সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির বারোয়ারি দুর্গা পুজোর সেকাল-একাল : সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
২২ অক্টোবর ২০২০ ২০:৪৫

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ২২:৫৯

 

বাঙালির জাতীয় উৎসব শারদীয়া দুর্গোৎসব। আবহমান কাল ধরে এর আলাদা ব্যঞ্জনা, আলাদা মাত্রা। বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে  পুজোর দিনগুলো কাটে প্রাণের আবেগে, প্রাণপ্রাচুর্যে। তবে এবারের মতো এমন দুঃসময় ও কঠিন সময় আগে কখনও আসেনি। পুজোর আবেগ ও যুক্তি একদিকে যেমন আছে তেমনি অন্যদিকে আছে সনাতন-শাশ্বত ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের অভাবনীয় মেলবন্ধন।সময় কঠিন ও পরিবেশ প্রতিকূল হলেও তবু তিনি আসছেন। তিনি তো সবার মঙ্গলময়' মা'--- 'মা'কে ছাড়া জীবন পূর্ণ হতে পারে না। এই ভয়াবহ করোনা আবহে করুণাময়ীর আশীর্বাদ লাভে  আট থেকে আশির বাঙালি সকলেই স্বপ্নপূরণে উন্মুখ। পরিস্থিতি ও সময় কঠিন বলে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে মাতৃ আরাধনা।সময় বলছে পিতৃপক্ষের অবসান দেবী পক্ষের শুভ সূচনা হয়ে গেছে বেশকিছু দিন আগে। পারিবারিক ও বারোয়ারি পুজোর কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম ব্যস্ততার ছবি পরিলক্ষিত হচ্ছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের সরকারি রেজিস্ট্রার পুজোর সংখ্যা ৩৭ হাজার, এছাড়াও রেজিস্ট্রেশন নেই এমন পুজোর সংখ্যা খুব কম নয়। পারিবারিক পুজোর সংখ্যা কয়েক হাজার। সমগ্র ভারতে ও বিশ্বে পুজোর সংখ্যা আনুমানিক ৬০-৭০হাজার। পুজোর সঙ্গে কয়েক হাজার কোটি টাকার অর্থনীতি জড়িয়ে আছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে খরচ করতে হবে এটাই দস্তুর। করোনা আবহে বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থা। বারোয়ারি পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন। আমাদের আলোচনার বিষয় বারোয়ারি পুজোর সেকাল--একাল । কোটি--কোটি  বাঙালি ও বাংলা ভাষা-ভাষি মানুষের আজন্ম লালিত আবেগ জড়িয়ে আছে শারদীয়া দুর্গোৎসব-এর সঙ্গে। এটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

সেকালের  বারোয়ারি পুজোই আজ আধুনিকতার মোড়কে পোশাকি নাম সর্বজনীন পূজা। দুটো শব্দই খুব পুরোনো নয়। 'সর্বজনীন পূজার' বয়স  সত্তর-পঁচাত্তর বছরের বেশি। আর বারোয়ারি পুজোর বয়স মাত্র দুশো বছরের হয়ত কিছু বেশি।  ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী বারোয়ারি পুজোর সূত্রপাত হয় গুপ্তিপাড়ায়, ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। অন্তত সেই তারিখটাই আমাদের জানাচ্ছে 'ফ্রেণ্ড অফ ইন্ডিয়া' পত্রিকা ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে। ওই পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণী থেকে আমরা জানতে পারি যে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ত্রিশ বছর পূর্বে নদীয়া জেলার শান্তিপুরের কাছে গুপ্তিপাড়ায় কয়েকজন ব্রাক্ষণ একত্রিত হয়ে জগদ্ধাত্রী পূজা করবার জন্য এক সমিতি গঠন করে। তাঁরাই বারোয়ারি পূজার স্রষ্টা। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল--'the celebration of a puja independently of the rules of the shastras'। বারোজন ব্রাক্ষণ মিলে এই সমিতি গঠন করেছিল বলেই এর নাম হয় 'বারোয়ারি' তারা এই পূজা করেছিল নিজ এবং কাছাকাছি গ্রামবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে। সংগৃহীত চাঁদার টাকা পূজার পক্ষে যথেষ্ট নয় দেখে, তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোক পাঠায়  চাঁদা তোলবার জন্য। বাস্তবে দেখা যায় এসব লোক চাঁদা তুলে, টাকাটা আত্মসাৎ করে গা ঢাকা দেয়।যে পরিমাণ টাকা সমিতির হাতে এসে পৌঁছেছিল, তার পরিমাণ ছিল মাত্র সাত হাজার টাকা। তথ্যসূত্র অনুযায়ী প্রথম বারোয়ারি পূজা হয়েছিল মাত্র সাত হাজার টাকায়। তারা এমন সমারোহের সঙ্গে সাতদিন ধরে জগদ্ধাত্রী পূজা করেছিলেন যে দূর-দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জের লোক এই পূজা দেখতে এসেছিল। মন্ত্রপাঠ অবশ্য শাস্ত্রানুযায়ী হয়েছিল, কিন্তু অন্যান্য যে সব অনুষ্ঠান হয়েছিল, তা 'not recognised by the shastras'। নানা ধরনের উৎসব ও আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্হা হয়েছিল। তথা, সঙ, পুতুলনাচ, যাত্রাভিনয়, হাফ আখড়াইগান ইত্যাদি। প্রথম বছরে পুজোর অভাবনীয় সাফল্য দেখে, তারা এটাকে বাৎসরিক পূজায় পরিণত করে।

