নীলা হত্যাকাণ্ড: শাশ্বত প্রেম নাকি সংক্ষুব্ধ ভালবাসার বহি:প্রকাশ : অনজন কুমার রায়
প্রকাশিত:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:২৫
আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৯:০২
ভালবাসার প্রাপ্তি সৌন্দর্য্য আনয়ন করে। সৌন্দর্য্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত বলে সৌন্দর্য্যই সেখানে মুখ্য প্রাপ্ত হয়। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত ভালবাসা অসহনীয় করে তুলে। তাই বলে প্রত্যাখ্যাত ভালবাসার বদৌলতে আর্তনাদের হাহাকার কাম্য নয়। পরাজয়কে বরণ করার মাঝেও কোন শিল্পীত সৌন্দর্য্য খুঁজে পাওয়া যায় সেটা অনুধাবন করতে হবে।
প্রবাদে আছে, ভালবাসা আর যুদ্ধে কিছুই অসঙ্গত নয়। কথাটি সর্বাংশে সত্য হলে যুদ্ধাপরাধ বলিয়া কিছু থাকিবে না। তবে সামগ্রীক ভাবে যুদ্ধ ন্যায়-অন্যায়ের ঊর্ধ্বে নয়, যেমনটি নয় ভালবাসাও। সত্য এটাই, সুন্দরও ইহাই; তাই সঙ্গতও বটে। তবে কেন স্বীয় ভালবাসায় সীমানার দ্বার রুদ্ধ করতে গেলেও তটস্থ থাকতে হয়! পুরুষের একপেশে ভালবাসার বিড়ম্বনায় নারীকে আটকে রাখতে হয়। এ অসহনীয় যাতনা নারীর প্রতি পুরুষের ক্ষমতার আস্ফালনকেই জানান দেয়।
কিছুদিন আগে সাভারের ঘটনা সেরকমই বিভৎসতার জন্ম দেয়। নীলার বড় ভাই নীলাকে রিক্সাযোগে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বাসা থেকে কিছু দূরে যাওয়ার পর বখাটে মিজান রিক্সার গতিরোধ করে। অস্ত্রের মুখে নীলাকে টেনে হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে গলায়, পেটে, মুখে ও ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান। সর্বস্বান্ত নীলা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মৃত্যুর হাতছানিকে আলিঙ্গন করে। সেখানে শাশ্বত প্রেমের মাধুর্যতা থাকলে হত্যার মাধ্যমে উগ্র কামনার বহি:প্রকাশ ঘটাত না।
পরিবারের মাঝে বেড়ে উঠা প্রিয় মেয়েকে হারানোয় পিতা-মাতার বিলাপ ধ্বনিত হয়ে আসে। স্নেহময়ী আদরের বোনকে হারিয়ে হয়তো বার বার মু্র্চ্ছা যাচ্ছে বড় ভাইটি। পৈশাচিকতার চরম মুহূর্তের যাতনা ধেয়ে আসে। এ যাতনা ভালবাসার মলিনতায় ছাপ ফেলে। শোকে কাতর পরিবারের মানুষগুলো। প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। পরিবারের মাঝে বোনের অন্যতম নিরাপদ স্থান ভাই। সেই ভাইয়ের কাছ থেকে বোনকে ছিনিয়ে নেয়া মানে নিজেকে অপরাজেয় হিসেবে উপস্থাপন নাকি আতঙ্কের রাজত্ব জানান দেয়া! খরবটুকু আমাদের ব্যথিত করে তুলে। পরিবারের ক্রন্দন রোল আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আসে। অপরাধবোধ বার বার তাড়িত করে। ভাই হয়েও বোনকে আগলে রাখতে পারেনি, অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করতে হয়। এ অসহায়ত্ব যে খুবই কঠিন। এটা আমাদের জন্য কখনো সুখকর সংবাদ হতে পারে না। চরম অসহায়ত্বের গ্লানিতে নিমজ্জিত থাকে ভূক্তভোগীর পরিবার! নিস্তব্ধতায় আঁধার ধেয়ে আসে বার বার। ফলে, পৈশাচিকতা গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলে।
সমাজের প্রতিটি স্তরে ক্ষেত্র বিশেষে অপরাধ প্রবণতা কম-বেশি ঘটতে দেখা যায়। চরম পর্যায়ে ঘটিয়ে সেটি থেকে উত্তরণের কোন সুযোগ না থাকলে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির ঘনঘটাই বাড়তে থাকবে। মানুষের মাঝে যখন এক ধরণের লোলুপতা কাজ করে তখনই সে নিকৃষ্ট কাজ করতে উদগ্রীব হয়। পৈশাচিক কাজ থেকে পিছপা হতে পারে না। হতে পারে সেটা একপেশে সংক্ষুব্ধ ভালবাসার মতো। সেটাও মেনে নিতে হবে পুরুষের নৈকট্য থেকে! নারীর কাছ থেকে 'না' শব্দটি তারা কখনো শুনতে চায় না। একপেশে ভালবাসার মাঝেই অপরের ভালবাসা আদায় করার অভিনব পন্থা খুঁজে। ভাবতে থাকে, সেখানে তার ভালবাসাই শ্রেষ্ঠত্বে মহিমান্বিত। অপরের ভালবাসা জোর করে আদায়ের মাঝেও অপরাধবোধ তাড়িত করে না। অপরকে নিজের করায়ত্ত্ব করতে পারাটাই মৌলিকতা।
অপরদিকে, নারীর স্বকীয়তায় নিজের ইচ্ছাটুকুর কোন স্বাধীনতা নেই। ব্যক্তি স্বাধীনতা সেখানে খর্ব করা হয়। নারীর নিজের অস্তিত্বের অনুভূতির ইচ্ছা ব্যক্ত করা এ ধরণের পুরুষ মেনে নিতে চায় না। সর্বদা নিজের ভালবাসার প্রতিপত্তিকেই জানান দিতে চায়।
তখনই শুরু হয় এসব বিবেক বর্জিত মানুষদের নির্মম অত্যাচার। এসব বিবেকহীন মানুষ থেকে রক্ষা পেতে সমাজের শোষিত মানুষ অনেক পথ খোঁজে। তারপরও এ অসহায়ত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি হয়ে উঠে না। অসহায়ত্ববোধ আরও নির্মম হয়ে উঠে যখন ভালবাসার প্রিয় মানুষটিকে বিবেকহীন মানুষদের হাতে বলি দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত প্রাণের বিনিময়ে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যতা প্রকাশে উদ্বেল হয়ে উঠে! খুনের মতো ঘটনা ঘটাতেও তারা পিছপা হয় না!
