলতি বছরের  জানুয়ারি থেকে গত ২৮ জুলাই পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১৯৬টি। ২০১৯ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে ৩৮৮টি, ২০১৮ সালে ৪৬৬টি, ২০১৭ সালে ১৬২ জন মানুষকে বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ কাস্টডিতে থাকা অবস্থায়ও অনেকের মৃত্যু হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা ২০১৬ সালে ছিল ১৯৫টি, ২০১৫ সালে ১৯২টি, ২০১৪ সালে ১৫৮টি এবং ২০১৩ সালে ২০৮টি। এসব হত্যাকান্ড নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। তারপরও এ ধরনের হত্যাকাণ্ড থামছেই না। দেশের সরকার প্রধান কে দেশের সকল ধরনের অপরাধমূলক কাজ বন্ধ করতে আরো কঠোর হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক বলে তারা কখনও আইনের বাহিরে কোন কাজ যেন করতে পারে সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দিতে হবে। হাতে অস্র আছে বলে য়া খুশি করবে তা হতে পারে না। সরকার এখনও যদি বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড গুলোর বিচার করতে না পারে আর অপরাধীরা পার পেয়ে যায় তাহলে তাদের অপরাধমূলক কাজের পরিধি দিনদিন বাড়বে। হয়ত এমন এক সময় আসবে তখন তা সামাল দিতে সরকার কে হিমশিম খেতে হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন গুলি করে মানুষ মারে দেখে অপরাধীদের অপরাধমূলক কাজের মাত্রা বেড়ে যাবে।

 

ওসমান গনি
সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top