গুপ্তিপাড়ার পূজার সাফল্য দেখে,বারোয়ারি পূজা তাড়াতাড়ি বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সমসাময়িক সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারি যে বারোয়ারি পূজা সর্বত্র খুব ঘটা করেই হতো। যে সব জায়গাতেই বারোয়ারি পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বল্লভপুর, কোন্নগর, উলা, গুপ্তিপাড়া, চকদহ ও শ্রীপুর। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারি যে সে বৎসর গভর্মেন্ট গেজেটে লিখিত হয়েছিল 'শান্তিপুরে অতি সমারোহপূর্বক যে বারোয়ারি মহাপূজা হইয়াছে, তাহার বিষয়ে অনেকেই বলিতেছেন যে এরূপ ঘটা  পূর্বে আর কখনও হয়নি।' 

কিন্তু বারোয়ারি পুজোর সংখ্যা যত বাড়তে লাগলো, তাদের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ তত বাড়তে লাগলো।  সেই সময়ে সমসাময়িক সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ এ সম্পর্কে যথেষ্ট আলোকপাত করে। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখের সংবাদে প্রকাশিত হয় যে  জয়নগরে বারোয়ারি মহিষমর্দিনী পূজায় ভীষণ গোলমাল ঘটেছিল। বিরোধের কারণ জাতিভেদ প্রথা। শুধুই জাতিভেদ প্রথা নয়, ধর্মীয় সম্প্রদায় ভেদের কারণেও বারোয়ারি অধ্যক্ষদের মধ্যে বিরোধ ঘটত। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১৯ আগস্ট তারিখের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, চূঁচুড়ার লোকেরা বারোয়ারি পুজোর জন্য একটি মূর্তি তৈরি করেন। তাতে বৈষ্ণব সম্প্রদায় ভূক্ত তাঁতি ও শাক্ত সম্প্রদায় ভূক্ত শুড়িদের মধ্যে বলিদানের ব্যাপারে ভীষণ গোলমাল সৃষ্টি হয়। 'বোধ হয় দুই দলে দাঙ্গা উপস্থি হইবে।'---সম্পাদকীয় মন্তব্য।

বারোয়ারি পুজোর আসল রসদ ছিল তার চাঁদা। চাঁদার পরিমাণের উপর নির্ভর করতো পূজার উৎসবের ঘটা ও অধ্যক্ষগণের অংশ।সেকালে যারা চাঁদা দিত না তাদের জব্দ করার জন্য বারোয়ারি পূজার উদ্যোক্তারা তাদের বাড়িতে প্রতিমা ফেলে দিত। তাছাড়া উদ্যোক্তারা মেয়েদের ওপর অত্যাচার করতো। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের 'সংবাদ ভাস্কর'-এ উল্লেখ আছে 'স্ত্রীলোকের ডুলি-পালকি দৃষ্টি মাত্রই বারোয়ারি দল একত্রিত হইয়া তৎক্ষণাৎ আটক করিতেন, এবং তাহাদের ইচ্ছামত প্রণামী না পাইলে কদাপি ছাড়িয়া দিতেন না'। পরবর্তী সময়ে এই চাঁদার জুলুম ও নির্যাতন বন্ধ হয়ে যায় '২৪পরগনার জেলাশাসক পেটন সাহেবের চেষ্টায়। তিনি স্ত্রী বেশ ধারণ করে ডুলিতে চেপে পথে বেরিয়ে এই সকল উপদ্রবকারীদের গ্রেপ্তার করেন ও দীর্ঘমেয়াদী কারাদণ্ড দেন।'  পরবর্তীতে বারোয়ারি পুজোর কর্মকর্তারা কৌশলে চাঁদা তুলতেন। গুপ্তিপাড়ায় বারোয়ারি পূজার প্রথম সূচনা থেকেই ৪০-৫০ বছর ধরেই বারোয়ারি পূজার ধূম পুরোদমে চলেছিল। তারপর যুগের পরিবর্তনে, সাধারণ মানুষের অনীহা, চাঁদার কৃচ্ছ্রতা-- যে কোনও কারণে হোক, বারোয়ারি পূজার হিড়িক কমতে থাকে ক্রমশ। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের 'সমাচার দর্পণ' -এ তার উল্লেখ আছে। এককথায় বারোয়ারি পূজার সংখ্যা ক্রমশ কমেই আসছিল। মাত্র বড় বড় গ্রাম-গঞ্জে এবং শহরেই বারোয়ারি পূজা অনুষ্ঠিত হতো। ঐ সব জায়গার ব্যবসায়ীদারদের টাকায় মূলত পূজা অনুষ্ঠিত হতো। ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের কাছ থেকে চাঁদার একটা অংশ মাল বিক্রির সময় কৌশলে আদায় করতো, বর্তমানে অনেকটা জি, এইচ, টির মতো।

বিংশ শতাব্দীর গোড়াতো কলকাতা শহরে খুব অল্পই বারোয়ারি দুর্গাপূজা হত। দু-তিনটে পাড়া মিলে একটা বারোয়ারি পুজো করতো। বাগবাজার পল্লীর নিজস্ব কোন বারোয়ারি পূজা ছিল না। বাগবাজারের বারোয়ারি পূজার উদ্ভব হয় ১৯১৮ সাল নাগাদ। এক বড়লোকের বাড়িতে পূজা দেখতে গিয়ে পাড়ার কয়েকজন গণ্যমাণ্য মানুষ অপমানিত ও লাঞ্ছিত হন। তাঁরাই  স্হির করেন যে পাড়ায় একটি বারোয়ারি দুর্গাপূজা করবেন। কথিত আছে, প্রথম বাগবাজারের পূজা হয় ভূতনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির পিছনে সরকারদের নেবুতলার মাঠে। পরে পুজোটা হয়  পশুপতি বোস লেনের মোড়ে ইন্দুভূষণ দে'র বাড়ির রাস্তার দিকে উঠানে। এরপর পুজো হয় ঠাকুরদাস মিত্তিরের বাড়ির পিছনের মাঠে। এতদিন পুজো হতো সাদামাটা ভাবেই। এই প্রথম একটা' ফাংশন' হলো পূজা উপলক্ষে। এরপরই বাগবাজার বারোয়ারি দুর্গাপূজা একটা সংগঠিত রূপ নিল। সমাজের গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ -এর উদ্যোক্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটলো এই সময় থেকেই। বাগবাজারের প্রখ্যাত সলিসিটর দূর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন প্রথম বারোয়ারি পূজার উদ্যোক্তা । কলকাতায় ‌‌‌১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের সোসাইটিজ অ্যক্ট অনুযায়ীই রেজিস্ট্র করে এর নাম দিলেন'বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব অ্যণ্ড একজিবিশন'। পূজার জন্য পুরসভার কাছ থেকে একখণ্ড জমি পাওয়া গেল এবং তার নাম দেওয়া হল দুর্গানগরী। সেটাই হল বাংলাদেশের প্রথম রেজিস্ট্রিকৃত 'সর্বজনীন দুর্গাপূজা'। এর দেখাদেখি সেই সময় সিমলা ব্যায়াম সমিতিও এক সর্বজনীন দুর্গাপূজার সূচনা করল। সর্বজনীন নামটা ক্রমশ ব্যাপক আকার ধারণ করলো।

 বারোয়ারি পূজার পটপরিবর্তনের শুভ সূচনাঃ  এইভাবে 'বারোয়ারি' নামটা তাঁর ঐতিহ্য হারিয়ে অবলুপ্তির পথে পাড়ি দিল। আগে যেখানে  দু-তিনটে পল্লী মিলে একটা বারোয়ারি পূজা করতো, সেখানে প্রতি পল্লীতে দু-তিন-চারখানা পর্যন্ত 'সর্বজনীন' পূজা হতে লাগলো। সকলেই চাঁদার খাতা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো মহা উৎসাহে। শুধু তাই নয়, চাঁদার পরিমাণের জুলুম টা মানুষকে সন্ত্রস্ত করে তুললো। পুলিশকেও বলে কেউ রক্ষা পেতো না। শুরু হলো এক পূজা কমিটির সঙ্গে অন্য পূজা কমিটির রেষারেষি। বস্তুত চাঁদার ব্যাপারে একটা আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে আগেকার বারোয়ারির সঙ্গে আজকের   সর্বজনীন পূজার। চাঁদা আদায় করতে গিয়ে নানান ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতেই শুরু করলো। আগে দু-তিন পল্লী মিলে একটা পূজা করত। সুতরাং একটা চাঁদা দিলেই সমস্যা চুকে যেত। আজকের দিনে এক পাড়ায় দু-তিনটে সর্বজনীন পূজা  হওয়ায় দু-তিন দফা চাঁদা দিতে বাধ্য হতে হয়।

দু'-তিন পাড়ার একটা বারোয়ারি পূজার অনেক ভালো দিকও ছিল, এবিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। একটা সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকতো, সম্পর্কের নৈকট্যতা গড়ে উঠতো। দু'-তিন পাড়ায় মানুষ একই পূজা মণ্ডপের আঙিনায় মিলিত হয়ে পরস্পর পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশের একটা সুযোগ পেত। বয়স্ক মানুষজন পূজা মণ্ডপে খানিকক্ষণ বসে গল্পগুজব করত এবং তা থেকে নির্মল আনন্দ পেতো। আজকের সর্বজনীন দুর্গোৎসবের প্যান্ডেলে ভিড়ের মধ্যে লোকজন নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। কে, কার সঙ্গে পরিচয় ও গল্পকরবে, সেই অখণ্ড অবসরের সুযোগ  ক্রমশ কমতির দিকে। সেই সঙ্গে আজকের পূজায় বিশেষ করে ব্যাহত হচ্ছে মেয়েদের আনন্দ। এক সময় দেখা যেত, দু' -তিনটে পাড়ার মেয়েরা-বৌ-রা বারোয়ারিতলায় একত্রিত হয়ে একটা প্রাণের যোগাযোগ স্হাপন করতো। সকলেরই গর্ব ছিল,এটা তাঁদের নিজেদের পাড়ার পূজা। সবাই আন্তরিক ভাবে পূজার কাজে অংশ গ্রহণ করতেন। ফলকাটা থেকে শুরু করে পূজার যোগাড়ের দায়িত্ব ভার থাকতো মেয়েদের ওপর।আজ সেটা একেবারেই অন্তর্হিত। যদিও কিছু কিছু জায়গায় আজো পুরাতন ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।  হয়তো সমাজ জীবনে এই ছবি কাম্য নয়। পূজায় সমবেত বাকিদের অংশগ্রহণ এক অদ্ভূত আনন্দ ও উন্মাদনা সৃষ্টি করতো। বিশেষ করে সন্ধিপূজার সময়। আজকের সর্বজনীন দুর্গোৎসবে মাইকের কর্কশ শব্দে ঢাকের বাজনা চাপা পড়ে গেছে। আজ ঢাকীরা, ঢাক বাজিয়ে আনন্দ দিতে পারে না। আজকের পূজায় ভক্তিভাবনা গৌণ হয়ে গেছে। আজকের বেশি ভাগ সর্বজনীন দুর্গোৎসবে পূজার মাইকে শুনিনা আগেকার সেই আনন্দের উচ্ছ্বাস----' আগমনীর আগমনে আনন্দে গিয়েছে দেশ ভরে'। তাঁর পরিবর্তে শুনতে পাই চটুল হিন্দি গান।শুনি--'তোদের ঘুম  পেয়েছে, তোরা বাড়ি যা।' রুচিহীন  হই -হুল্লোর জায়গা করে নিয়েছে।  যদিও এই প্রবনতা   সব জায়গাতেই নয়‌। শোভনতা বজায়  নেই অনেক জায়গায়। এটা একটা আজকের সময়ের সর্বজনীন দুর্গোৎসবের  ক্ষতিকারক প্রবনতা। সমাজ জীবনে একটি অন্ধকার অধ্যায় সূচিত করছে বলে মনে হয়। রুচিশীল মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। মায়ের প্রতি নিষ্ঠা ও ভক্তিতে একেবারে ভাঁটা পড়ে গেছে।তবে অতীত ঐতিহ্যকে অনেকেই বজায় রাখতে পারছে না। আবার কেউ কেউ আজো বজায় রেখে চলেছে। এটি হয়তো ! আধুনিক যুগেরই অভিশাপ। পুরোহিতের গুরূত্ব অনেক খানি খর্ব করা হয়েছে। এখন অনেক জায়গায় পুরোহিতের সঙ্গে চুক্তি করে তার ওপর পূজার ভার দেওয়া হয়। তারপর পুজোর কর্মকর্তারা পূজা সম্পর্কে কোন খোঁজখবর রাখেন না।