এসব ঘটনা আমাদের মনকে নাড়া দেয়। আতঙ্কিত করে তুলে সমাজের প্রতিটি অঙ্গন। স্তিমিত হয়ে আসে সমাজের চলমান গতিধারা। স্তব্ধ হয়ে আসে প্রতিটি মুহূর্ত। কেউ কেউ হত্যার সঠিক বিচার চেয়ে দিন গুনে। কিন্তু, পরিবারের গভীর মমত্ববোধের মিশেলে যে পিতা-মাতার প্রিয় সন্তানটিকে হত্যা করা হয়েছে তাকে কি ফিরে পাওয়া যাবে? কঠিনতর এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অশনি সংকেতই বহন করে।
আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশ হত্যায় আমাদের ভেতরে এক ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, আমাদের মন কাঁদে। প্রতিবাদ জানিয়ে মনুষ্যত্ববোধের মাঝে নিজেদের জানান দেই।
আমাদের দেশে ইভটিজিং কিংবা এসব নেতিবাচক ঘটনা ধৈর্যের অসীমতায় ঠেকেছে। সোচ্চার হতে দেখি না মনুষ্যত্ববোধের আঙিনা থেকে। অথচ এ জঘন্যতম কিংবা নৃশংসতম হত্যাকান্ডের মর্মবেদনা আমাদের সমাজের প্রতিটি মানুষকে বেদনাহত করে।
মনে প্রশ্ন জাগে, এসব মিজান কি সমাজে একটাই নাকি আরও তৈরি হচ্ছে। এসকল মিজান একটা নয়, এরা বার বার তৈরি হয়, বার বার এরা রাজত্ব কায়েম করে। এসব মানুষ কখনো সভ্য হতে পারে না।
এদের থেকেই সমাজকে রেহাই পেতে মা-বাবার বলিষ্ট ভূমিকা থাকতে হবে। অথচ সমাজ ব্যবস্থা কতটুকু অবনতি হলে মা-বাবা তার সন্তানকে অপরাধে উৎসাহ যোগাতে পারে।
মিজানের মা-বাবাকে বলার পরও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো মিজানের মা মেয়েকে মিজানের সঙ্গে কথা বলতে ও ফেসবুকে চ্যাট করার পরামর্শ দিতেন।
(প্রথম আলো, ২১ সেপ্টেম্বর; ২০২০)
কি সাবলীল ভঙ্গীতে মিজানের মা ঘটনার পেছন থেকে কাজ করে গেছেন।
যাদের হৃদ্যতা পরিবারকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখে, সেই প্রিয় মানুষটিকে হত্যা মানে পুরো পরিবারটিকে মানসিক যাতনায় নিমজ্জিত রাখা। তারপরও সমাজ সঠিক বিচারটুকু প্রত্যাশা করে। হয়তো বিচার হবে, অনেকটা দিন অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে। নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টায় রত থাকবে। কোন একদিন এ ঘটনা চাপা পড়ে যাবে। আঁধারের মাঝে বার বার ধাওয়া করে বেড়াবে মেয়ে হারানো যাতনায়। আমাদের এ সমাজ ব্যবস্থা হয়তো অন্য কোন ঘটনায় ব্যথিত হবে। নতুন করে আতঙ্ক তাদের পিছু নিবে।
আমাদের দেশ যখন উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে এমন কয়েকটি নৃশংস ঘটনা সমাজকে পেছনের দিকে টেনে রাখে। অন্ধকারে স্তম্ভিত হয়ে আসে কিছু মানুষের পরিবার। কেউ হয়তো ভয়ে মুখ খুলতে পারে না, কেউবা নি:শব্দে ঘটনা উত্তরণের নিমিত্তে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেউ কেউ লোক লজ্জ্বার ভয়ে আড়াল করে রাখে। এদের কতজনই বা রেহাই পায়। কতজনই ছেলে-মেয়েকে নিজেদের মতো করে বেড়ে উঠার পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
নীলার মা-বাবাও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে পেতে এক সময় সাভার ত্যাগ করে। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি! নীলার জীবনটা এত সহজেই স্তম্ভিত করে দিল বখাটে মিজান!
একটি মেয়ের জন্ম থেকে স্বাভাবিকতা বা স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে উঠা সবই নির্ভর করে আমাদের পরিবর্তনশীল সমাজ কাঠামোর উপর। নাকি আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এখনও মেয়ের জন্মই মানে পরিবারের ভয়!
অনজন কুমার রায়
ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক
বিষয়: অনজন কুমার রায়
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: