বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাঃ নতুন করে আমাদের ভাবতে হবে : সাইফুল আলম তালুকদার 


প্রকাশিত:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৫৮

আপডেট:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৪০

ছবিঃ সাইফুল আলম তালুকদার 

 

কবি কাজী নজরুল ইসলাম একবার শ্লেষ-আক্ষেপে বলেছিলেন, আমি জানতে পেরেছি পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী জেলায় নাকি আলু-পটল-বেগুনের ন্যায় মৌলভী চাষ হয়। আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নজরুলের আক্ষেপের সেই শ্লেষোক্তি অতিসত্য, তবে ওই চাষ এখন আর কোনো বিশেষ জেলায় সীমাবদ্ধ নেই। চাষটা চলছে পুরো দেশজুড়ে। পেট্রোডলার মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যক্রমে মৌলবাদী রাজনীতিকেরা আজকের বাংলাদেশে শক্তিশালী অপশক্তিতে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মূলেই ছিল  ধর্ম ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক  রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার।

ব্রিটিশ ভারতে ও পাকিস্তান আমলে সাম্রাজ্যবাদ একই কায়দায় স্বীয় স্বার্থে মৌলবাদ বিকাশে ভূমিকা রেখেছিল। কলকাতার বিখ্যাত আলিয়া মাদ্রাসা মুসলিম  সাম্প্রদায়িক কেউ প্রতিষ্ঠা করেন নি। লর্ড ক্লাইভের স্থলাভিষিক্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতবর্ষের দখলদারিত্ব নিষ্কণ্টক করতে যার অবদান সর্বাধিক সেই ইংরেজ ওয়ারেন হেস্টিংস কূট-কৌশলে উদ্দেশ্যমূলক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসা। মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে ইহজাগতিকতা থেকে দূরে রাখার ফন্দি-কৌশল সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ স্বীয় স্বার্থে মদদ যুগিয়ে এসেছে, যার ধারাবাহিকতা আমাদের দেশেও থেমে নেই, একই কায়দায় মৌলবাদ বিকাশের তৎপরতা চলছে। ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরে বিত্তবানদের জন্য গড়ে উঠেছে কিছু বেসরকারি ইংরেজি-মাধ্যম মাদ্রাসা। যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে প্রতিমাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা গুনতে হয়। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সরবরাহের কারণে বিত্তবানদের সন্তানদের ছোট একটি অংশ এ সব আধুনিক মাদ্রাসায় যুক্ত হয়। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষাও এখন বৈষম্যের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

বিত্তবানদের কেউ কেউ কয়েকজন সন্তানের মধ্যে একজনকে আল্লাহর রাস্তায় মাদ্রাসা শিক্ষায় যুক্ত করে থাকে, পরকালের সুফলের আশায়। মোল্লাদের বলতে শোনা যায়, যে-ব্যক্তি নিজের একজন সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় দ্বীন শিক্ষায় যুক্ত করবে, পরকালে সেই সন্তানের পিতামাতা জান্নাতবাসী হবে। আমাদের অশিক্ষিত বিত্তবানদের একাংশ হয়তো এ প্রচারে আস্থা রাখে। সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম, দাখিল, ফাজিল, কামিল পাস করে হাদিসে বিশেষজ্ঞ হয়ে মোহাদ্দেস, কামিল আরবি সাহিত্যে মোহাদ্বিব, ফিকাহ্ ইসলামী আইন, মুফতি এবং তাফসির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মোফাচ্ছির ডিগ্রিপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ জনেরা সমাজে ফতোয়াসহ মৌলবাদী প্রচার প্রপাগান্ডা করে বেড়ায়।

আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের খুব নগণ্য অংশই দেশের অপরাপর শিক্ষিতদের ন্যায় মূলধারায় যুক্ত হতে পারে। বেশির ভাগই ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ধর্মীয়করণের প্রচেষ্টায় যুক্ত হয়ে যায়। খুব কমসংখ্যকই ধর্মকে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় বলে ভাবে এবং ব্যক্তিগত আচার বলে গণ্য করে। মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্তরা আধুনিক ও মুক্তচিন্তার অধিকারী হতে পারে না। সুদীর্ঘ সময়ের শিক্ষা-নিয়মে পরিকল্পিতভাবে তাদের ধর্মান্ধ করা হয় বলেই ধর্মান্ধের বৃত্ত থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারে না। সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশে মৌলবাদ বিকাশে মাদ্রাসাগুলো প্রধান ভূমিকা পালন করছে।

বেসরকারি মাদ্রাসাগুলোতে সরকারি অনুদান-সাহায্য থাকলেও, সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই মাদ্রাসাভিত্তিক মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি-ব্যবসা নিরবচ্ছিন্ন ভাবেই করে চলেছে। ধর্মীয় সেস্নাগান দিয়ে মানুষ হত্যা-জখম-রগকাটা, পাথর নিক্ষেপে নারী হত্যা, লাঠি নিয়ে ভাংচুর, দাঙ্গা, নৈরাজ্য সৃষ্টি এবং ভিন্নমতকে কুপিয়ে হত্যার ন্যায় জঘন্য অপরাধ-অপর্কীতি এযাবৎ বাদ রাখেনি। আমাদের শাসক শ্রেণীর রাজনীতিকেরা ক্ষমতা দখলের ইঁদুর দৌড়ে ব্যতিব্যস্ত। তাই মৌলবাদ রুখতে কোন প্রতিরোধ আমরা দেখছি না, বরঞ্চ পৃষ্ঠপোষকতা ও সখ্য বাড়তেই দেখছি। ব্যক্তিগত এবং দলগত লোভ-লালসা চরিতার্থেই তারা অধিক ব্যস্ত। শাসকশ্রেণী ভোট এবং ক্ষমতার রাজনীতির মোহে মৌলবাদীদের তোয়াজ করার সুযোগে ধর্ম ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দেশজুড়ে মৌলবাদীদের অপকর্ম-অপকীর্তি লাগামহীন ভাবে চলছে। তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সকল সম্ভাবনাকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে মত্ত। মৌলবাদী রাষ্ট্রের আদলে বাংলাদেশকে তারা বিশ্বে নতুন পরিচয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের বিভক্তি-অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার সার্বিক চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছে। এখনই এ বিষয়ে সচতেন এবং উপর্যুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে আমাদের ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। যার নমুনা তো আমরা ক্রমেই দেখে চলেছি দেশের সব দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষেই আজ এর যথার্থ প্রতিরোধ সম্ভব। দেশের ব্যাপক মানুষকে সংগঠিত ও সচেতন করে মৌলবাদ- সাম্প্রদায়িকতা এবং শাসকশ্রেণীর অনাচার এবং শোষণ-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তবেই আমরা সে-আন্দোলনে বিজয় অর্জন করে একটি অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।

 

সাইফুল আলম তালুকদার
লেখক ও প্রাবন্ধিক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top