মায়ের প্রতিমার সামনে যে বড় থালাটা পাতা থাকে, ভক্তবৃন্দের মায়ের উদ্দেশে টাকাকড়ি দেবার জন্য, তাও আজকের সর্বজনীন পুজো কমিটির কর্তাদের প্রাপ্য--পুরোহিতের নয়। অঞ্জলির সময় সাধারণ মানুষ যে দক্ষিণা ও শাড়ি  নিবেদন করেন তার দখল এখন পুজো কর্মকর্তাদের। নিষ্ঠার সঙ্গে মায়ের পূজা করা--এটা সর্বজনীন পূজার কর্মকর্তাদের লক্ষ্য নয়। একমাত্র লক্ষ্য ভিড় জমানো। তাঁর জন্য সকল সর্বজনীন পুজো কর্তাদের লক্ষ্য ভালো ডেকোরেশন ও আধুনিক আলোর বাতির বাহার সৃষ্টি করা। ভক্তিভাবনার পরিবর্তে বাইরের আড়ম্বর বেশি বেশি করে চোখে পড়ে। তবে সবত্রগামী নয়। নিষ্ঠা ও ভক্তিভরে পূজার চল কমে গেলেও আজো কিছু কিছু জায়গায় প্রতীয়মান।এটা ভালো দিক।

আজকের সর্বজনীন পূজার সবচাইতে বড় পরিবর্তন ঘটেছে মায়ের প্রতিমা গঠনে। এ বিষয়ে 'মা' প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিকার হয়েছেন। আমাদের-আপনাদের  মনে পড়ে  ছেলেবেলার মায়ের সেই মৃণ্ময়ী মূর্তি।এক চালচিত্রের মধ্যে মা সপরিবারে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি এসেছেন। মায়ের সে রূপ এখন যাঁরা ঘরোয়া পূজা করেন, সেখানেই একমাত্র দেখতে পাওয়া যায়। কিছু  সর্বজনীন পুজো ছাড়া সেই রূপ দেখতে পাওয়া যায় না বড় একটা। বাংলার যৌথ পরিবারের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে মায়ের প্রতিমা গঠনের ক্ষেত্রেও তাই ঘটতে  আরম্ভ করেছে। এখন মায়ের পরিবার ভাঙতে শুরু করেছে। এগুলো মূলত কলকাতা ও জেলা শহরে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। 'মা' একা দাঁড়িয়ে আছেন, মহিষমর্দনে নিযুক্তা হয়ে। আর তাঁর ছেলেমেয়েরা মায়ের চালচিত্রের ভেতর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার সুখ উপভোগ করছে। এ-দৃশ্য দেখলে মনে হয়,এটা যেনে  বাংলাদেশের চিরাচরিত যৌথপরিবার ভাঙনের প্রতীক‌

আগে মা মৃণ্ময়ী হতেন। মৃণ্ময়ী মাকে চিন্ময়ী করে তোলাই ছিল পূজার উদ্দেশ্য। কিন্তু বর্তমানে এখন  অনেক জায়গায় মৃণ্ময়ী মা কোথায়? আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আজকের সময়ে নানা ধরনের উপাদান দিয়ে এখন মাকে তৈরি করা হচ্ছে। সনাতন, শাশ্বত শাস্ত্রীয় ভাবনা মাণ্যতা পাচ্ছে না।  আজকের সর্বজনীন পূজায়  মোমের, শোলার, দেশলাইয়ের, বিস্কুটের,বাদামের, লজেন্সের, আখের ছোবড়ার, নারকেল মালার, ঝিনুকের, কাগজের দুর্গা শোভা পাচ্ছে। একটা সময় শোনা যায় যে পুরোহিত ব্রাক্ষণের দল নাকি মাকে নিয়ে এরকম আর্টের ছেলেখেলার প্রতিবাদ করেছিলেন। কথিত আছে কেউ কেউ বলেছিলেন,এরকম অশাস্ত্রীয় মূর্তির তাঁরা পূজা করবেন না। তারপর 'মূল্য ধরে' দেওয়ায় তাঁরা বাধ্য হয়ে রাজি হন।

আগেকার দিনে মানুষ বারোমাস নির্দিষ্ট দোকান থেকেই জামা-কাপড় কিনতো পূজার সময়। সবই ধারে। পূজার সময় অভিভাবকরাই নিজেরাই পছন্দ করে পরিবারের সকলের জন্য পূজার জামা-কাপড় ইত্যাদি কিনে আনতেন, পরিবারের সদস্যরা সকলে আনন্দচিত্তে তার গ্রহণ করতো। এটাই স্বাভাবিক ছিল।তাই পরেই তারা পূজার কয়টা দিন পুজো বাড়িতে গিয়ে আনন্দ করতো। এখন  অভিভাবকদের আর সে স্বাধীনতা  নেই। সে স্বাধীনতা চলে গেছে ছেলেমেয়েদের হাতে। সকলেই ফ্যাশানেবল জিনিস চায়, তা না হলে বন্ধু--বান্ধবদের কাছে তাদের 'মান-ইজ্জত' থাকে না। সে জন্য তাদেরকে নিয়ে যেতে হয় বড় বড় শহরগুলোতে অবস্হিত শপিং মলে, নিউমার্কেট, গড়িয়াট ইত্যাদি বিখ্যাত জায়গায়। যেটা পছন্দ করবে, সেটাই কিনে দিতেই হবে--নগদ মূল্যে। অভিভাবকদের অবস্হা প্রাণান্তকর।

শেষকথাঃ সেকাল থেকে একালে বারোয়ারি/সর্বজনীন দুর্গোপুজোয় যে শুধু একটা রূপান্তর এসেছে তাই নয়, বলা যায় ঘটে গেছে একটা মহাবিপ্লব। এখনকার বড় পুজো মানেই প্যাণ্ডেলের কারুকার্যে, লাইটিং-এর জাঁকজমকে প্রতিমার রূপ সজ্জায় একে অপরের টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা। ঢুকেছে রাজনীতির নানা প্যাঁচ পয়জারও। এখন তো আবার রমরমা করে চলছে 'স্পনসরশিপের' পুজো। গত বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যেই একালের পুজো  প্লাস্টিকের শিউলি ফুলের মতোই আমূল বদলে গেছে। নব্বই দশকে এই বদলের শুরু। আজকের সময়ে তা পল্লবিত হয়েছে  ব্যাপক ভাবেই। বড়পুজো মানেই তাক লাগিয়ে দেওয়ার একটা অশুভ প্রতিযোগিতা। চাঁদার সীমাহীন দাপট। ছত্রে ছত্রে রাজনীতির  অনুপ্রবেশ।  লাইটিং -এর মাধ্যমে কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা,  বিতর্কিত বিষয়বস্তু দেখিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা। প্রতিমার সাজসজ্জা ও রূপসজ্জা এবং বিন্যাসে নতুন আঙ্গিকের সৃষ্টি করা। রাজ্যপাল, কোন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী, বা বিখ্যাত সিনেমার অভিনেত্রী-অভিনেতাদের দিয়ে পুজো উদ্বোধন করানো। একটা ভালো দিক লক্ষ্য করা যায়, পুজোর উদর্বৃত্ত অর্থে আ্যম্বুলেন্স, শববাহী গাড়ি কেনা কিংবা কোন সৎ কাজে অর্থ দান করা। সর্বোপরি এই গোটা ব্যাপারটা করার জন্য যে বিশাল ব্যয়ভার তাঁর পুরো টাকাটাই 'স্পনসরশিপ' দান বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তোলা। এই পরিবর্তন একদিনে হয়নি।  ধীরে  ধীরে বাণিজ্যিক করণ ঘটেছে। বড়বড় কোম্পানী নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে নেমে পড়েছে। সব রাজনৈতিক দল পুজোকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে সমাজ জীবন দূষিত হচ্ছে।  ভক্তিভাবনার আড়ালে নিজেদেরকে বিজ্ঞাপিত করাই মূল উদ্দেশ্য পুজো কমিটির সদস্যদের ও কর্মকর্তাদের। এইভাবেই সময়ের হাত ধরে সেকালের বারোয়ারি পুজো বদলে গিয়ে আজকের সর্বজনীন পূজার মহিমা লাভ করেছে। একালের পুজোয় প্যাণ্ডেল, লাইটিং,জলসা,সমাজসেবা, রাজনৈতিক প্রচার ও ভি আই পি দিয়ে উদ্বোধন একটা অভিনবত্বের আমদানি ঘটেছে ভীষণ ভাবে। গত ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে এমনটা ছিল না। পুজোর আসল মাহাত্ম আজ গৌণ হয়ে পড়েছে, বেড়েছে পাল্লাদিয়ে দেখানদারির ব্যাপার। যদিও সমস্ত বারোয়ারি পুজোর কমিটির কর্মকর্তারা মনে করেন তাঁরা পুজোর আয়োজন করেন একেবারে শুদ্ধাচারে।  সেখানে সেকাল-একালের কোন প্রভেদ নেই। আর কয়েক দিন বাদেই বাঙালি জাতি  শারদীয়া দুর্গোৎসব-এ মেতে উঠবে কম-বেশি যতই করোনার আবহ থাকুক, সেটাই স্বাভাবিক। পূজার সময় চারিদিকে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি দেখবো, তা থেকে ভাবছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

এই নিবন্ধটি লিখতে গিয়ে একবার কৈশোরের ভালোলাগা বর্ণময় অনুভূতির কথা মনে পড়ছে, বয়স তখন খুব কম। খুব ভোরবেলা উঠে শিউলিতলায় গিয়ে দাঁড়াতাম। কমলা বোঁটার সাদা ফুলের চাদর বিছানো থাকতো গাছটার চারিপাশে। সেই সঙ্গে শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ। খুব ইচ্ছে করতো আঁজলা ভর্তি নরম শিউলি ফুল নিয়ে গন্ধ শুঁকি। আঁজলা ভরে ফুল নিতাম। কিন্তু তারপরেই ঘাড় ফিরিয়ে দেখতাম মাথার পিছনে মা দাঁড়িয়ে আছেন। মিষ্টি হেসে বলতেন, শুঁকতে নেই। তাহলে পুজোয় লাগে না। সেই ফুলে অবচেতন মনে মালা গাঁথতাম। পনের-বিশ হাতের। একেবারে যাতে প্রতিমার  মুকুট থেকে নীচে মায়ের ঘট পর্যন্ত এসে পড়ে। খুব বেশি দিন নয়, কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেকার কথা। তারপর মালা গাঁথার দিন কবে শেষ হয়ে গেছে নিজেই জানি না। বছর খানিক আগে প্রতিমার গলায় অমনি বিশ ফুটের লম্বা শিউলি ফুলের মালা নবমীর রাতে সদ্য ফোটা ফুলের মতো তরতাজা দেখে অবাক হলাম। পূজারী ডেকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি আমাকে বললেন, ওতো প্লাস্টিকের শিউলি ফুল! গন্ধ নেই, কিন্তু শুকিয়ে যায় না। গত বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যেই একালের পুজো ওই প্লাস্টিকের ফুলের মতোই আমূল বদলে গেছে।

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে

 

সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প ও ছোটগল্পের এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক

পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top